কাজী জহিরুল ইসলাম
রাজশাহী আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে শিল্পী এসএম সুলতান সেখানকার সুধী সমাজের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, সদ্য স্বাধীন দেশে এখন আমাদের অনেক কাজ। দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে, উৎপাদন বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিতে হবে। শিল্পের চর্চায় সময় ব্যয় করা এখন বাহুল্য। এমতাবস্থায় আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার কী প্রয়োজন আছে? এটি খুব সঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু আমরা যে যার পেশায় কঠোর পরিশ্রম করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে যাব তখন বিশ্রামের দরকার হবে। আমাদের চোখের এবং মনের বিশ্রাম ও আরামের জন্য তখন শিল্পের দরকার হবে। শিল্প আমাদের কর্মোদ্দীপনা জোগাবে।
শিল্প আমাদের বোধের নিস্তরঙ্গ জলাশয়ে ঢেউ তোলে। সেই ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে আমরা নানান দেশে পৌঁছে যাই, নানান ঘাট থেকে তুলে আনি নিজেকে গড়ে তোলার উপকরণ। আমরা সমৃদ্ধ হই, সমৃদ্ধ করে তুলি মানব সভ্যতাকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৩৭টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। যেখানেই গেছেন আলো ছড়িয়েছেন, নিজের দেশ ও জাতির জন্য নতুন কোনো আলো তুলে আনবার চেষ্টা করেছেন। যেখানেই শিল্পের প্রতি, ঐতিহ্যের প্রতি মানুষের কদর দেখেছেন, আপ্লুত হয়েছেন এবং তা প্রিয়জনদের লিখে জানিয়েছেন।
১৯৩০ সালে তিনি রাশিয়া থেকে নন্দলাল বসুকে লিখছেন, ‘সম্রাট যখন গুষ্টিশুদ্ধ গেল সরে তখনো তার সাঙ্গপাঙ্গরা দাপিয়ে বেড়াতে লাগল – তাদের অস্ত্র ও উৎসাহ জোগালে অপর সাম্রাজ্যভোগীরা। বুঝতেই পারছ, ব্যাপারখানা সহজ ছিল না। একদা যারা ছিল সম্রাটের উপগ্রহ ধনীর দল, চাষীদের ‘পরে যাদের ছিল অসীম প্রভুত্ব, তাদের সর্বনাশ বেধে গেল। লুটপাট কাড়াকাড়ি চলল, তাদের বহুমূল্য ভোগের সামগ্রী ছারখার করবার জন্যে প্রজারা হন্যে হয়ে উঠেছে। এতবড়ো উশৃংখল উৎপাতের সময় বিপ্লবী নেতাদের কাছ থেকে কড়া হুকুম এসেছে – আর্ট-সামগ্রীকে কোনোমতে যেন নষ্ট হতে দেওয়া না হয়। ধনীদের পরিত্যক্ত প্রাসাদ থেকে ছাত্ররা অধ্যাপকেরা অর্ধঅভুক্ত শীতক্লিষ্ট অবস্থায় দল বেঁধে যা-কিছু রক্ষাযোগ্য জিনিস সমস্ত উদ্ধার করে য়ুনিভার্সিটির ম্যুজিয়মে সংগ্রহ করতে লাগল। মনে আছে আমরা যখন চীনে গিয়েছিলুম কী দেখেছিলুম। য়ুরোপের সাম্রাজ্যভোগীরা পিকিনের বসন্তপ্রাসাদকে কি রকম ধূলিসাৎ করে দিয়েছে, বহুযুগের অমূল্য শিল্পসামগ্রী কি রকম লুটেপুটে ছিঁড়ে ভেঙে দিয়েছে উড়িয়ে পুড়িয়ে। তেমন সব জিনিস জগতে আর কোনোদিন তৈরি হতেই পারবে না।’
সুন্দর ও শিল্পের প্রতি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খলনায়কও সুদৃষ্টি দিতে ভুল করেননি।হিটলার তার বাহিনীকে বলেছিলেন, প্যারিসের সৌন্দর্য যেন নষ্ট না হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই চিঠিতে আমরা শিল্পের প্রতি গভীর মমত্ববোধের সাক্ষাৎ পাই। সেই শিল্পের ভৌগোলিক অবস্থান যেখানেই হোক না কেন। পৃথিবীর সকল কিছুতেই যেন তার হৃদয় ব্যপ্ত। দেশ থেকে দেশে যেখানেই গেছেন, কী বিমানের জানালা দিয়ে, কী হোটেলের কাচের শার্শি ঠেলে, দুচোখ ভরে দেখার চেষ্টা করেছেন পৃথিবীর শিল্পরূপ। সেখানে আঘাত এলেই তার হৃদয় হাহাকার করে উঠেছে।
তিনি রাশিয়া ভ্রমণ করেন বিপ্লবের আট বছর পরে। সেখানে অবস্থানকালে সাম্রাজ্যবাদের পতনে কি কি পরিবর্তন এসেছে এবং তা কতটা মানুষের জন্য কল্যাণকর হয়েছে এসব বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন। সকল মানুষ জাত, পাত, ধনী, দরিদ্রের উর্ধে উঠে এক মানুষের মর্যাদা পাচ্ছে এটি একদিকে যেমন তাকে আনন্দ দিয়েছে আবার অন্যদিকে কম্যুনিস্ট শাসনের কঠোরতায় মানুষের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে এতে তিনি ব্যথিতও হয়েছেন। তবে এই ব্যাথা কেবল মুহূর্তকালের। ধর্ম ও জার এই দুই জুজু থেকে রাশিয়ার মানুষের মুক্তি ঘটায় তিনি স্বস্তিবোধ করেছেন, এবং শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীদের প্রশংসাই করেছেন।
১৯৩০ সালের ৩ অক্টোবর সুরেন্দ্রনাথ করকে লিখিত এক পত্রে তিনি লেখেন, ‘যে পুরাতন ধর্মতন্ত্র এবং পুরাতন রাষ্ট্রতন্ত্র
বহু শতাব্দী ধরে এদের বুদ্ধিকে অভিভূত এবং প্রাণশক্তিকে নিঃশেষপ্রায় করে দিয়েছে, এই সোভিয়েট বিপ্লবীরা তাদের দুটোকেই দিয়েছে নির্মূল করে; এতবড়ো বন্ধনজর্জর জাতিকে এত অল্পকালে এত বড়ো মুক্তি দিয়েছে দেখে মন আনন্দিত হয়। কেননা, যে ধর্ম মূঢ়তাকে বাহন ক’রে মানুষের চিত্তের স্বাধীনতা নষ্ট করে, কোনো রাজাও তার চেয়ে আমাদের বড়ো শত্রু হতে পারে না – সে রাজা বাইরে থেকে প্রজাদের স্বাধীনতাকে যতই নিগড়বদ্ধ করুক-না। এ পর্যন্ত দেখা গেছে, যে রাজা প্রজাকে দাস করে রাখতে চেয়েছে সে রাজার সর্বপ্রধান সহায় সেই ধর্ম যা মানুষকে অন্ধ করে রাখে। সে ধর্ম বিষকন্যার মতো; আলিঙ্গন ক’রে সে মুগ্ধ করে, মুগ্ধ ক’রে সে মারে। শক্তিশেলের চেয়ে ভক্তিশেল গভীরতর মর্মে গিয়ে প্রবেশ করে, কেনন তার মার আরামের মার।
সোভিয়েটরা রুশসম্রাট-কৃত অপমান এবং আত্মকৃত অপমানের হাত থেকে এই দেশকে বাঁচিয়েছে – অন্য দেশের ধার্মিকেরা ওদের যত নিন্দাই করুক আমি নিন্দা করতে পারব না। ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো। রাশিয়ার বুকের ‘পরে ধর্ম ও অত্যাচারী রাজার পাথর নড়ে যাওয়ায় কী প্রকাণ্ড নিষ্কৃতি হয়েছে এখানে এলে সেটা স্বচক্ষে দেখতে পেতে।’
ধর্মের প্রতি তার এই খেদোক্তির মূল কারণ হচ্ছে ধর্ম প্রায় সব দেশে, সব কালেই মানুষকে শিক্ষাবিমুখ করে রেখেছে। কোনো এক সময়ে অন্ধ, বর্বর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে একটি নিয়মতান্ত্রিক শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য ধর্মের দরকার ছিল। ধর্ম হচ্ছে মানুষের প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠার পর মানুষের নতুন ধর্ম হয়ে যায় আধুনিক শিক্ষা। তখনও যদি কেউ পুরাতন ধর্মের অনুশাসন থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে তাহলে বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা তাকে দূরে ঠেলে দেয়। পরের দিন রাশিয়া ভ্রমণ শেষ করে তিনি যখন যাত্রা করেছেন আমেরিকার পথে তখন রামানন্দ চট্টপাধ্যায়কে লিখছেন, ‘রাশিয়া থেকে ফিরে এসেছি, চলেছি আমেরিকার পথে। রাশিয়া-যাত্রায় আমার একটি মাত্র উদ্দেশ্য ছিল – ওখানে জনসাধারণের শিক্ষা-বিস্তারের কাজ কি রকম চলছে আর ওরা তার ফল কিরকম পাচ্ছে সেইটে অল্প সময়ের মধ্যে দেখে নেওয়া।
আমার মত এই যে, ভারতবর্ষের বুকের ওপর যত-কিছু দুঃখ আজ অভ্রভেদী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার একটিমাত্র ভিত্তি হচ্ছে অশিক্ষা। জাতিভেদ, ধর্মবিরোধ, কর্মজড়তা, আর্থিক দৌর্বল্য – সমস্তই আকড়ে আছে এই শিক্ষার অভাবকে।’
শিক্ষার সুফল সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি একই পত্রে লেখেন, ‘ওরা একদিন ডাইনী বলে নিরপরাধকে পুড়িয়েছে, পাপিষ্ঠ বলে বৈজ্ঞানিককে মেরেছে, ধর্মমতের স্বাতন্ত্র্যকে অতি নিষ্ঠুরভাবে পীড়ন করেছে, নিজেরই ধর্মের ভিন্ন সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রাধিকারকে খর্ব করে রেখেছে; এ ছাড়া কত অন্ধতা, কত মূঢ়তা, কত কদাচার, মধ্যযুগের ইতিহাস থেকে তার তালিকা স্তূপাকার করে তোলা যায় – এ সমস্ত দূর হলো কী করে? বাইরেকার কোনো কোর্ট অব ওয়ার্ডস-এর হাতে ওদের অক্ষমতার সংস্কার সাধনের ভার দেওয়া হয়নি; একটি মাত্র শক্তি ওদের এগিয়ে দিয়েছে, সে হচ্ছে ওদের শিক্ষা।
জাপান এই শিক্ষার যোগেই অল্পকালের মধ্যে দেশের রাষ্ট্রশক্তিকে সর্বসাধারণের ইচ্ছা ও চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে, দেশের অর্থ-উৎপাদনের শক্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। বর্তমান তুরস্ক প্রবল বেগে এই শিক্ষা অগ্রসর করে দিয়ে ধর্মান্ধতার প্রবল বোঝা থেকে দেশকে মুক্ত করবার পথে চলেছে। “ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়”। কেননা ঘরে আলো আসতে দেওয়া হয়নি – যে আলোতে আজকের পৃথিবী জেগে, সেই শিক্ষার আলো ভারতের রুদ্ধ দ্বারের বাইরে।’
জারের পতনের পর নতুন সোভিয়েত সমাজে যে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে তা দেখে বিশ্বকবি খুবই প্রীত হন। যত দেখেন ততই তিনি মুগ্ধ হন। একটি আশ্রম পরিদর্শন করতে গিয়ে সেখানকার বালক-বালিকাদের সঙ্গে সংলাপে অবতীর্ণ হন। সেই সংলাপের মধ্য থেকে কাজের প্রতি তাদের নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা এবং সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উঠে আসে। কেউ যদি অন্যায় করে তার জন্য শাস্তির বা বিচারকার্যের বিধান কি? জানতে চাইলে বালক-বালিকারা জানায়, সকলে মিলে তাকে বলা হয় যে সে ভুল করেছে। ব্যাস এইটাই তার বড় শাস্তি। এতে করে সে লজ্জিত হয়, দুঃখপ্রকাশ করে এবং এই ভুল বা অন্যায় আর করে না।
রাশিয়ার নতুন ব্যবস্থায় তিনি এতোটায় উচ্ছ্বসিত যে আশা অধিকারীকে এক পত্রে লেখেন, ‘রাশিয়ায় গিয়েছিলুম ওদের শিক্ষাবিধি দেখবার জন্যে। দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছি। আট বছরের মধ্যে শিক্ষার জোরে সমস্ত দেশের লোকের মনের চেহারা বদলে দিয়েছে। যারা মূক ছিল তারা ভাষা পেয়েছে, যারা মূঢ় ছিল তাদের চিত্তের আবরণ উদঘাটিত, যারা অক্ষম ছিল তাদের আত্মশক্তি জাগরূক, যারা অবমাননার তলায় তলিয়ে ছিল আজ তারা সমাজের অন্ধ কুঠুরি থেকে বেরিয়ে এসে সবার সঙ্গে সমান আসন পাবার অধিকারী। এত প্রভূত লোকের যে এত দ্রুত এমন ভাবান্তর ঘটতে পারে তা কল্পনা করা কঠিন। এদের এতকালের মরা গাঙে শিক্ষার প্লাবন বয়েছে দেখে মন পুলকিত হয়। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত সচেষ্ট, সচেতন। এদের সামনে একটা নতুন আশার বীথিকা দিগন্ত পেরিয়ে অবারিত – সর্বত্র জীবনের বেগ পূর্ণ মাত্রায়। এরা তিনটে জিনিস নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত আছে – শিক্ষা, কৃষি এবং যন্ত্র।’
দীর্ঘ চিঠির অন্য অংশে রাশিয়ার চাষাবাদে বিজ্ঞানভিত্তিক কলের লাঙলের প্রচলনে বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং আফসোস করেন ভারতবর্ষ এই শিক্ষা কেন আজও অব্দি গ্রহন করছে না।
ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদ (স) বলেছেন, ‘তুমি কতটা জ্ঞানী তা বলতে এসো না বরং বলো তুমি কতটা পথ হেঁটে এসেছো।’ তিনি হাঁটা অর্থাৎ ভ্রমণের ওপর সর্বদা গুরুত্বারোপ করেছেন এজন্য যে ভ্রমণের প্রতি পদক্ষেপে মানুষ নতুন নতুন শিক্ষা লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে প্রচুর ভ্রমণ করেছেন এবং ভ্রমণের প্রতি পদক্ষেপে হীরে-মতি দুহাতে কুড়িয়েছেন নিজের ভাষার মানুষের জন্য। প্রতি মুহূর্তেই দেখেছেন কোথায় কি হচ্ছে যা ভারতবর্ষে কাজে লাগতে পারে। তার সেই অর্জিত জ্ঞান তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন স্বজাতির অনুর্বর শস্যক্ষেত্রে কিন্তু আফসোস সেখানে তেমন উজ্জ্বল কোনো ফসল উৎপন্ন হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলা ভাষাটিকে গড়েই তোলেননি, গদ্য, পদ্য ও গীত, এই ত্রিধারায় এর কোলিন্য বজায় রেখেই ভাষাটিকে গণমানুষের আপন করে তোলেন। ভাষাটিকে গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে যেমন এর সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন আপন রচনা সম্ভারে তেমনি এই ভাষার মানুষের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য অহোরাত্রি কাজ করে গেছেন। পৃথিবীর যেখানেই গেছেন, স্বজাতির জন্য তুলে এনেছেন হীরে-মানিক।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৩ মে ২০২১।