spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যব্যক্তি ও প্রতিভার স্বীকৃতি

লিখেছেন : আল মাহমুদ

ব্যক্তি ও প্রতিভার স্বীকৃতি

আল মাহমুদ 

প্রিয়তম কোন কবি বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের উপর লিখতে গেলে যে সংযত ভাষা ব্যবহার করতে হয় কবি সাজ্জাদ বিপ্লবের ব্যাপারে আমার পক্ষে অতোটা সংযত তথা বানানো ভদ্রভাষা ব্যবহার করা সম্ভবপর নয়। সাজ্জাদ আমার সমর্থক। আমার উপর তার “স্বল্পদৈর্ঘ্য” এতোই পক্ষপাতমূলক রচনা প্রকাশ করেছে যে, আমি এটাকে দৈব ঘটনা বলে মনে করি। আমারও পক্ষপাত আছে। সেই পক্ষপাত হলো সাজ্জাদের কবিত্বশক্তি এবং অসাধারণ সম্পাদনা ক্ষমতার ব্যাপারে। মফস্বল থেকে এ পর্যন্ত যত পত্র-পত্রিকা-লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয়েছে আমার বিবেচনায় –“স্বল্পদৈর্ঘ্য”ই হলো এরমধ্যে সবচেয়ে মননশীলতায় সমৃদ্ধ। স্পষ্ট ভাবেই একটু বলা উচিত, আমি সাজ্জাদ বিপ্লবকে শুধু নব্বই দশকের সেরা কবি হিসাবেই গণ্য করি না, আমি মনে করি নব্বই দশকের সবচেয়ে প্রতিভাবান ও নতুন উদ্ভাবনায় সমৃদ্ধ প্রধানতম কবি হলেন–সাজ্জাদ বিপ্লব। এর আগেও আমি সাজ্জাদের উপর আলোচনা করেছি। নব্বই দশকের কবিতার সামগ্রিক আলোচনায় তার নাম উল্লেখ করেছি মাত্র। কিন্তু আমি কখনো ভুলিনি– সাজ্জাদ বিপ্লব শুধু দশকওয়ারী বিবেচনায় একালের নতুন কবিতার উদ্ভাবক হিসেবে অনন্য। তার কবিতায় বস্তুর সত্তা বদলে যায় এবং আমার চোখের সামনে নতুন দৃশ্যকল্প হাজির করে। আমি যেহেতু এই সময় চিত্রকল্পকেই কবিতা বলে ঘোষণা করতে চাই। সে জন্য আমার বক্তব্যের সমর্থনে দু’একজন কবিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করতে আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়, তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম আমি সাজ্জাদের নাম উল্লেখ করতে চাই। 

ওগো মেয়ে

দোপাট্টা সরিয়ো না তোমার 

তাহলে যুদ্ধ বেধে যাবে

যেমন যুদ্ধ বেধেছিলো

হেলেনের নগরীতে

তোমার দোপাট্টা সরানোর সঙ্গে-সঙ্গে 

সরে যায় জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা 

নো-ফ্লাই জোনে হামলার মতো

ঝাঁক-ঝাঁক যুদ্ধবাজ তরুণ 

তখন ছুটে গেলে

তুমি কি তাদের দোষ দিবে?

কেননা আগুন জ্বালালে 

পতঙ্গ তাতে ঝাঁপ দেবেই

এই কবিতায় যেই বলা হলো : ‘ওগো মেয়ে/ দোপাট্টা সরিয়ো না তোমার’–অমনি আমাদের চোখ থেকে মেয়েটির আব্রু সরে গিয়ে এমন এক লোভনীয় এবং বলয়িত চুম্বকক্ষেত্র বেরিয়ে পরলো যা সত্যি-সত্যি যুদ্ধের কারণ হতে পারে। মূলত কবিতাটির মূলশক্তি হলো–চিত্রকল্প। দৃশ্যটি শাট করে চোখের সামনে এসে যায়। এখানে সাজ্জাদের নির্মাণে কোন জারিজুরি বা জটিলতা নেই। সোজাসুজি বিষয়টিকে উত্থাপন করা হয়েছে। এই কবিতার প্রতিটি পঙক্তির স্বার্থকতা (মেয়েটির উন্নত বক্ষ–যা আমরা কল্পনা করে নিতে পারি) সৃষ্টি হয়েছে উপমাহীনভাবে উত্থাপনের মধ্য দিয়ে। এখানে সাজ্জাদ এমনকি একটি উপমাও ব্যবহার করেননি। এই যে উপমা ব্যবহার না করেই পাঠকের কল্পনা শক্তিতে একজন যুবতীর উরস যুগলের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত করার ক্ষমতা দেখালেন এটাকেই আমি সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিত্বশক্তি হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। আমি মেনে নিতে চাই বা না চাই, তাতে তো কবিতাটির কিছু এসে যাচ্ছে না। এখানে আমি কবি সাজ্জাদ বিপ্লবের সমস্ত তৎপরতার মধ্যে তার কাব্যশক্তিকে প্রাধান্য দিতে বাধ্য হচ্ছি।

০৫.০৮.২০০৫

গুলশান, ঢাকা। 

২.

ব্যক্তি প্রতিভার পরিশ্রম এবং সৃজনশীল কাজের মূল্যায়ন আমদের দেশে সহজে কেউ করতে চায় না। অথচ আমাদের সাহিত্যে যত বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তার উদ্ভব হচ্ছে কোন দলীয় বা সংঘবদ্ধ প্রয়াসের দ্বারা নয়। হচ্ছে ব্যক্তি বিশেষের দ্বারা। এসব ব্যক্তিকে সাহিত্যের অঙ্গণে যারা স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন জানাতে পারতেন তারা কেউ কোনোদিন স্বতন্ত্র ব্যক্তি প্রতিভার কাজের কোনো স্বীকৃতি দেননি। অবশ্য এতে ব্যক্তি উদ্যম কখনো থেমে থাকে না। যেমন থেমে নেই বগুড়ার লিটল ম্যাগ “স্বল্পদৈর্ঘ্য” এর সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লবের উদ্যম। বহুদিন ধরে সম্পূর্ণ একাকী সাজ্জাদ “স্বল্পদৈর্ঘ্য” নামক একটি সম্পূর্ণ কৌতূহলোদ্দীপক লিটলম্যাগ বের করে যাচ্ছেন। সাজ্জাদ নব্বই দশকের প্রতিভাবান কবি ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এ নিয়ে তার কোন হাঁকডাক নেই। তার প্রাণভোমরা হলো তার ঐ লিটল ম্যাগ “স্বল্পদৈর্ঘ্য”।

সাহিত্যে অনেক অন্যায়ের প্রতিবাদ ” স্বল্পদৈর্ঘ্য” দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে। নির্ভীক এই সম্পাদক সাজ্জাদ নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে এবং ব্যক্তিগত শত্রুতার তীব্র শ্লেষের মধ্যে “স্বল্পদৈর্ঘ্য” বের করে চলেছেন। যেহেতু তার জীবিকার তাগিদে তিনি এখন আর বগুড়ায় অবস্থান করছেন না, চলে এসেছেন ঢাকায় এবং চাকরি ক্ষেত্রে দিবসে সবটা কাটিয়ে দিয়ে যেটুকু প্রাণশক্তি থাকে সেটা ব্যবহার করেই তিনি “স্বল্পদৈর্ঘ্য” বের করে চলেছেন। অনেক বড় সাহিত্য পত্রিকা যা পারেনি “স্বল্পদৈর্ঘ্য” সেই কাজ করে চলেছে। তার কাজের নাম– সাহিত্যে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা। 

আমি নব্বই দশকের কবিদের ওপর “গোধূলিসন্ধির নৃত্য” বলে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। এতে আমি সাজ্জাদ বিপ্লবের কথা, তার কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম এবং তার প্রতিপক্ষের কবিদেরও উল্লেখযোগ্য প্রশংসা করতে আমি কার্পণ্যবোধ করিনি। আমি প্রায় তরুণদের একটি কথা বলে আশ্বাস দিয়ে থাকি। সেটা হলো যারা আন্তরিকতার সঙ্গে সাহিত্যচর্চা করেন, সাহিত্য তাদের খালি হাতে ফেরায় না। আজ না হোক কাল একটি সোনার টাকা সাহিত্য তার উদ্যমী চর্চাকারীদের হাতে তুলে দেয়। আমার আশা “স্বল্পদৈর্ঘ্য”-র সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লবের প্রতিভা ও পরিশ্রম কখনো বৃথা যাবে না। যদিও প্রতীয়মান হয় যে নব্বই দশকের কবিদের মধ্যে ঝালাই বাছাই শুরু হয়েছে। কেউ লিখছেন কেউ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। তবু এই দশকটির প্রতি আমার আস্থা এখনো টলেনি। টলেনি যে, এর কারণ হলো, সাজ্জাদ বিপ্লবের মতো কবি প্রতিভা ও সম্পাদনা শক্তি পূর্ণভাবে এখনো সক্রিয় আছে। আমি সাজ্জাদ বিপ্লবকে অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কবিতা সৃষ্টির একধরনের উদ্যম হিসেবে গণ্য করে থাকি। তাদের মধ্যে বাংলা কবিতার অনুদ্ভাবিত অনেক বিষয় বা লক্ষ্মণ আমি সহসা দেখতে পাই। যদিও এখানে কোনো কবিতার নিয়ম তাদের দ্বারা পূর্ণাবয়ব পায়নি। কিন্তু প্রয়াসকে প্রতিভা হিসেবে গণ্য করতে হবে, যদি আমরা অস্বীকৃতির ঘোর কাটিয়ে কিছু প্রতিভাবান তরুণকে স্বীকৃতি দিতে চাই। 

আমার আগে শীর্ষস্থানীয় অগ্রজরা অনুজদের স্বীকৃতির সিঁড়িতে উঠতে দিতেন না কিন্তু আমি এই অন্যায় ঐতিহ্য হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত নই। সাজ্জাদ বিপ্লব দুটি কারণে তার জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। এক হলো –পরিচ্ছন্ন একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ; অন্যটি হলো তার নিজের কবিতা। তার কবিতায় রহস্য দানা বাঁধে। আকুল-অফুরন্ত কবিতার যে জগৎ রয়েছে, সাজ্জাদ বিপ্লব কখনো কখনো সেই দিগন্তের উন্মোচন ঘটান। তার কবিতায় আশান্বিত হওয়ার অনেক পঙক্তি থাকে। অন্যদিকে “স্বল্পদৈর্ঘ্য” পত্রিকাটি উত্তরবঙ্গের এমন একটি অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে (অবশ্য এখন ঢাকা থেকে)  –যা অনেক বৈরিতা সহ্য করে আজিজ মার্কেটে এসে ছিটকে পড়তেই আলোচনার সূত্রপাত হতো। আমি নিজে হাতড়ে হাতড়ে তা সংগ্রহ করে আনতাম। এমন একটি কাগজ আমাদের সাহিত্যে আছে বলে কবি হিসেবে আমি মনে মনে গর্ববোধ করতাম। আড়ম্বরপূর্ণ সাহিত্য পত্রিকায় বিদ্বেষ তাড়িত হয়ে প্রকাশিত হলে তা শূন্যগর্ভ বলে নি:শেষ হয়ে যায়।  কিন্তু “স্বল্পদৈর্ঘ্য” আড়ম্বরপূর্ণ পত্রিকা নয়। শূন্যগর্ভও নয়। একটি প্রকৃত বিবেকসম্পন্ন লিটল ম্যাগ। আর তার স্রষ্টা হলো একজন কবি, যার নাম সাজ্জাদ বিপ্লব। অনেক তথ্যসূত্র সাজ্জাদ বিপ্লবের জানা আছে। যে সব ঘটনা আমরা ভুলে যাই, সাজ্জাদ কখনো তা ভোলে না। আমি আমার হারিয়ে যাওয়া বা অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া বিষয় তার কাছ থেকে উদ্ধার করতে পেরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। এমন একজন মানুষকে লিখিতভাবে স্বীকৃতি না দিলে আমার মনে হয় আমার কবিধর্মে পক্ষপাত থেকে যাবে। আমি সাজ্জাদের কাছে শুনেছি, সাহিত্যের কাজ করতে গেলে কীভাবে মিত্ররাও শত্রুতে পরিণত হয়। আমি “স্বল্পদৈর্ঘ্য”-র ধৈর্যের প্রশংসা করি। একই সঙ্গে তার সম্পাদকের অফুরন্ত প্রাণশক্তির জন্য আমার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করি। কে মনে রাখবে একজন প্রতিভাবান তরুণ কোন অঞ্চল থেকে কীভাবে মননশীল সাহিত্যের লড়াইয়ে সামিল হয়েছিল। কিন্তু মানুষ তার কাজের মধ্যে যদি লবণ থাকে, তবে তা চেখে দেখবেই। সাজ্জাদ বিপ্লবের ” স্বল্পদৈর্ঘ্য” আমাদের সাহিত্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মনুষ্যত্ব ও বিবেকের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এটাই হলো তার সাহসের পরিচয়। রাজনীতি এ ধরনের তরুণকে দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারে না। সাজ্জাদকেও পারেনি। আমরা আশা করি না যে, “স্বল্পদৈর্ঘ্য”-র মতো লিটল ম্যাগ বাংলাদেশের ঝোঁপ-ঝাড় থেকে প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হবে। এর পেছনে ব্যক্তি প্রতিভার অসাধারণ সাহসী ভূমিকা থাকতে হয়। সাজ্জাদ দীর্ঘদিন ধরে এই সাহসী ভূমিকা পালন করে আমাদের আধুনিক সাহিত্যকে সহায়তা দান করছে। এজন্য আমি তাকে সাধুবাদ জানাই এবং স্বীকৃতি দান করতে সবাইকে আহ্বান জানাই।

২৪.১১.২০০৬

ঢাকা, বাংলাদেশ। 

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ