🍁
তৈমুর খান
🍁
‘আমার জন্মের দ্বি-শতবর্ষ পরে/কে তুমি পড়িছ বসি আমার কাব্যখানি কৌতূহল ভরে’ এমন কথা মাইকেল মধুসূদন দত্ত কখনো লিখে যাননি। শুধু লিখেছিলেন: ‘রেখো, মা, দাসেরে মনে এমিনতি করি পদে/ পুরাতে মনের সাধ/ ঘটে যদি পরমাদ/ মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে।’ অর্থাৎ অমরত্বের ইচ্ছা তাঁর মনেও উত্থিত হয়েছিল বলেই মধুহীন না করার আবেদন জানিয়েছিলেন তব মনঃকোকনদে।যে অমৃত পান করলে মৃত্যুর পরেও চিরপথের পথিক হওয়া যায় কবি সেই অমৃতই পান করেছিলেন। তাই দুশো বছর পরও গৌড়জন কবিকে ভোলেননি। যদি তিনি ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য লেখার পর আর অন্যকোনো কাব্য নাও লিখতেন, তবুও তিনি এই অমরত্বের গৌরবের অধিকারী হয়ে থেকে যেতেন। একটি মাত্র কাব্যই কালজয়ী সৃষ্টি হিসেবে চিরদিনের দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের দশটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নামের তালিকায় ‘মেঘনাদবধ’ও নির্দ্বিধায় জায়গা করে নিয়েছে। এর শ্রেষ্ঠত্বের অথবা গৌরবের দিকগুলি আমাদের কাছেও খুবই স্পষ্ট। ‘মেঘনাদবধে’র প্রুফ দেখার সময় মধুসূদন বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে বলেছিলেন: Will not this make me immortal? তিনি নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন এই কাব্যটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। ১৮৬১ সালে কাব্যটি প্রকাশিত হয়। কাব্যের অভিনবত্ব সে যুগের তুলনায় কতখানি অগ্রবর্তী ছিল তা ভাবা কঠিন। তখন প্রাচীন পয়ার দ্বিপদী-ত্রিপদীতেই কাব্য রচিত হত। অমিত্রাক্ষর ছন্দের জন্ম বাংলাতে হয়নি। সুতরাং এই কাব্য ভাষায়, ছন্দে, বিষয়বস্তুতে, উপস্থাপনা বা সূচনাতেও অভিনবত্ব নিয়ে এল। প্রগতিশীল ভাবনার মধ্যদিয়ে পাশ্চাত্য মানবিক চেতনা, যুক্তিবাদ, কল্পনা, দেশপ্রেম, দৃঢ়তা, শব্দ প্রক্ষেপণের তীব্রতা, চরিত্রগুলির ব্যক্তিত্বময়তা এবং কাপুরুষতা, সর্বব্যাপী জাতীয়তাবোধের সঞ্চার, বৃহৎ প্রেক্ষাপটে সর্বকালের মানুষের মধ্যে অনুকম্পা জাগানোর তীব্র এক ঘোরের জন্ম দিতে পারলেন। অন্যদিকে বাঙালির চিত্তবৃত্তির অনুকূল গীতিরস প্রবাহের দিকেও তিনি সঠিক খেয়াল রেখেছিলেন। তাই এই কাব্যটি রচনাকালে একখানি চিঠিতে লিখেছিলেন: I think I have a tendency in the lyrical way. কবি ব্যক্তিহৃদয়ের অনুভূতির কথা এই মহাকাব্যের চরিত্রের সঙ্গেই অর্থাৎ রাবণের সঙ্গেই সংযুক্ত করেছিলেন তা বলাই বাহুল্য। নিজের জীবনের যতই ভাঙচুর হয়েছিল, হতাশা ও ব্যর্থতা এসেছিল, তা রাবণের মধ্যদিয়েই দীর্ঘশ্বাসে রূপ নিয়েছিল। কবিমনের রোমান্টিক উপলব্ধির আবেগময়তা, শোকবিহ্বলতা, স্নেহকাতরতা, ক্রোধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ প্রকাশও সবই রাবণের মধ্যে দেখা যায়। পুত্রের মৃত্যুতে পীড়িত শোকব্যাকুল রাবণ যখন বলে ওঠেন: ‘ছিল আশা মেঘনাদ, মুদিব অন্তিমে এ নয়নদ্বয় আমি তোমার সম্মুখে’ তখন চিরন্তন হৃদয়ের বাণীটিই সর্বময় বেজে ওঠে। কবির সুপ্ত আত্মার কান্না এভাবেই রাবণের মধ্য দিয়ে বেজে উঠেছে।
কাব্য নির্মাণে কবির কতখানি ক্ষমতা ছিল তার পরীক্ষা দিয়েছেন এই কাব্যেই। ‘তিলোত্তম সম্ভব’ কাব্যে যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ নিয়ে প্রথম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন, ‘মেঘনাদবধে’ তারই চূড়ান্ত পরিচয়। বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে এ এক গভীরতর বাঁক্ পরিবর্তনের ধারা এখান থেকেই শুরু হয়েছিল। তার ফলেই আধুনিক কবিতা রচনার পথও প্রস্তুত হয়। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে প্রথমত আঙ্গিক গঠনেই উন্নততর শিল্পগুণের পরিচয় পাওয়া যায়। কাব্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় ভাবরস ও কল্পনারসের মধ্য দিয়ে। কাব্যের দেহ নির্মিত হয় সঠিক শব্দ ব্যবহারে। এই কারণেই প্রাচীন আলংকারিকরা বলেছেন ‘শব্দাথৌ সহিতৌ কাব্যম্।’ এখানে শব্দ ও অর্থ সুন্দর ও সুসামঞ্জস্যভাবে ফুটে ওঠে। আর এই কাজটা সুসম্পন্ন করতে পারেন একমাত্র প্রতিভাধর ব্যক্তিরাই। মধুসূদন দত্ত ছিলেন খুবই শব্দ সচেতন। তাই ভাবকে জীবন্ত করার জন্য একটা শব্দের বহু প্রতিশব্দ ব্যবহার করেছেন। কোথাও কোথাও ব্যাকরণের ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে নিজেই নতুন শব্দ সৃষ্টি করেছেন। কাব্যটি পড়তে পড়তে যেমন উপমাস্য কাব্যম্ মনে হবে, তেমনি শব্দের রত্নভাণ্ডারও মনে হবে। প্রিয়পুত্র বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে প্রাসাদ শিখরে উঠে রাবণ যখন চারিদিক নিরীক্ষণ করতে লাগলেন তখন দেখলেন চারিদিকে শ্রীলঙ্কার রূপ। এই অংশটির বর্ণনা এরকম:
“উঠিলা রাক্ষসপতি প্রাসাদ-শিখরে,
কনক-উদয়াচলে দিনমনি যেন
অংশুমালী।চারিদিকে শোভিল কাঞ্চন-
সৌধ-কিরিটিনী লঙ্কা— মনোহরাপুরী!
হেমহর্ম্য সারি সারি পুষ্প বন মাঝে;
কমল-আলয় সরঃ; উৎস রজঃছটা;
তরুরাজী; ফুলকুল—চক্ষুঃ বিনোদন,
যুবতী যৌবন যথা; হীরাচূড়শিরঃ
দেবগৃহ;নানারাগে রঞ্জিত বিপণি,
বিবিধ রতন-পূর্ণ;”
রাবণ যেন দিনমণির মতো অংশুমালী। চারিদিক শোভিত করে আছেন। পুষ্পবনে কমল-আলয়ের মতো সারি সারি হেমহর্ম্য। ফুলকুল যুবতীযৌবনের মতো চক্ষু বিনোদন করছে। নানারাগে রঞ্জিত হয়েছে দোকানগুলিও।
আবার নিষ্কুম্ভিলা যজ্ঞগৃহের দরজায় ইন্দ্রজিৎ পাহারারত তার কাকা বিভীষণকে দেখে বলেন:
“হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে
কে তুমি? জনম তব কোন্ মহাকুলে?
কে বা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে
করে কেলি রাজহংস পঙ্কজ-কাননে
যায় কি সে কভু, প্রভু, পঙ্কিল সলিলে,
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্রকেশরী,
কবে, হে বীর কেশরী, সম্ভাষে শৃগালে
মিত্রভাবে?”
রাক্ষস বংশ মর্যাদার গরিমা বোঝাতেই এবং বিভীষণের কাপুরুষোচিত ব্যবহারে রাজহংস এবং মৃগেন্দ্রকেশোরীর সঙ্গে পঙ্কিল সলিল এবং শৃগালের তুলনা করা হয়েছে। সমগ্র কাব্যজুড়েই উপমা প্রয়োগের অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় আছে। প্রতিটি বিষয়েই তিনি উপমা দিয়েছেন। বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে রাবণের কাছে দূতের বারতা ‘নিশার স্বপন সম’ মনে হয়েছে। বীরবাহুর বীরত্ব যা রামের সঙ্গে তুলনাই করা যায় না। সেটাই বোঝাতে বলেছেন: ‘ফুলদল দিয়া কাটিলা কি বিধাতা শাল্মলী তরুবরে?’ বিরহিণী প্রমীলা যখন চঞ্চল হয়ে উঠেছেন তখনকারও বর্ণনা এরকম:
“কভু বা মন্দিরে পশি, বাহিরায় পুনঃ
বিরহিণী, শূন্য নীড়ে কপোতি যেমতি
বিবশা।”
আবার প্রমীলার সখী নৃমুণ্ডমালিনী রামচন্দ্রের শিবিরের সম্মুখে উপস্থিত হলে তাকে দেখে বিভীষণ বলছেন:
“চেয়ে দেখ রাঘবেন্দ্র, শিবির বাহিরে।
নিশীথে কি ঊষা আসি উতরিলা হেথা?”
কত কত উপমা ছড়িয়ে আছে। কবির সৌন্দর্য পিপাসার গভীর সম্পর্ক রয়েছে প্রতিটি উপমার মধ্যে। জিজ্ঞাসার উল্লেখের মধ্যেই বিস্ময়কর ভাবের প্রশ্রয়ও কবি জাগিয়ে তুলেছেন।
শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময়ে তিনি সমার্থক শব্দ অন্বেষণ করেছেন। কখনো ছন্দের কারণে, কখনো একঘেয়েমি দূর করার জন্য। আবার কাব্যের গাম্ভীর্য বজায় রাখতেও শব্দার্থের গুরুগম্ভীর রূপটি আনার চেষ্টা করেছেন। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। সর্প শব্দের বহু সমর্থক শব্দগুলি এই কাব্যে খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন: ভুজঙ্গ, ভুজগ, আশীবিষ, চক্রী, কাকোদর, ফণী,উরগ, পন্নগ, ভোগী প্রভৃতি শব্দ খুব সহজেই ব্যবহার করেছেন। অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহারের পথটি তিনিই দেখিয়েছিলেন। তাঁর ব্যবহৃত অপ্রচলিত শব্দগুলির মধ্যে কয়েকটি হল:অররু, আহব, আনায়, ইরম্মদ, কলম্ব, গরুত্মতী, তিষাম্পতি, প্রচেতা, বীতিহোত্র, লম্বা, যাদঃপতি, সাদী, নিষাদী, স্যন্দন, হর্ষক্ষ প্রভৃতি শব্দগুলির ব্যবহার নেই বললেই চলে, তবু তা ব্যবহারের ফলে সাহিত্যে চমৎকারিত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে । নামধাতু প্রয়োগ করে ক্রিয়াপদকে সংক্ষিপ্ত করেছেন। ‘ইল’ বা ‘ইলা’ প্রত্যয় যোগ করে শব্দের নবরূপায়ন ঘটিয়েছেন। যেমন, উত্তরিলা- উত্তরিল, কহিলা-কহিল, চলিলা- চলিল, নামিলা-নামিল, সৃজিল-সৃজিলা। এভাবেই প্রভাতিল, বৃষ্টিল, শান্তিল, প্রফুল্লিল, আরম্ভিল, সমরিল প্রভৃতি। আবার ‘ইয়া’ ও ‘ইয়ে’ যোগেও এভাবেই শব্দ গঠন করেছেন। যেমন নিকটয়ে, গ্রাসয়ে, উলঙ্গিয়া, আছয়ে, করয়ে, উথলিয়া, দোলাইয়ে, গরজিয়ে ইত্যাদি বহু শব্দ। প্রচলিত কথনরীতির শব্দ ব্যবহার করেছেন তৎসম শব্দের পাশাপাশিও। যেমন দেখিনু, করিনু, বলিনু, ধরিনু ইত্যাদি। যুগ্মপদ সৃষ্টি করেও শব্দের নতুনত্ব এনেছিলেন। যেমন কেশব-বাসনা, রাঘব-বাঞ্ছা, গোধূলি-ললাট, খদ্যোতিকাদ্যুতি, কনক-আসন, কেশরি-কিশোর, ক্রোড়নীড়, কুসুম-কুন্তলা-মহী, তারা-গাঁথা-সিঁথি, রতন-সম্ভব-বিভা, সৌরকররাশি, বাসন্তানিল ইত্যাদি। চিত্রকল্প সৃষ্টিতেও মধুসূদন সকলকে ছাড়িয়ে গেছেন। যেমন: উড়িল কলম্বকুল অম্বর প্রদেশে, শত শত অগ্নিরাশি জ্বলিছে চৌদিকে ধুমশূন্য, ইরম্মদাকৃতি বাঘ ধরিল মৃগীরে, নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি, অগ্নি দ্রবি শিলাকুলে অগ্নিময় স্রোতে/ আবরি গগন ভস্মে, পুরি কোলাহলে/ চৌদিক!, তমোময় যমদেশে অগ্নিস্তম্ভ সম/ জ্বলি উজ্জ্বলিবে দেশ ইত্যাদি। ব্যাকরণের তোয়াক্কা না করেই ধন্যাত্মক শব্দ প্রয়োগও মধুসূদনের একটা কৃতিত্ব। বরুণের স্ত্রী বারুণানী শব্দটি না ব্যবহার করে তিনি লিখেছেন বারুণী। এভাবেই তিনি গায়কী, নায়কী, অন্তরিত, নিকষও ব্যবহার করেছেন। সরাসরি তিনি জানিয়ে দিয়েছেন: The name is বারুণানী, but I have turned out one syllable. To my ears this word is not half so musical as বারুণী, and I don’t know why I should bother myself about Sanskrit rules. মধুসূদনের এই দেখানো পথ ধরেই সাম্প্রতিক কালের কবিদের শব্দ ব্যবহারেও পরিবর্তন এসেছে। শ্রুতিমধুর ভাবগর্ভ ও ওজস্বিতায় আজকের সাহিত্য অনেকটাই অগ্রসর হতে পেরেছে।
মধুসূদন ‘মেঘনাদবধ’ এর কাহিনি চয়ন করলেন রামায়ণ থেকে যা ভারতীয় মহাকাব্য, কিন্তু কাব্য নির্মাণ করলেন গ্রিক মহাকাব্যের প্রজ্ঞা থেকে। স্বাভাবিকভাবেই গ্রিক পুরাণের বাঙালিয়ানা ঘটল। কিন্তু সেই সঙ্গে বর্তমান সমাজজীবনকে তিনি বাদ দিলেন না। প্রতিটি বিষয় উত্থাপন ও বর্ণনা প্রসঙ্গে উপমাগুলিকে যেভাবে প্রয়োগ করলেন তা কতখানি নিখুঁত ও বাস্তব মানবজীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তা তিনি জানতেন। তিলোত্তমার গাম্ভীর্যের সঙ্গে ব্রজাঙ্গনার কোমলতাও নিয়ে এলেন এই কাব্যে। নিসর্গ-আকাশ, সমুদ্র-ভূধর, অরণ্য-নদী, পাতাল-সমতল সবই তাঁর বর্ণনায় উঠে এল। যে রাম দেবতা, বিশ্বের মানুষের কাছে ত্রেতা স্বরূপ, যাঁর হুকুমে সবকিছুই হওয়া সম্ভব— সেই রামকেই মনুষ্যচরিত্রে রূপায়িত করলেন। তাঁর ঈশ্বর নির্ভরতা, কাপুরুষতা, কূটকৌশলী হিংসাশ্রয়ী হওয়াও তাঁর চোখে ধরা পড়ল। নিষ্কুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণ কাপুরুষোচিতভাবে ইন্দ্রজিৎকে হত্যা করেছে। রামচন্দ্র বারবার ইন্দ্রজিতের কাছে পরাজিত হয়েও দেবমহিমায় প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। ভৈরবরূপিণী বামা সৈন্যদের দেখে ভীত হয়েছেন। বিভীষণ এর কাছে বলেছেন:
“শুভক্ষণে রক্ষোবর পাইনু তোমারে
আমি। তুমা বিনা, মিত্র, কে আর রাখিবে
এ দুর্বল বলে, কহ, এ বিপত্তিকালে?
রামের চির-রক্ষণ তুমি রক্ষঃপুরে;”
রামকে তখন দেবতা বলেই মনে হয় না। প্রমীলার দূতীকে দেখেও হৃদয়ে তাঁর ভয়ের সঞ্চার হয়। সে-কথাও বিভীষণকে জানান:
“দূতীর আকৃতি দেখি ডরিনু হৃদয়ে
রক্ষোবর! যুদ্ধসাধ ত্যজিনু তখনি!”
রাম যে অনেকটাই নিষ্প্রভ তা বলাই বাহুল্য। অপরদিকে ইন্দ্রজিৎ বীর যোদ্ধা, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে সবাই তার কাছে পরাজিত হয়েছেন। দেশপ্রেমিক হিসেবেও তার তুলনা নেই। আবার পিতার প্রতিও একান্ত অনুগত পুত্র। বীরাঙ্গনার উপযুক্ত স্বামীও। তার বীরত্ব, হুংকার, ক্ষমতা সকলকেই বিস্মিত করে। তাই কৌশলী লক্ষ্মণের হাতে মৃত্যুবরণ করেও সকলের অন্তরে সহানুভূতি আদায় করে নেয়। লক্ষ্মণ দেবঅস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাকে হত্যা করে। নিজ ক্ষমতার জোরে নয়, একথাও স্পষ্ট হয়। সুতরাং ইন্দ্রজিতের বীরত্বের গরিমা favourite hero হিসেবে গড়ে ওঠে। লক্ষ্মণ ও রামের প্রতি তৈরি হয় বিমুখতা। কাব্যের ঔচিত্য ভেঙে দিয়ে তিনি এক নতুন অভিমুখ দান করলেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দে বীরত্বের উদাত্ত, গাম্ভীর্য চমৎকার ফুটে উঠল। ইন্দ্রজিৎ-পত্নী প্রমীলার বীরাঙ্গনা রূপও আশ্চর্য দীপ্তি পেল। যখন সে স্বামীর খোঁজে বানরসেনার চক্রব্যূহ ভেদ করতে চায়, তা শুনে তার সখী বাসন্তী বলে:
“অলঙ্ঘ্য সাগর-
সম রাঘবীয় চমূ বেড়িছে তাহারে!
লক্ষ লক্ষ রক্ষঃ-অরি ফিরিছে চৌদিকে
অস্ত্রপাণি, দণ্ডপাণি দণ্ডধর যথা।”
এর উত্তরে প্রমীলা দৃঢ়চিত্ত অবিচল থেকেই জানায়:
“কি কহিলি, বাসন্তী? পর্বত-গৃহ ছাড়ি
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
দানবনন্দিনী আমি;রক্ষঃ-কুল-বধূ,
রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,—
আমি কি ডরাই, সখি, ভিখারী রাঘবে?
পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভুজ-বলে;
দেখিব কেমনে মোরে নিবারে নৃমণি?”
এখানেই নারীর স্বাধিকার ঘোষণা। একদিকে প্রেমের মাহাত্ম্য, অন্যদিকে যুদ্ধের অঙ্গনে পদার্পণ। নারীর আপন ভাগ্য জয় করার স্বপ্ন তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন। বীরাঙ্গনা কাব্যের এগারোটি পত্র রচনার মধ্য দিয়েও নারী তার আত্মমর্যাদা এবং অধিকার ঘোষণা করেছে। বীর স্বামীর বীরাঙ্গনার রূপও যে যথাযথ মধুসূদন আঁকতে পেরেছেন তার বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এই কাব্য। নারীর হৃদয়বৃত্তির সঙ্গে এই রণ-সাজেরও সংযোগ ঘটেছে। তাই কোথাও অস্বাভাবিক এবং বাহুল্য বলে মনে হয়নি। এই কাব্যে রাবণের পিতৃহৃদয়ের পরিচয় যেমন আছে, তেমনি আছে প্রজাবৎসল শাসকের পরিচয়ও। তিনি কতখানি দায়িত্বশীল এবং স্নেহকাতর তা-ই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চিত্রাঙ্গদা যখন একমাত্র পুত্র বীরবাহুর মৃত্যুর অভিযোগ জানালেন। রাবণ তখন অন্তরে শোক রেখেও চিত্রাঙ্গদাকে বললেন, জন্মভূমি রক্ষার্থে যে পুত্র প্রাণ দিয়েছে সেই পুত্রের বীরমাতা তুমি। কখনোই কাঙালিনী নয়। সব অভিযোগ খণ্ডন করে জানিয়ে দিলেন:
“এক পুত্রশোকে তুমি আকুলা, ললনে,
শত পুত্রশোকে বুক আমার ফাটিছে
দিবানিশি!”
শতপুত্র বলতে রাবণ তার প্রজাদের কথাই বলতে চেয়েছেন, যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। তাই বীরকর্মে হত পুত্রের জন্য ক্রন্দন করা উচিত নয়। এই প্রবোধ দেবার পরও এই মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তিনি কঠিন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বলেছেন:’অরাবণ অরাম বা হবে ভব আজি!’ রাবণের এই হাহাকার বৃহৎকালের জাতীয় আবেগের প্রেক্ষাপটকেই ধারণ করেছে। সর্বযুগের চিরন্তন পিতৃহৃদয়ের স্বরূপই ফুটে উঠেছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার উদ্দেশ্যে প্রিয়পুত্রের লাশের সঙ্গে যখন রাবণ যাত্রা করলেন, তখনকার সেই করুণ বর্ণনাটিও সর্বযুগের মানুষকেই স্পর্শ করে:
“বাহিরিলা পদব্রজে রক্ষঃকুল রাজা
রাবণ;—বিশদ বস্ত্র, বিশদ উত্তরী,
ধুতুরার মালা যেন ধূর্জটির গলে;—
চারিদিকে মন্ত্রিদল দূরে নতভাবে!
নীরব কর্ব্বূরপতি, অশ্রুপূর্ণ আঁখি,
নীরব সচিববৃন্দ, অধিকারী যত
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ।”
এই মহাযাত্রায় পুত্রহারা রাবণের মহাশোক চিরন্তন হয়ে ওঠে। তাঁর জীবনের ট্রাজেডিকে আরও ঘনীভূত করে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি grandfellow হয়ে উঠলেন। রাবণ ভাগ্যবিড়ম্বিত স্বজন হারানো মহামানব হয়েই এই কাব্যে চিত্রিত হলেন। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের হৃদয়ে তিনি ঠাঁই পেলেন। সহানুভূতিতে মহিমান্বিত হলেন। মধুসূদন এখানেই সিদ্ধিলাভ করলেন। যে রাবণের প্রতি মানুষের বিমুখতা ছিল, সহজেই তার অবসান হল। কাব্যের শেষ পংক্তিটি লিখতে গিয়ে মধুসূদন লিখেছেন:
“করিস্নান সিন্ধুনীরে, রক্ষোদল এবে
ফিরিলা লঙ্কার পানে, আর্দ্র অশ্রুনীরে—
বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে!
সপ্ত দিবানিশি লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে॥”
রাষ্ট্রীয় তথা জাতীয় শোক ঘোষণার মধ্যদিয়েই এই পরিসমাপ্তিতে ব্যাপ্তিময় পরিসরের সঙ্গে অন্তহীন অবিনশ্বরতাও উঠে এসেছে। যখনই কাব্যটি পাঠক পাঠ করবেন, তখনই তিনি আলোড়িত হবেন। এই হৃদয়ের অভিমুখ, এই অন্তহীন আবেগের আবেদন কখনোই শেষ হবে না, কখনোই তা পুরনো হবে না । মানবসভ্যতার হৃদয় কারবারিরা কখনোই একে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন না।
লিটারারি এপিক বা সাহিত্যিক মহাকাব্য হিসেবেই বাংলা সাহিত্যে এটি একটি মাইলস্টোন হিসেবে বিরাজ করবে। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের পর এবং রবীন্দ্রনাথের পূর্বে বাংলা সাহিত্যের গৌরব হিসেবে চিরদিনই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শুধু কাব্য নির্মিতিতেই নয়, মানবীয় প্রজ্ঞা ও আবেগের কাছে এবং রাষ্ট্রধর্মের কাছেও যে বিস্ময় নিয়ে এর আবির্ভাব তা কখনোই বিস্মৃত হওয়ার নয়। লঙ্কাপুরীতে যখন ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। ইন্দ্রজিতের মৃতদেহ সৎকার হবে, সম্রাট রাবণ তখন রামচন্দ্রের শিবিরে দূত পাঠালেন:
“রুক্ষঃকুলনিধি
রাবণ, হে মহাবাহু, এই ভিক্ষা মাগে
তব কাছে, তিষ্ঠ তুমি সসৈন্যে এদেশে
সপ্ত দিন, বৈরিভাব পরিহরি, রথি!”
পুত্রশোকে কাতর রাবণের এই প্রস্তাবে রামচন্দ্র রাজি হলেন। একই সময়ে সরমার মুখে ইন্দ্রজিতের মৃত্যু সংবাদ এবং ইন্দ্রজিতের চিতায় প্রমীলার সহমরণের কথা শুনে অশোকবনে সীতাও কাতর হয়ে পড়লেন। রাক্ষস বংশের বিনাশ ও দুর্গতিতে নিজেকেই দায়ী করে বললেন:
“কুক্ষণে জন্ম মম সরমা রাক্ষসি;
সুখের প্রদীপ সতি, নিবাই লো সদা
প্রবেশি যে গৃহে, হায় অমঙ্গলারূপী
আমি।পোড়া ভাগ্যে এই লিখিলা বিধাতা।”
কাব্যের প্রতিটি চরিত্রের মধ্যেই এই মানবিক রসের আয়োজন অফুরন্ত হয়ে উঠেছে যার উৎস মূলে রয়েছে প্রসন্ন হৃদয়ের স্বচ্ছধারা। কাব্যনির্মিতিতে পাশ্চাত্য প্রভাব গ্রহণ করলেও হৃদয়ের আবেদনকে মধুসূদন পাল্টাতে চাননি। মহাকাব্যের বিশাল হর্ম্যের মধ্যে তাই মানব জীবনের গুঞ্জনকে প্রতিস্থাপন করেছেন। ‘গাহিব মা বীররসে ভাসি মহাগীত’ বলে শুরু করেও অশ্রুসাগরের তরঙ্গকে এড়াতে পারেননি। তাই বাংলা সাহিত্যের গৌরব হয়েই এই কাব্য বিরাজ করছে। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাই কবিতায় লিখেছিলেন:
“যাও তবে, কবিবর! কীর্তি রথে চড়ি
বঙ্গ আঁধারিয়া,
যথায় বাল্মীকি, ব্যাস, কৃত্তিবাস,কালিদাস
রচিয়াছে সিংহাসন তোমার লাগিয়া।
যে অনন্ত মধুচক্র রেখেছ রচিয়া
কবিতা ভাণ্ডারে;
অনন্তকালের তরে, গৌড়-মন-মধুকরে
পান করি, করিবেক যশস্বী তোমারে।”
একথা আজও সত্য। মহাকবির সারিতে মধুকবিও ঠাঁই করে নিয়েছেন।
🐦