spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যশাহীন রেজা'র কবিতা : চার কবি'র আলোচনা

শাহীন রেজা’র কবিতা : চার কবি’র আলোচনা

১. যাও

যাও তবে এ যাওয়া দীর্ঘ করো না

নদীর ফুল বাতাসের পাখি আর রৌদ্রের ঘ্রাণ
চলে গেলে ফিরে আসে না

কবিরা যেতে চায় না এমন কি
ফিরে আসার সুযোগ থাকলেও–

সৌমিত তো বলেই দিয়েছে,
হুস বললেই কি উড়ে যাওয়া যায়?

না যায় না,
আর যায় না বলেই আমরা বসে থাকি
একটি টিলায় জলভাঙ্গা সময়ে
শুনি নির্জন হরিণের ডাক; পেঁচা এবং কোয়েলের

ভীষণ অন্ধকার
জলের মত রাত নামছে
তোমার বগল থেকে ভেসে আসা রিভাইভ
আমাকে নিয়ে যাচ্ছে সেই আদিম আন্দিজে
ঈগলের মত দ্রুত পালাচ্ছে সময়
আমি কি যাব হে কাহ্নপা
তোমার কালে
বিদ্ধ হতে এক অলৌকিক সুচে?

যাও, তবে ফিরে আসার দরোজাটা
খুলে রেখ।
২৪.০৬.২০২২

২. বাবা

একচিলতে বারান্দায় বিকেলের কৌণিক রোদে দেবদারুর যে দীর্ঘ ছায়া, সে আমার বাবা

বাবারা চিরকালই বৃক্ষ, নদী এবং ছায়া
বাবার চশমায় ধুলো জমা মানেই সামনে ধূসর

বাবা যেদিন নক্ষত্র হতে হতে তাঁর বুক পকেটে জমিয়ে রাখা তামার মুদ্রাগুলো ছুঁড়ে দিলেন রূপালি রৌদ্রের কাছে, সেই থেকে পুড়তে পুড়তে বেঁচে থাকাই আমার স্বভাব

বাবার ছায়া দীর্ঘ হতে হতে আকাশ ছুঁলে , আমি ঠিক বুড়ো বটের নীচে একটি শূন্যলতা হয়ে উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে দেব ডাহুক ভোরের দিকে।

৩. কোনো এক আমার সকাল
(চে গুয়েভারার জন্মদিনে)

বারুদের কালি দিয়ে এঁকে রাখা দাগগুলো মোছেনা কখনো,
বাতাসের কী এমন শক্তি বল পাইনের পাতা থেকে খসায় শিশির ?

তোমাকে ভোলেনি আজও সেইসব পথগুলো, চুরুটের গন্ধ মাখা রাত আর পাহাড়ের বুকচিরে মাতালের ঘ্রাণ শুঁকে ছুটে চলা নেকড়ের দল।

একই গল্প ছোঁয়া পিচ্ছিল দেহগুলো আজও তোমাকে ডাকে। স্বপ্নের শেষ নেই; হৃদয়ের দিনগুলো যেন হাঁস; অনন্ত ভেড়ার দলে কেউ কেউ রুখে ওঠে; তোলে মাথা যেন ক্রুদ্ধ ঈগল।

অগুনতি নদী শেষে এখনও কেমন রুদ্র স্মৃতির স্রোতেরা ; আজও চাঁদেরা নাচে, পাখিগুলো মেঘ হয়, অবারিত রাতের বেহালা।

তোমার ছায়ার নীচে ক্রমাগত বেঁচে থাকে কোনো এক আমার সকাল।

সমালোচনা:

১. ভাস্কর চৌধুরী

কবিতা তিনটি কয়েকবার পড়লাম। ভালো লাগলো।
বাবা সম্পর্কিত কবিতাটি পড়তে গিয়ে বাবার পূর্ণ অবয়ব পেলাম।
চে গুয়েভারা কবিতাটিও ঠিক চে এর একটি আদল চোখে ভাসলো।
সহজ সুন্দর মেদহীন বর্ণনা। সীমিত সমাপিকা ক্রিয়ার ব্যবহার কবিতাকে সুন্দর করেছে।
কবি শব্দের ভেতর ও পংতির ভেতর গ্যাপের ব্যবহার নিপুণ ভাবেই করেছেন।
কবিকে অভিনন্দন।

২. কাজী জহিরুল ইসলাম

আজ সারাদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। তাই দেরী হলো। ৩টি কবিতায় মোটের ওপর ভালো লেগছে। বাবা খুব ভালো লেগেছে। শূন্যলতা কেন? এটা আমি বুঝিনি। শেষ কবিতায় “সেইসব পথগুলো” এই দুটো বহুবচন একসাথে রাখবেন কিনা ভেবে দেখতে পারেন।

৩. ফরিদ আহমদ দুলাল

আমি পিছিয়ে পড়লাম। সাধারণ সময়ে ব্যস্ততায়ও নিশ্চয়ই পিছিয়েই পড়তাম। এখন অবকাশের আলস্যে পিছিয়ে পড়ছি; তাই ভাবছি নিজেই গুটিয়ে নিই নিজেকে এই ‘পিচ্ছিল পথে চলা’ খেলা থেকে। @শাহীন রেজা র কবিতার পর @Rahima Akhter Kalpana র কবিতাও উপস্থাপিত হয়ে গেল; আমি কারও কবিতার কথাই বললাম না! মনে হয় শাহীন সেভাবে আলোচিত হলেন না; আমি আপাতত শাহীনের কবিতা ত্রয়ে চোখ রাখি; পরে নিশ্চয়ই কল্পনার কবিতা নিয়েও কথা বলার ইচ্ছা রাখি; তাঁর কবিতা নিয়ে কিছু না বলা আমার জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে।
শাহীনের তিনটি কবিতা > যাও, বাবা এবং কোন এক আমার সকাল; তিনটি কবিতাই আমার পড়া, আগেই পড়া; এখনে পুনর্বার পড়লাম। @Vashkar Chowdhury এবং @কাজী জহিরুল ইসলাম দু’জনে মন্তব্যই যথাসময়ে পড়েছি। ‘শুধু কবিতার সমালোচনা’ গ্রুপ বিচারে দু’জনের মন্তব্যই ‘দায়সার’ গোছের মনে হয়েছে! হ্যাঁ, শাহীন তাঁর সময়ের অগ্রসর কবি, ওঁর নামটি আমি অনেকের মুখে শ্লাঘার মতো উচ্চারিত হতে শুনি; সুতরাং শাহীনের কবিতার সমালোচনা করতে কিছুটা প্রস্তুতি চাই বৈকি। সৌমিত জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গে “তিনি একেবারে আত্মমর্যাদাহীন ছিলেন।” এমন মন্তব্য যতটা সহজে করতে পারলেন, শাহীন প্রসঙ্গে এমন সরল মন্তব্য করার সুযোগ নেই। ভাববেন না কেউ, ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি; সবটাকেই যথাসময়ে শাহীনের কবিতার সাথে জুড়ে দেবো।
@শাহীন রেজার তিন কবিতার কোনোটিই বিশেষ ছন্দের শৃঙ্খলে বন্দী নয়; আমি ধরেই নিচ্ছি, ছন্দ জানলেও শাহীন এখানে ছন্দ অমান্য করার চেষ্টাই করেছেন। ‘যাও’ নামের রোমান্টিক কবিতাটিতে ‘কাহ্নপা’ থেকে ‘সৌমিত’ পর্যন্ত উদ্ধৃত হয়েছেন। বন্ধুকৃত্যকে আমি সম্মান জানাতেই চাই, প্রয়োগ যদি শাহীনের পাঠককে বিভ্রান্ত করে, সেটি তো শাহীনকেই লক্ষ রাখতে হবে। তাঁর পাঠকেরা সবাই তো তাঁর বন্ধুসীমায় আবদ্ধ নন। প্রথম এই রোমান্টিক ঘরানার কবিতাটি বিশেষ কোন ছন্দে লেখা না হলেও এর প্রবহমানতা আমায় মুগ্ধ করেছে। কতো সহজেই ‘রিভাইভ’ (আমি নিশ্চিত নই, হয়তো কামোদ্দীপক কোন সুগন্ধির নাম হবে) আমাকে টেনে নিতে চাইলো।
দ্বিতীয় কবিতা ‘বাবা’ আবেগের বেরোমিটারকে নাড়িয়ে দেবার মতো বিষয়ভিত্তিক একটি কবিতা। কবিতাটিতে শাহীন চারটি চরণে এগারোটি পঙক্তিতে বাবা সম্পর্কে নিজের অনুভবটি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। যতিচিহ্ন ব্যবহারে অনীহা কি কিছু ইঙ্গিত করছে? কবিতায় তিনি যতিচিহ্ন ব্যবহার করেননি তেমন তো নয়; তাহলে প্রথম তিনটি চরণ শেষে যতিচিহ্ন ব্যবহার না করার কী কারণ। কবিতাটিতে প্রচলিত ছন্দ না থাকলে মুন্সিয়ানা আছে। চার চরণের তিনটিই এক বাক্যে উচ্চারিত। দ্বিতীয় চরণে দু’টি বাক্য হলে প্রথম পঙক্তি শেষে যতি ব্যবহার না করে দ্বিধায় ফেলেন। তৃতীয় চরণে চার পঙক্তির একটি বাক্য। কী চমৎকার গতিময়। বাক্যটির প্রবহমানতা বুঝতে, বেশ ক’বার কবিতাটি পড়েছি; আমার মনে হয়েছে, প্রথম পঙক্তির ‘তাঁর’ শব্দটি দু’টি কারণে আমার দম কেড়ে নিচ্ছে; প্রথমত ‘তাঁর’ পরিহার করা হলেও বুঝে নিতে কোন ঘাটতির জন্ম হয়না; দ্বিতীয়ত, শব্দটি পরিহার করা গেলে প্রবহমানতার বাধাটিও অপসারিত হয়ে যায়। তৃতীয় চরণের তৃতীয় পঙক্তিতে ‘ছুঁড়ে’ শব্দটিতে চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার না করাই শ্রেয়; দয়া করে বাংলা একাডেমির অভিধানের উদ্ধৃতি দিয়ে কেউ বলবেন না, “বাংলা একাডেমি ‘ছুঁড়ে’ ‘ছুড়ে’ দুটোকেই বৈধতা দিয়েছে।” অধিক প্রচলিত বিধায় ভুলকেও মান্যতা দেয়া আর শুদ্ধতা ভিন্ন কথা। কাচ-এ চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহারও সঠিক নয়। শেষ চরণেও ‘ছুঁড়ে’ শব্দের প্রয়োগ আছে। তবে ‘শূন্যলতা’ নিয়ে @কাজী জহিরুল ইসলাম যে প্রশ্ন তুলেছেন, আমি তাঁর সাথে ভিন্নমত পোষণ করে বলতে চাই, বটের যে আকশিগুলো ঝোলে, আপাত দৃষ্টিতে তাকে শূন্যলতা বলেই মনে হয়; সে বিবেচনায় শূন্যলতা যেতেই পারে। কিন্তু ‘উড়ন্ত চুম্বন ছুড়ে দেব ডাহুক ভোরের দিকে।’ জানি না ডাহুক ভোর বলতে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন; ভোরকে বিশেষায়িত করতে চাইলে, বাবার সাথে মিল, তা জানা প্রয়োজন। কবি নিজে যদি ব্যাখ্যা দিতেন, উপকৃত হতাম।
তৃতীয় কবিতাটিকেও আমি চে বিষয়ক রোমান্টিসিজম মনে করি। চে বিষয়ক কবিতা সম্পর্কে আমার আলাদা করে কিছু বলার আগ্রহ আছে। সময়-সুযোগে বলতে চেষ্টা করবো।
খ্যাতিমান কবির কবিতা নিয়ে কথা বলতে যতটা সতর্কতা প্রয়োজন, তা আমি প্রয়োগ করিনি। সরাসরি এখানেই লিখলাম। ভুল হয়ে গেলে আমার পক্ষে তা সংশোধনের সুযোগ নেই। আমার চোখে ধরা পড়লে ফুটনোট লিখে দেবো। সরাসরি লিখলাম, এই বিশ্বাসে, শাহীন আমার প্রীতিভাজন অনুজ, ভালোবাসার স্বজন।

৪. রেজাউদ্দিন স্টালিন

আমি চেষ্টা করছি সবার কবিতা পড়ার। সবার কবিতা আলোচনা করা একটু কঠিন।আমি ভালোলাগলে আমার মতামত দিচ্ছি।এখানে প্রবন্ধ লেখার কোনো ইচ্ছে নেই।বরং আমার ভালোলাগা মন্দলাগার বিষয়টা যৌক্তিকভাবে
বলার চেষ্টা করছি।তাতে অনেকে
অসন্তুষ্ট হতে পারেন কিংবা আনন্দিত।
আমার কবিতা নিয়ে যারা কথা বলেছেন তার মধ্য বেশ যুক্তি আছে।আমি অবনত চিত্তে তা গ্রহণ করেছি।দিলারা হাফিজ -প্রাচীন – শব্দের বদলে- মলিন – শব্দ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন।আমি সেটা সানন্দে গ্রহণ করেছি।এধরনের আলোচনা থেকে লাভ হয় গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে।
আমি শাহিন রেজার কবিতা আলোচনার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।ওর তিনটি কবিতা-
১/যাও
২/ বাবা
৩/ কোনো এক আমার সকাল

কবিতা তিনটি বিষয়বস্তুতে ভিন্ন কিন্তু আঙ্গিক প্রকরণে প্রায় এক।তবে শাহীনের ভাষা স্বতঃস্ফূর্ত ও পেলব।
“যাও তবে এ যাওয়া দীর্ঘ করো না”
এই উচ্চারণটি- যাও-কবিতার আরম্ভকে তীব্রতা দিয়েছে।কবিতাটি
এগুচ্ছিলো একটা অনপেক্ষতা নিয়ে
হঠাৎ সৌমিত এসে পড়ায় কবিতা
তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি বরং আড়ষ্টায় আপ্লুত হয়েছে।কবির কাজ
কবিতায় ব্যবহৃত চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে চিত্রিত করা।ক্রোচে
বলছেন অবিশ্বাসকে স্থগিত করার ক্ষমতা হলো শিল্পের শক্তি।যাও
কবিতাটি এসব বাদে একটি ভালো
কবিতা।বাবা- কবিতায় উড়ন্ত চুম্বন ভালো লাগেনি।উপমা নির্মাণে মতোর
ব্যবহার কমিয়ে আনা আধুনিক কবিতার প্রকৌশল। এছাড়া বাবা ভালো।চে গুয়েভারাকে নিয়ে তৃতীয় কবিতাটি ভালো।বারুদের কালি দিয়ে
লেখা মোছে না।তবে একুশ শতকের
চে- কে আঁকলে আরো তাৎপর্য পেতো।শাহিনের প্রতি শুভেচছা।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ