তৈমুর খান
আত্ম-উন্মোচন
জয়দেব বসু (১৯৬২-২০১২) যে স্বর নিয়ে বাংলা কবিতায় আবির্ভূত হলেন তা তাঁকে প্রথম থেকেই ভিড়ের মধ্যে চিনিয়ে দেয়। ”কেবল সমাজতন্ত্র। আর সেই দিকে পৃথিবীর উন্মত্ত ঝোঁক যদি এখনো বিলম্বিত হয়, নিউটন মেনে তবে আমাকেই ধাক্কা দিতে হবে।কেননা, সমাজতন্ত্র, তুহুঁ বিনা আমি যে বাঁচি না।”(রাধাকথন)
‘রাধা’ সমাজতন্ত্র, রাধা তাই কবিও। সমাজতন্ত্রের উত্থানে রাধা ভাব জাগরিত উপাখ্যান মননতন্ত্রের বাকচিত্র যে সাযুজ্য পেয়েছে তা তাে বাংলা কবিতায় প্রথম। একটা রাষ্ট্রীয়তত্ত্বকে বৈষ্ণবী রাগানুগা সাধনায় পর্যবসিত করেও মূলতত্ত্বটির উপেক্ষা করেননি। কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে সেই উচ্চারণ: ”সমাজতন্ত্র ছাড়া এই পোড়ামুখে অন্ন, প্রাণ, চেতনা, অক্ষর…মোদ্দা কিছুই আর রুচিবেক নাই।”
বামপন্থী আদর্শ বা রাজনৈতিক মতাদর্শ যা-ই বলি না কেন, এই ভাবনার সঙ্গে পৌরাণিক মিথের সামঞ্জস্য যে কতখানি শিল্পসম্মত তা দেখলে অবাক হতে হয়। তবু কবি আত্ম-উন্মোচনের স্পষ্ট বার্তাটি দিতে ভোলেন না:
”যতক্ষণ তবু এই সিপিএম পার্টি রয়ে যাবে, কলম ঘষটানো আর যে কোনো কবিতা থেকে আমাকে নিবৃত্ত করা নেহাতই অলীক। আমার ক্যাডার, এটা জানেন নিশ্চয়।
এতেই আমার সুখ, বাকি সব— করকমলেষু…” (উন্মোচিত চিঠি:৪)
বাংলা জুড়ে ক্যাডার বা ‘ক্যাডার’ শাসনের সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে সেই উত্থানের মুহূর্তটিতেই জয়দেব বসুর হাতে বাংলা কবিতা যে তীক্ষ্ণধার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা ছেড়ে দিলে কর্ণ নয়, রাধেয়-অধিরথসুত হিসেবেই নিজের রূপান্তর এবং মনন বিক্রিয়ায় কবি যে প্রজ্ঞা ও আধুনিক মননের আর্তি নিক্ষেপ করেছেন তা আধুনিক মহাভারতে নতুন কর্ণের জন্ম বলেই মনে হয়েছে। মহাভারতের ভোজকন্যা কুন্তি নয়, এই যুগেরই কোনও থুবড়ি কাম চরিতার্থ করে ভ্রূণকে ত্যাগ করেছে যেন। কবি সেই ত্যাগকরা সমস্ত ভ্রূণের মুখেই বাণী এনে দিয়েছেন:
”কোথায় ছিলেন রাণী? বেজন্মা-বেজাত শুনে-শুনে যখন আমার দেহ ছুটছিল এ-গলি সে-গলি? কোথায় ছিলেন ওগো ভোজের দুহিতা? যখন গুরুর শাপে ভয়ে আমি সিঁটিয়েছিলাম? কোথায় ছিলেন, হায় অর্জুনের মা? যখন ক’দিন আগে আপনারই আমন্ত্রিত আর এক সঙ্গমসাথী চুরি করে নিয়ে গেল আমার যেটুকু শেষ— কবজকুণ্ডল?”(রাধেয়-অধিরথসুত)
যে কষ্ট, যে আকুলতা, যে জ্বালা থেকে এই প্রশ্নগুলি বেরিয়ে এল তাতে সর্বকালের কর্ণকেই কবি আমাদের মধ্যে স্থায়িত্ব এনে দিলেন। কর্ণ ব্যাপ্তি পেল, কুন্তী কুমারী নারীর আধুনিকা রূপ পেল। মানব প্রবৃত্তির চিরন্তন সমাচারে যে গতিময়তা কবি নিয়ে এলেন তা অতীতচারিতার বিস্মৃতি থেকে মুক্তি পেল। এখানেই কবির সার্থকতা।
‘ভ্রমণকাহিনী’ কাব্যটিতেই সময়ের এই প্রবহমান স্বরধ্বনি অতীতের নিবিড় অন্বেষণকে জাগরূক করে তুলেছে। ‘উনিশশো চল্লিশ’ কবিতায় ইতিহাসের প্রেক্ষিত থেকে জীবনযাপনের নানা সূত্রে কবি সময়ের অন্তরাল ভেদ করে তুলে এনেছেন সাংস্কৃতিক পরিচয়টিও।মেয়েদের চুলবাঁধা থেকে ছেলেদের ফ্যাসিবাদী বিরোধী নাটকে সামিল হওয়া। সাধারণ এক ছেলের প্রেম, ‘স্বদেশী’ আন্দোলনে যে মেয়েটি চরকাপেড়ে শাড়ি পরে শিক্ষকের পিছে পিছে গেছে—কবি তাদের সেই জীবনক্ষেত্র, মননক্ষেত্র ও স্বপ্নক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন। কবিতায় উল্লেখ করেছেন:
”উনিশশো চল্লিশে চল, আজকে তোমার বেণী দেখে সহসা শহর মেঘে ঢেকে গেল, এত তীব্র অতীতচারিতা বহুদিন কলমে আসেনি। সেসব মেয়ের মতো আমাকে শেখাও আজ কীভাবে চোখের ঐ প্রশাসন দিয়ে আমাকে বানালে তুমি সমর সেনের মতো ত্যারচা প্রেমিক, আমাকে শেখাও আরো কীভাবে তোমার গলা অধিকার করে নেয় বেথুনে পড়তে আসা ফরিদপুরের পাকা মেয়ে!” কবি পুরনো বাতাসে মুখ ধুয়ে নিয়ে বর্ষার দিনে অতীতচারী হয়ে সেইসব সময়ের সম্মোহনে আমাদেরও অবগাহন করিয়েছেন। বাঙালি জীবনের বাঁকগুলিতে সমর সেনের মতো কবির উল্লেখে ‘ত্যারচা প্রেমিক’ কথাটিতে পরোক্ষ যে ইঙ্গিত কবি দিয়েছেন সেটিও সেই যুগেরই পরিচয়।
জয়দেব বসুর আত্ম-উন্মোচনে প্রেমের স্ফুরণটিও এই কাব্যের একটা বৈশিষ্ট্য। ‘বসন্তের প্রথম লিরিক’ এই কাব্যেই কবি প্রথম ঘোষণা করেন:
”দীর্ঘ বিরহ, আমি ছুঁড়ে দিচ্ছি মুষ্টিভর ভালোবাসা, আজ
বৃষ্টি নামুক সব ভারতীয় মেয়েদের চোখে,”
যুবতী,তালাক পাওয়া মেয়ে, হাতে মেহেদি লাগানো মেয়ে সবারই কষ্ট দূর করতে চান কবি। বিরহ বিচ্ছেদ দূর করে মিলনের মহিমায় ভালোবাসাকে নামিয়ে আনতে চেয়েছেন আনন্দ অশ্রুতে। ভাই, প্রেমিক সবাই তার বোন অথবা প্রেমিকার জন্য যে দীর্ঘ বিরহ বহন করে সারারাত ভায়োলিনে স্লোগান বুনছে সেই শূন্যতা ও বিরহকেই কবি আপন অন্তরে ধারণ করেছেন। আর সেসব নিয়েই তিনি ‘কবিওলা’। ‘প্রণয় মঙ্গলা’ কবিতায় তাই লিখলেন:
”শহর থেকে এনেছি কবিওলা
বেজায় বোল-বোলাও
নাম জয়দেব, বেসুরো গান করেন:
‘কী ভালো যে বাসি তোমায় জানেন শুধু লরেন্স…”’
ভালোবাসার কবির ‘চাষাড়ে চুম্বনে মরো’ এক পাগল প্রেমিকের প্রলাপ হয়ে উঠেছে কবিতাও। ‘জনগণতান্ত্রিক রচনা’তেও ‘পূর্বরাগ’
রোহিতাশ্বের কাছে পরামর্শ চেয়েছে:
”রোহিতাশ্ব, ভাই ঘোড়া, আমাকে জরুরি কিছু পরামর্শ দাও। মেয়েটির চোখ দুটো দেখা গেল ধ্রুপদী বাঙালি। গয়নাবাতিক নেই। চমৎকার শাড়ি পরে। সুতরাং বাহ্যত সমস্যা থাকছে না। আমার তো মনে হয়…রোহিতাশ্ব, ঔদরিক, তামস গুল্ম খাওয়া একটু বন্ধ রাখো। আমার তো মনে হয় কৃষক আন্দোলনে মেয়েটিরও সমর্থন আছে।” এ যে পাত্রী নির্বাচন! রীতিমতো পছন্দের বিষয়-আশয়। এমনকী রাজনৈতিক মতাদর্শও কবি রোহিতাশ্বকে জানালেন। এই রোহিতাশ্বই কবির অন্তরঙ্গ আত্মসফর সঙ্গী। ”বস্তুত, আজ ঐ মেয়েটিকে দেখে চোখময় বাষ্প ঘনাল” এ কথা যেমন তাকে বলতে পারেন, তেমনি ‘আমি কি তরুণ কবি?’ এ প্রশ্নও তার কাছেই রাখতে পারেন।আসলে নিজের কাছেই নিজের সংলাপ কবির। প্রাণচেতনার অনিবার্য উত্থানকে বাগ মানাতে এই আত্মসংলাপ অমোঘ হয়ে উঠেছিল। যৌবনের সংবেদনশীল অনুভূতি ও ভাবনাগুলির স্ফুরণে কবি যে মাঝে মাঝে বিচলিত হতেন সেই পরিচয়টিও এই কবিতাগুলিতে ধরা আছে। ‘যাত্রাবিন্দু’তে কবি এক জায়গায় তাই বলেছেন:
”কে না জানে, মেয়েটি আমাকে দেখে প্রতিদিন নাক কোঁচকায়। কী আর করার আছে, সব ছেলে প্রণয়ের উপযুক্ত নয়। তা বলে কি বিষ খাব, ত্রিভঙ্গ মেঝেন, বলো, এতদূর নাটক কি ছাব্বিশে সাজে?” প্রেমে মান-অভিমানে কবি যে যথেষ্ট সাবালক তা বলাই বাহুল্য। তাই কোথাও ‘বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদো না নির্বোধ’ বলেও নিজে নিজেই অস্থির জীবনে স্থিরতা আনতে চেয়েছেন। প্রেমের খেলায় জীবন শুরুর এই ভোরবেলা কবি ‘ভীতু প্রেমিকের দিনলিপি’ রচনা করে গেছেন। দার্জিলিং থেকে দুবরাজপুর, সিউড়ি-লাভপুর বাংলার সর্বত্রই
ভ্রমণবৃত্তান্তের ইশতেহার ছড়িয়ে রেখেছেন। ‘বিষণ্ণ নাবিক’ ভেবেই চলে গেছেন সব বন্দর ছেড়ে। ঝরাপাতা, সন্ধ্যা, শাঁখের আওয়াজ ভরা দেশে দারিদ্র্য আর কষ্টগুলিতে দীক্ষিত হয়েছেন। সংগ্রামের ডাক পেয়েছেন আর তাতেই কবিতার টংকার ঝংকৃত হয়েছে।
নিজেরই মুখোমুখি নিজেকে
জয়দেব বসু বারবার নিজের মুখোমুখি হয়েছেন। নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন নিজেরই সামনে। ‘ভবিষ্যৎ’কে জাগাতে চেয়ে তো নিজেকেই ডাক দিতে হয়। নিজের মধ্যেই জেগে ওঠে উনিশ শতকের প্রাচীন ঝড়, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, অঁরিয়েৎ, মাইকেল ডাট্। এই জীবন স্রোত, রক্তস্নাত দিন, অতীত, মোহররম্ সবকেই কবি জাগাতে চেয়েছেন। দুর্মর জীবন-উত্থানে শঙ্খ ঘোষ,রবীন্দ্রনাথ সকলেই কবির কাঁধের ওপর ‘ভার’ বিস্তার করেছেন। আর জঙ্গিপনাকে সঙ্গে করেই উদ্দাম চঞ্চল কবি আত্মবিস্তারের পর্যায়ক্রমিক বিন্যাসে দ্বান্দ্বিক জীবনচর্চায় বিমোহিত হয়ে উঠেছেন । এক স্বপ্নের জগৎ খুলে গেছে কবির চোখের সামনে। কালপুরুষের মহাবিস্ময়ে কবি উপলব্ধি করতে পেরেছেন— ”শূন্যতার মধ্যে কোনো ঢেউ নেই, শিরশিরানি আছে”—এই বোধই সর্বব্যাপী কালসীমাহীন আত্মজগৎ কবির। কিন্তু ‘লেলিন’ পাঠ করার পর কবির বোধ হল:
”শূন্যতার মধ্যে কোনো সৃষ্টি নেই, সম্ভাবনা নেই,
বিনাশ রহস্য নেই, প্রেম নেই, ছাড়াছাড়ি নেই,”
(দীপাবলি)
সুতরাং বাস্তবের জনারণ্যে কবিকে নামতেই হল। প্রেমে কলঙ্কভাগী হয়ে সাতাশ কুকুরের মাংস ছুঁয়ে দিতে হল। প্রেমে ধান্দা হারিয়ে, কানখোঁচানি হারিয়ে অবশেষে নিজেকে চিনতে শিখলেন। জাতির জন্য কবি উলকি আঁকলেন, কপালে দাগলেন চিহ্ন—তারা কি একদিন সত্যিই কবিকে তুলে আনবে সমূহ প্রত্যাখ্যান থেকে? কবি এই দৈনন্দিন আর জগৎ বিস্ময়ের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন:
”হে বিপর্যস্ত ভাষা, হে মহাজগতের ঘূর্ণন,
এ ছায়াপথ, হে নিরাসক্তি,
হে রাত্রি পৃথিবীর গান আর গান গাওয়া সেই মেয়ে,
হে জীবনবেষ্টিত মৃত্যু আর মৃত্যুর নাকে নথ,
হে সত্য, হে সত্যকাম, হে নৌকার লন্ঠন,
তারা কি জাগিয়ে তুলবে পুনর্বার?”
কবি যে জাগরণ চাইলেন তা এই ‘ভূমা’রই স্বরূপ। মহাজাগতিক অস্তিত্বে তাইতো টংকার তুলে চলেছে অনুব্রত। তারই সপ্তসুর জীবনরাগ নিসর্গ ও নান্দনিক প্রত্যয়ে জেগে উঠছে। কবি এখানে দার্শনিক হয়ে উঠেছেন। লেলিনবাদের শ্রেণিবৈষম্যের সমাজতান্ত্রিক সমাজতাত্ত্বিক পাঠ থেকে মহাসৃষ্টির মহাবিস্ময়ে নিজের চলাচল অনুধাবন করেছেন। ‘সফদর হাশমির চিঠি’-ও নিজেরই আত্মগত ইতিহাস অনুসন্ধানের ভেতর বিপ্লবীর জাগ্রত মর্মর ইঙ্গিত বয়ে এনেছে। ‘সায়োনারা’য় এসে তাই কবি লিখলেন:
”ঘুমের মধ্যে সেই জন্ম—সেই অশ্রুপতনের অপেক্ষায়,
আশা করি—আবার আমি উঠে দাঁড়াতে পারব”
কবির চলাচল দীর্ঘ হল ভবিষ্যতেও। শত বেলেল্লার মাঝেও জীবনের চরকি ঠিক ঘুরে আসে। স্বপ্নভঙ্গের পথ ধরে এগিয়ে নিসর্গের নৈঃশাব্দ্যিক অশ্রুফোঁটা পেরিয়ে কবি স্বপ্নে পুনরায় প্রবেশ করেন। এ এক জন্মান্তরের ভেতর দিয়ে কল্যাণময় সভ্যতায় যাত্রা। এই যাত্রা কোনওদিনও শেষ হবে না।
নিজেকে দেখতে দেখতে অক্ষমতা, প্রেমের সংকেতগুলিতে প্রতিহত হতে হতে জয়দেব কীভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন, সেই নব্বই দশকের বিপন্ন দিনগুলিতে রাজনৈতিক দালালদের অত্যাচার আর চাকুরীবিহীন বেকারত্বে পুড়তে পুড়তে যখন দিশা পাচ্ছিলেন না, তখন গণতন্ত্রই-বা কোন্ কাজে লাগে বলে তাঁর মনে হয়েছে। মূল্যবোধ হারিয়ে যাওয়া সমাজে যখন তিনি দেখলেন:
”মাথার ঘাড়ের কাছে ক্ষুর ধরেছিল, আর
মামা পাগল হয়ে যাচ্ছিল,
বিচিতে লাথ্ মারছিল, আর
মামা পাগল হয়ে যাচ্ছিল…” (নিজেকে দেখুন)
তখন সেসব কথা কি তিনি সব লিখতে পেরেছেন? নিজের সময়ের কবিরা হয়তো অনেকেই লিখতে পেরেছেন। জয়দেব তাঁর কষ্টের কথা, পার্টির কথা, প্রেমের কথা, কবিতা লিখে কোন্ পত্রিকায় প্রকাশ করবেন তার কথাও অকপটে লিখে চললেন। সবই সেই সময়ের ‘ক্ষুব্ধ পথ চলার বৃত্তান্ত’— যা তাঁকে প্রতিমুহূর্তে ছিন্নভিন্ন করেছে। শেষপর্যন্ত বিশাল সমুদ্রের বালিয়াড়িতে দেখেছেন ”অনেকদূর গিয়ে মিলিয়ে যাওয়া দু’জোড়া পায়ের ছাপ” আর ‘একটি গাংচিলের স্মৃতি’…. শুধু কুড়িয়ে পেয়েছেন ‘একটি ভাঙা ডানা’— এটাই তো সেই প্রেমের চিহ্ন যে প্রেম সময়ের তীরে কবিকে নিঃস্ব করে চলে গেছে।
‘থেরীগাথা’য় জয়দেব ইতিহাস-পুরাণের ভেতর দেশি-বিদেশি নানা উপকথাকে কুমারী জীবনের মুখে তুলে এনেছেন যা ‘কুমারিত্ব বিদ্ধতার বিবস্ত্রকাহিনী’। প্রতিটি নরকের কপাট মুক্ত করে কবি ‘সত্য আবির্ভূত’ করতে চেয়েছেন। কবি কামকলার ক্রীড়ায় নারীর সম্ভোগ রতির সেই নিষিদ্ধ বর্ণনা নায়িকাদের মুখ দিয়েই বলিয়েছেন। তাদের যৌবন বিস্তার ও রূপমুগ্ধতার বিবরণ যেমন আছে, তেমনি আছে পরিণতির দিক নির্দেশ ও রক্ষ চুল, ভাঙা নথ, রক্তাক্ত অঞ্জলি। সংঘ-জীবনের ধর্মাচরণ থেকে দেব-সেবার নানা স্তরে কুমারীজীবনের যৌনশোষণের কাহিনি কবি সন্নিবিষ্ট করেছেন। নায়িকা শেষপর্যন্ত তথাগতের সামনে উপস্থিত হয়ে জানতে চেয়েছে: ”তথাগত, এই আমি…/ আমাকে কোথায় যেতে হবে?” তার যাওয়ার ঠিকানা যে তথাগতরও জানা নেই। পরোক্ষে সেই কথাটিই বোঝাতে চেয়েছেন।
‘জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়’ কাব্যটি এভাবেই এক ঘোরের ব্যাপ্তি নিয়ে এসেছে। মুক্তমঞ্চের আলোকে অন্ধকারের জীর্ণ তিক্ত বিষাদগুলি কবি তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। মানুষের মনোজগতের বোধ ও অনুভূতির রসায়নকে সংলাপের ভাষায় প্রকাশ করতে চেয়েছেন। ”আছে শুধু পাখা, আছে মহানভ অঙ্গন” সংলাপধর্মী কবিতাটিতেও দ্বান্দ্বিকতার এক পর্যায়ক্রমিক পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। মাহুত এবং গাড়ির ড্রাইভারের মধ্যে চলেছে দীর্ঘ সংলাপ। ভাষা, কল্পনা, সভ্যতা, জীবন, প্রকৃতি, নারী, প্রজন্ম, বর্তমান-ভবিষ্যৎ, রাজনীতি, পাপ-পুণ্য, আন্তর্জাতিক বিষয়সমূহ সবকিছুই উঠে এসেছে সংলাপে। পাঠকের প্রতিও ইঙ্গিত আছে। কোথাও বুদ্ধিদীপ্ত প্রজ্ঞার আলোক পড়েছে সংলাপে। কিন্তু সারারাত্রি ধরে সংলাপ জাগরণের ভেতর তাদের সত্তা রূপ পরিবর্তন করে নেয়। কবি লিখেছেন, ”গাড়িই হয়ে ওঠে ড্রাইভার, হাতিই হয়ে ওঠে মাহুত।” উভয় উভয়কেই গ্রাস করে নেয়। ফলে এবার সংলাপ শুরু হয় হাতির ও গাড়ির। তাদের মুখে রবীন্দ্রনাথের কাব্য-নাটকের ভাষাও এসে যায়। আবার মাহুত ও গাড়ি বেরিয়ে বেরিয়ে আসে। দীর্ঘ সংলাপের পর মাহুতের দার্শনিক উক্তি: ”আসলে আমরা এক। একই সঙ্গে দ্বিতীয় ও অদ্বিতীয়।” metamorphos প্রক্রিয়ায় মাহুত ও হাতির রূপান্তর এবং গাড়ি ও ড্রাইভারের রূপান্তর ঘটেছে। সত্তার চালনায় কখনো কখনো কবিকেও এভাবে রূপান্তরিত করেছে। R. Steele বলেছেন : ”Men were by the Force of that herb Metamorphosed into swine?” মানুষ যেমন শূকরে পরিণত হয়, তেমনি মাহুতও হাতিতে এবং ড্রাইভারও গাড়িতে পরিণত হয়। কবির মগ্নচৈতন্যের এই স্বয়ংক্রিয় যাপন আত্মনিরীক্ষার পরিধিকে মুক্ত করে দেয়। ‘সৌতিকথনে’ এসেও কবি এই ঘোরের সাম্যে ইতিহাস-দর্শনকে প্রাচীনতার আড়াল থেকে জীবনের গতিপথে চালিত করেন। কবি জানান শত্রু-মিত্রে কোনও ভেদ নেই। অহং ও ক্ষমতা মিলে পৃথিবীর সব পাপ সৃষ্টি করেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ দাশ, মঙ্গলকাব্য থেকে জুলিয়াস সিজার, ইউরোপ থেকে এশিয়া সব ভূমণ্ডল-ই কবির মনন-দর্শনে মানব-সংস্কারের এক সমন্বয়দর্শী বোধের উত্তরণ এনে দিয়েছে। কবিতার শেষ পংক্তিতে কবির সমীহ উচ্চারণ:
”সৌতিক কথকতা, সুধী, অমৃত সমান।
বোবা জয়দেব ভণে, শুনে পুণ্যবান।।”
কৃত্তিবাস-কাশীরামকেও তখন কবির মাথার ওপর বসে থাকতে দেখি। ভারতীয় সংস্কৃতির আদি নির্বাণ মহাযজ্ঞে কবির আত্ম-অন্বেষণের পথ যে সর্বস্তরেই বিতত হয়ে আছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কবি যেন নিজেরই সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঘোর দুঃসময়ের ভেতর চিরন্তন সাধকের দৃষ্টি দিয়েই দেখেছেন জীবনরসের তরঙ্গ কীভাবে উত্থিত হয়েছে। কবিও পান করেছেন সেই রস আর আলো-আঁধারের ঘোরের ভেতর শুনেছেন মানবাত্মার চিরন্তন কণ্ঠস্বর।
সময়ের রেখাঙ্কিত পথ
‘জনগণতান্ত্রিক কবিতার ইশতেহার ও অন্যান্য’ এবং ‘আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ’ কাব্য দুখানিতে কবির সময়ের রেখাঙ্কিত পথকেই আবিষ্কার করা হয়। ‘মায়াকোভস্কির শেষ সাতদিন’ হাসপাতাল, তুলোর গন্ধ, ঠাণ্ডা নির্জনতা যেমন মনে আসে, তেমনি ‘অ্যান্ডি ইউ এস সিনড্রোম’-এ সালভাদোর আইয়েন্দের ঝাঁঝরা লাশ-ও সময়েরই অসুস্থ যাপনের মগ্নচিত্র। নব্বই দশকের শূন্যতা ও হাহাকার নিরর্থক এক জীবনবেদের কাছে বারবার কবিকে উপস্থিত করেছিল। সমস্ত পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধ-সন্ত্রাস আর মৃত্যু-মিছিল গ্রাস করছিল। জর্জ বুশের উপসাগরীয় যুদ্ধ যেমন, তেমনি ফিলিস্তিনি-ইস্রাইলী যুদ্ধও । কবি অসহায়ভাবে মানুষ মারার জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে প্রেসিডেন্ট বলে মনেই করেন না। ঘৃণা উদ্রেক করে বলেন: ”লিঙ্কনের পর থেকে আপনাদের প্রেসিডেন্টরা কখনো ছিলেন না…থুঃ!”
এই সময় ধর্মবকের মুখে কবি প্রশ্ন তুলে দেন: ”কাকে বলে প্রেম!”
উত্তরও দিয়ে দেন:
”দূর থেকে যাকে
ভালোবাসা বলে ভুল হয়।”
নব্বই দশক যেন এই দূর থেকে দেখা ভুল প্রেমেরই শিকার। জন্ম-জন্মান্তর ধরে ফিরে কবির বোধ যখন সর্ব প্রাণীতে প্রাণীতে চারিত হয়—তখনও এক দুর্মর ভালোবাসার কাছে দায়বদ্ধ থাকে। কিন্তু কবি যে শূন্যতা নিয়ে আজও বিরাজ করেছেন, কখন তাঁর সিদ্ধি আসবে? এই মানবজন্মের ভেতর যে ক্লান্তি, ক্ষয় ও অবিশ্বাস জমে উঠেছে তাতেই কবির আকুলতা:
”আমাকে রক্ষা করো, শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি
নাস্তিক হয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন…” (জাতক)
সময়ের এই বৈশিষ্ট্যই ধারণ করেছেন কবি সময়ের জাতক হয়ে। ‘আল-কাসোয়া’ নামক দীর্ঘ কবিতায় মরু ভ্রমণকারী উটের মতো সভ্যতার প্রেমিকও ব্যর্থ প্রেমের দিনলিপি রচনা করেছে। ‘আল-কাসোয়া’ যে মরুর উট, প্রেমিকও ‘বোকাচন্দর’ স্বপ্নচারী জীবনের অবশেষে পৌঁছে গেছে মনোবিকলন রোগীর মতো। কবি আত্মহত্যাকারী ‘স্কিৎসোফ্রোনিয়াক’-এর কথা উল্লেখ করেছেন। ২ জুন ১৯৯২ এর শেষ ডায়েরিতে উল্লেখ আছে : .”টিকে থাকো, হে দীর্ঘদেহী কদাকার কাঁটাভোজী, এখনো অনেকদিন তোমার আহত কষে বারংবার কেটে বসবে নোংরা লাগাম। এখনো অনেকদিন তোমার পেটে আছড়ে পড়বে চাবুক। তোমাকে হাঁটতে হবে আঁধির মধ্য দিয়ে দিগভ্রান্ত টলতে-টলতে।”
Remoteness হয়ে আরোহী এভাবেই উটকে হাঁটাবে মরুপথে। প্রেম তো আরোহীই। সে-ই তো চাবুক মারবে। চাবুক খেতে খেতেই আল-কাসোয়াকে পার হতে হবে বালি পথের দেশ। স্তব্ধতার গ্রীবা, অশ্রুপতনের অতীত, তৃতীয়বিশ্বের জন্তু এভাবেই টিকে থাকবে।
সময়ের শব কাঁধে নিয়ে—এভাবেই কবি রেখাঙ্কিত পথ চিনিয়ে দিয়েছেন। ভোগসর্বস্ব জীবনের ম্যাজিকও উল্লেখ করেছেন:
—”কীভাবে ‘সন্তুর’ মাখলে সধবাকে মনে হবে কুমারী…
—কীভাবে ‘টাটা সিয়েরা’র কাচে ঝলসে ওঠে ম্যাসকিউলিন চোয়াল…
—কীভাবে মেয়ের বয়ঃসন্ধি আর মায়ের অস্তগামী যৌনতাকে
একসঙ্গে উস্কে দিতে পারে তুফানী ঠাণ্ডা…
তাই এদের দোষ দিই না খুব।”
(যখন ফড়িংরা ওড়ে)
বিজ্ঞাপন এভাবেই জীবনের হাতছানি দেয় আর সভ্যতা কৃত্রিম আলোকে ভরে যায়। ”সিন্থেটিক অশ্রু আর মাইক্রোচিপ হাসির জগতে” এভাবেই দিন কেটে যায়। ‘ভালোবাসা’ কাকে বলে এই সময় তার কিছুই জানা হল না। বিবাহ মানে টিপেটুপে সম্ভ্রান্ত ঝি-কে ঘরে আনা। যাদের জাগার কথা ছিল তারা কেহই জাগল না। প্রসারণশীল এই অতিবিশ্ব ঢেকে গেল মেঘে।
”স্পন্দন শুরু হয় অতঃপর,ঝাঁকে ঝাঁকে প্লাজমা ফড়িং
আবার উড়াল দিয়ে নতুন নিষেক শুরু করে;”
ফড়িংএর উড়াল যে মৃত্যুর দিকেই ধাবিত তা কবি জানেন। এই বিশ্বও মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে চলেছে।
জয়দেব বসু যেমন সময়কে অস্বীকার করেননি, তেমনি জীবনকেও। কবিতা যেমন সরাসরি, তেমনি তির্যকও। কখনোই মার্কসবাদ তাঁর দূরদৃষ্টিকে ব্যাহত করেনি। গদ্যের চালে যে ব্যঞ্জনা ও ভাষাবৈভব সৃষ্টি করেছেন, এমনকী হিন্দি উর্দু আরবি শব্দকে ব্যবহার করেছেন এবং তা এত অনায়াস ও স্বয়ংক্রিয়তা পেয়েছে যে কবিতাগুলি সাবলীল ও গতিরধারক হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞান-দর্শন-সমাজচেতনাকে একই সঙ্গে প্রতিফলিত করেছেন। ইতিহাস-পুরাণকে তুলে এনেছেন মননঅভীক্ষায়। প্রত্যেক তরুণ কবিকে দিয়ে গেছেন সদৃপ্ত অস্থি—’অস্থি দিয়ে বজ্র বাঁধবে না!’ সভ্যতাকে রক্ষা করতে গেলে অসুরদের যে বধ করতেই হবে!