মুসা আল হাফিজ
দি স্কুল অব এথেন্স হলো রেনেসাঁর অন্যতম শিল্পী Raffaello Sanzio da (১৪৮৩-১৫২০) এর সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্ম। এটি আঁকা হয় ১৫১০ থেকে ১৫১১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। রাফায়েল যে চারটি প্রধান ফ্রেস্কো এঁকেছিলেন, এ ছিলো সেগুলোর প্রধান। এর বিষয় ছিলো দর্শনশাস্ত্র। অন্য ফ্রেস্কোগুলো অঙ্কিত হয় কবিতা, ধর্মতত্ত্ব, এবং আইন নিয়ে। দ্য স্কুল অব এথেন্সে আছেন ২১ জন দার্শনিক । যাদের অধিকাংশই গ্রিক। গ্রিকদের পরে যারা রেনেসাঁকে সম্ভবের দরোজায় নিয়ে এসেছেন, তারা রয়েছেন বিশেষভাবে।
Pope Julius II এর লাইব্রেরীর জন্যে আঁকা এই বিখ্যাত ছবি এখনও ঝুলছে ভ্যাটিকানের প্রাসাদে। ছবিতে রয়েছে বিভিন্ন দেয়াল, যা জ্ঞানের শক্তিকে প্রকাশ করছে। রয়েছে একের পর এক ক্রমহ্রাসমান অর্ধবৃত্ত, তারা প্রথমে নির্দেশ করছে ঈশ্বরের জ্ঞান এবং সেখান থেকে জন্ম নেয়া দার্শনিকদের জ্ঞান।
একেবারে মাঝখানে আছেন প্লেটো (plato) ও এরিস্টটল (Aristotle ) । প্লেটো প্রবীন, জ্ঞানবৃদ্ধ, এরিস্টটল তারুণ্যে কল্লোলিত, প্রাণবন্ত। প্লেটোর পরনে যে পোশাক তার রঙের অর্থ বাতাস এবং আগুন। দুটাই ভরহীন জিনিস। অপরদিকে বাস্তববাদী দার্শনিক এরিস্টটলের পোশাকের রঙের অর্থ পৃথিবীর মাটির রং ও পানির রং। দুটো মিলেই পৃথিবীর ভরের বৃহদাংশ। শিল্পী কোনো দার্শনিকের নাম প্রকাশ করেননি।কেবল এঁকেছেন মনের মাধুরি মিশিয়ে। আলেকজান্দ্রিয়ার গণিতবিদ হাইপেশিয়াকে (Hypatia) এঁকেছেন ফ্রান্সিসকো মারিয়ার ছদ্মবেশে। প্লেটোর দর্শন প্রচারের কারণে গির্জার অভিযোগে আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় তাকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিলো। রাফায়েল ভয় পাচ্ছিলেন হাইপেশিয়াকে তার অবয়বে আঁকতে; গির্জা যদি রেগে যায়! ফলে প্লেটোকেও তিনি এঁকেছেন ভিন্নভাবে, লিওনার্ডো দ্য ভিঞ্চির (Leonardo da Vinci ) বেশে। ছবিতে অনুসন্ধিrসাসহ উপস্থাপিত হন আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মাদ ইবন আহমাদ ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮) পীথাগোরাসের (Pythagoras) ঠিক পেছনে! কী লিখেন তিনি, দেখছেন এবং গিলছেন!
ইবনে রুশদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হয়েছিলো রেনেসাঁকে। কারণ রেনেসাঁ এসেছিলো যাদের হাত ধরে, ইবনে রুশদ ছিলেন তাদের অগ্রপথিক।
অন্ধকার ইউরোপে তিনি চিন্তার মুক্তি এবং র্যাশনালিজমের প্রদীপ জ্বালিয়েছেন সযত্নে। পুরো ষোল শতক ধরে ইবনে রুশদের জবানে শেখা হতো এরিস্টটলকে।তিনি ছিলেন আধুনিক দর্শনের উন্মেষের সবচে‘ সম্মুখবর্তী শিক্ষক।
ইউরোপ যখন যাজকতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ছে, তখনও শ্লোগান শেখাচ্ছেন তিনি। কয়েক শতাব্দী আগেই কালের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি সেসব বারুদ। বলেছিলেন,
“এই যাজকদের স্বৈরিতার থেকে বড় স্বৈরিতা আর কিছু নেই।” বলেছিলেন “যুক্তি এবং বিশ্বাস পরষ্পরের পরিপূরক, ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই।” বলেছিলেন,“অজ্ঞতা থেকে ভীতি তৈরি হয়, ভীতি ঘৃণার সৃষ্টি করে আর ঘৃণা থেকে আসে হিংস্রতা। এটাই নিয়ম।”
রেনেসাঁর সূতিকাগার যেখানে, সেখানে জ্বলজ্বল করছিলো ইবনে রুশদের প্রভাব। কী ফ্রান্সে, কী ইতালিতে! সে প্রভাব কথা বলেছে নানাভাবে। আমরা চিত্রশিল্পে নজর দিই। চতুর্দশ শতকের ফ্লোরেন্সের চিত্রশিল্পী আন্দ্রে বনিটো (Andre Bonito) দর্শন বিষয়ক তার বিখ্যাত ছবিতে একপাশের অর্ধ বৃত্তে আঁকেন প্রাচীন গ্রীক দর্শন, অন্য পাশের অর্ধবৃত্তে আঁকেন আধুনিক দর্শন। মাঝখানে আছে একটি সেতু, যার নাম চিন্তামগ্ন ইবনে রুশদ।
বেনোজ্জো গোজ্বলির (Benozzo Gozzoli ) আঁকা Ôদ্য ট্রায়াম্ফ অব সেন্ট থমাস অ্যাকুইনাসÕ এর কথা ভাবা যাক। ।১২৫৫ সালে ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস থমাস একুইনাসকে (Thomas Aquinas) আহবান করে ইবনে রুশদের অনুসারীদের সাথে আত্মার প্রকৃতি নিয়ে বিতর্কের জন্য। তিনি বিতর্কে দেখান সক্ষমতা। একে মনে করা হয় বিশাল বিজয় । ছবিতে পশ্চিমা দর্শনের গুরু থমাস একুইনাসকে ডায়াসে দেখা যাচ্ছে। তিনি জনতার মাঝে সমালোচনা করছেন ইবনে রুশদের। ইবনে রুশদ শুয়ে আছেন নিচে, মাটিতে।একুইনাস ইবনে রুশদের বিরোধী ছিলেন বটে!প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। সেখানে ইবনে রুশদের মাধ্যমে দর্শনে তার হাতেখড়ি। তার গোটা দর্শন ছিলো ইবনে রুশদের উপর প্রচণ্ডভাবে নির্ভরশীল। বিরোধিতার প্রধান জায়গাগুলো ছিলো সকল মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক সমতার তত্ত্ব, জগতের পূর্বচিরস্থায়িত্ব এবং জগতের উপর ঐশ্বরিক নির্দেশনার তত্ত্ব। ক্যাথলিক উদ্বেগের জায়গা থেকে একুইনাস এসব ক্ষেত্রে ইবনে রুশদের মুখোমুখি হন।
দ্বাদশ শতক থেকে ইবনে রুশদ ইউরোপের নিজস্ব আলোচ্যবিষয় হয়ে উঠেন।তখনকার পশ্চিমা সাহিত্যের প্রধান সৃষ্টিগুলোতে তাকে দেখা যায়। ইতালীয় মহাকবি দান্তে আলিগিয়েরির (Durante Alighieri ) দ্য ডিভাইন কমেডিয়ায় অন্যান্য অ-খ্রিষ্টান গ্রিক এবং মুসলিম চিন্তকদের মধ্যে ইবন রুশদকে চিত্রিত করা হয়েছে “মহান ব্যাখ্যাকারী” অভিধায়।১৩২০ সালে লিখিত হয় এ কাব্য। এ শতকের শেষের দিকে ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম মহাকাব্য দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস (১৩৮৭) এর সূচনায় ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসার (Geoffrey Chaucer) ইবন রুশদকে উল্লেখ করেন শ্রদ্ধায়, তৎকালীন ইউরোপের অন্যান্য মেডিকেল অথরিটির সাথে।
ল্যাতিনে ভুল অনুবাদের খেসারত হিসেবে পাশ্চাত্যে ইবনে রুশদ অদ্বৈতবাদী হিসেবে চিহ্নিত হন, প্রত্যাদেশের অস্বীকারকারী এবং আত্মার অমরত্বে অবিশ্বাসী হিসেবে বিবেচিত হন গীর্জার কাছে। সিগার অব ব্রাবন্ড (Siger of Brabant ) খ্রিস্টধর্মের জন্য বিব্রতকর একটি প্রবন্ধ লিখেন। এরিস্টটলের বরাতে তিনি কথা বলেন এবং দাবি করেন, কথাগুলো ইবনে রুশদের থেকে পাওয়া। এভেরুসিজম বা রুশদবাদিতা এভাবে ইউরোপে উত্তপ্ত বিতর্কের পরিমণ্ডল রচনা করে।
সেখানে প্রতিদিন বাড়ছিলো ইবনে রুশদের অনিবার্যতা। মাইকেল স্কটের (Michael Scot ) অনুবাদ মারফত (১২১৭) খ্রিস্টান দুনিয়ায় তার তাবু গড়ার আগেই তিনি স্পেন থেকে আল্পস পর্বতমালা পাড়ি দিয়ে ফ্রান্সে চলে যান ইহুদীদের হাত ধরে।চলে যান উত্তর ইতালির সিসিলিতেও। সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিখের উদ্দীপনায় তার রচনা প্রবেশ করে নেপলস ও দক্ষিণ ইতালিতে, এমনকি জার্মানিতে। ইউরোপ তখন মানসিক জাগরণের উষাবেলায়। দরকার সবল, প্রবল চিন্তার ধাক্কা। ল্যাতিন অনুবাদে ইবনে রুশদ যখন সেখানে ছড়িয়ে পড়লেন, একেবারে মোক্ষম জিনিশটিই পেলো ইউরোপ। বিজ্ঞান মনষ্ক লোকেরা অত্যাচারিত হতেন গীর্জার হাতে। তাদের দরকার ছিলো চৈন্তিক ও মতাদর্শিক আশ্রয়। ইবনে রুশদের দুই সত্যের মতবাদ এবং পদার্থের অবিনশ্বরতা ও এর বহুমুখী -স্বত:স্ফূর্ত রূপ ধারণের মতামত তাদের কাছে ধর্মবাণীর বিকল্পরূপে হাজির হলো। এ ছিলো তাদের অভয়ারণ্য।
ইবনে রুশদকে জীবদ্দশায় গ্রহণ করেছিলো ইহুদী দর্শন। বিখ্যাত ইহুদি দার্শনিক মুসা বিন মাইমুন বা Maimonides (মৃত্যু ১২০৪) ছিলেন ইবনে রুশদের সমসাময়িক এবং তার উrসাহী প্রচারক। তার খুব কম রচনা এমন, যেখানে ইবনে রুশদ উদ্বৃত হননি। তার অনুসারি হিসেবে তিনি ছিলেন অগ্রগামী এবং তার মতোই আপন সমাজ কর্তৃক আক্রান্ত, রক্তাক্ত । তার গ্রন্থাবলী ইহুদীরা আগুনে পুড়িয়েছে, যেভাবে মুসলিমরা পুড়িয়েছে ইবনে রুশদের গ্রন্থাবলী। মাইমোনাইডিস ইহুদী দর্শনে এরিস্টটলের জায়গা রাখেননি। সেখানে বসান ইবনে রুশদকে। ল্যাতিন দুনিয়ায় তার প্রবল প্রভাব ছড়িয়ে দিতে তিনি রাখেন ভূমিকা। নেপলস বিশ্ববিদ্যালয়ে ইবনে রুশদকে যেমন পাঠ্যভূক্ত করেন, তেমনি তার গ্রন্থের প্রতিলিপি ছড়িয়ে দেন প্যারিসে, অক্সফোর্ডে, বোলোগনায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রধান ইহুদি চিন্তকগণ ছিলেন ইবনে রুশদে নিমজ্জিত। Samuel Ibn Tibbon ( ১১৬৫-১২৩২) Judah ben Solomon ha-Kohen (১২১৫-১২৭৪) স্বীয় গ্রন্থসমূহে প্রচন্ডভাবে ইবন রুশদের উপর নির্ভর করেন।১২৪৭ সালের নিকটবর্তী সময়ে টলেডোর য়েহুন্দা বিন পালোম কোহেন ইবনে রুশদের বয়ানের ভিত্তিতে এরিস্টোটলের নীতির একখানা বিশ্বকোষ প্রকাশ করেন। এর দশ বছরের মধ্যেই সোমতুব বিন ইউসুফ বিন ফলেজুয়েরা এবং সলোমন বিন ইউসুফ বিন আইয়ুব ইবনে রুশদের ব্যাখ্যা ও অনুবাদ করেন। ১২৬০ সালে Moses ibn tibbon (১২৪০-১২৮৩) ইবন রুশদের প্রায় সকল গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশ করেন। চতুর্দশ শতকে ইহুদি ঐতিহ্যে ইবনে রুশদবাদ লাভ করে পূর্ণ্ বিকাশ।
ইবনে রুশদের প্রধান কেন্দ্র ছিলো প্যারিস ও পাদুয়া।ইউরোপের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা সেখান থেকে যুক্ত হন এমন এক চ্যানেলের সাথে, যা তাদের প্রায় আড়াই হাজার বছরের চিন্তার উত্তরাধিকার বুঝিয়ে দেয়। ইবনে রুশদ কেবল এরিস্টটলের অনুবাদক ছিলেন বলে ইউরোপের গুরু হননি, তিনি বুঝিয়ে দেন এরিস্টটলের ব্যাখ্যা, চিন্তা। সহজ করে একদম। এর সাথে যুক্ত করেন নিজস্ব সৃজনশীলতা। একে ছড়িয়ে দিতে জীবন উrসর্গ করেন বোথিয়াস অব ডাসিয়া কিংবা সিজার অব ব্রাবান্ত এর মতো পণ্ডিতগণ। রোজার বেকন, রবার্ট্ গ্রটেসেট কিংবা আলবার্ট্ ম্যাগনান ছিলেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের হাত হয়ে ইবনে রুশদের চিন্তা ইউরোপে নবযুগ আনে প্যারিসের পথ দিয়েই। পাদুয়ায় কুল্লিয়াতের অনুবাদ হয় কল্লিগেট নামে। ১২৫৪ সালে বোনোফেসো তা সম্পন্ন করেন। এখানে ইবনে রুশদ চর্চায় সন্যাসীদের যেমন দেখা যায়, তেমনি সেনাপতিকেও। ১৩৩৪ সালে ইবনে রুশদের টিকা লিখেন এক সন্যাসি, সেটা মূদ্রিত হয় ১৪৯২ সালে, Servite এর সেনাপতির আদেশে। ভিয়েনার গাটানোকে (১৪৬৫) বলা হয় এখানে রুশদবাদিতার জনক। অচিরেই এখানকার সারস্বত সমাজ ইবনে রুশদে মনের খাবার খোঁজে পান।
হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি গ্রন্থে বারট্রান্ড রাসেল লিখেছেন: ‘পেশাদার দর্শনের অধ্যাপক ছাড়াও বিশালসংখ্যক মুক্তচিন্তার অধীকারীদের বলা হল Averroists বা রুদশবাদী ; বিশেষ করে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে রুশদের অনুরাগীর সংখ্যা ছিল ব্যাপক। ’
সূধীসমাজে তার মতবাদ বরিত হওয়ায় পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো রুশদবাদ। সমুদ্র পেরিয়ে তা ইংল্যান্ডেও সৃষ্টি করে কম্পন।
রুশদের সবচে বেশি প্রভাব পড়েছিল ফ্রান্সিসকান সম্প্রদায়ের ওপর। সম্প্রদায়টির প্রবর্তক সাধু ফ্রান্সিস (১১৮২-১২২৬) ত্রয়োদশ শতকে বিলাসিতায় নিমজ্জ্বমান পোপ ও তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছিলেন।প্যারিস ও বুলোগনা বিশ্ববিদ্যালয় ইবনে রুশদকে শ্রেষ্ঠ উস্তাদ ধরে এগুচ্ছিলো। এই ধারা জারি থেকেছে মার্টিন লুভায়ন বিশ্ববিদ্যালয় বা মনটাগোলিয়ার এর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে; ষোড়শ শতক অবধি, যখন রেনেসাঁ ডানা মেলে উড়ছে। অবশেষে মার্টিন লুথার এসে দাঁড়ালেন , ইবনে রুশদের শাসন অবসিত হলো।
কিন্তু মধ্যবর্তী শতাব্দীগুলোতে ইউরোপের অন্ধকারের সাথে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে রুশদবাদ। ক্যাথলিক চার্চ তাকে ছেড়ে কথা বলেনি।রক্তগন্ধী যাজকতন্ত্র তার বা তার প্রতি আরোপিত ২১৯টি মতকে দণ্ডনীয় বলে রায় দেয়। তার ব্যাখ্যাকে অবলম্বনের জন্য ১৫ শতকেও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে হলফ নিতে বাধ্য করা হতো। তার প্রভাবে উদ্বিগ্ন পোপ ১১৭৯ সালে আহবান করেন তৃতীয় ন্যাটেরান কাউন্সিল। ডমিনিকান ধর্মগুরুরা তিনটি প্রধান ধর্মের বিরুদ্ধে সব ধরণের অনাচারের দায়িত্ব চাপান ইবনে রুশদের উপর। ১২০৯ সালে প্রকৃতিবিজ্ঞানের পাঠ নিষিদ্ধ করে প্যারিসের ধর্মসভা। ইবনে রুশদের অনুসারি আমরেলিকাস ও অন্যান্যদের দেয়া হয় কঠিন শাস্তি। কিন্তু বুদ্ধিমান ও ভদ্রসমাজে তিনি জেঁকে বসছিলেন প্রবলভাবে। বাড়তে থাকলো ইনকুইজিশন। তুলুজে ধর্মীয় আদালত বসানো হলো ১২১০ সালে। পেপের তরফে চতুর্থ ন্যাটেরান কাউন্সিল আহবান করা হয় ১২১৫ সালে। যোগ দেন ৪০০ বিশপ ও ১০০০ গীর্জাপ্রধান। সিদ্ধান্ত হয় ইবনে রুশদবাদীরা নাস্তিক ও ধর্মদ্রোহী ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রতি আদেশ জারি করা হয় ইবনে রুশদ এবং আরব দর্শন ও বিজ্ঞানের কোনো বই না পড়ানোর জন্য। ১২৩১ ও ১২৪৫ সালেও পোপ এই নিষেধাজ্ঞাকে নবায়ন করেন। ১২৭০ সালে ইবনে রুশদ বাহিত ১৫ টি দার্শনিক মতবাদের উপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন প্যারিসের বিশপ। সরাসরিই বলা হয় এগুলো চার্চের বিভিন্ন শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। ১২৭৭ সালে সরাসরি পোপ একুশ নম্বর জন ময়দানে নামেন। তার আদেশে পুনরায় প্যারিসের বিশপ জারি করেন নতুন নিষেধাজ্ঞা।
ইবনে রুশদকে ইউরোপ থেকে তাড়াবার জন্য শুরু হয় আন্দোলন। এগিয়ে আসেন একদল লেখকও।তারা না সহ্য করবেন আরববাহিত জ্ঞা-বিজ্ঞানকে, না দর্শন ও ইবনে রুশদকে। আরবদের সে জন্য তুচ্ছ করা ও তাদের অবদানকে প্রত্যাখান করার হিংসাশ্রয়ী প্রচারণায় তারা লিপ্ত হলেন। ইতালিয় লেখক পিদারক (১৩০৪-১৩৭৪)এক দৃষ্ঠান্ত। তিনি লিখেন, “আরবীরা শিল্প ও জ্ঞানের কোনও চর্চা করেনি, তারা কেবল গ্রিক শিল্প সংস্কৃতির কিছু কিছু অংশ রক্ষা করে চলেছিল। এবং আমি বিশ্বাস করি আরবের নিকট ভালো কিছু আশা করা যায় না …”
ইবনে রুশদের দ্বারা আলোকপ্রাপ্ত অনেকেই চার্চ ও অ্যারিস্টটলের দর্শনের সমন্বয় করতে প্রয়াসী হন। প্রয়োজন পড়ে তার স্বাধীন ব্যাখ্যার মোকাবেলা। সেই মোকাবেলায় নিয়োজিত স্কুলম্যানদের মাধ্যমেই তৈরী হয় স্কলাস্টিক দার্শনিক গোষ্ঠী। সেন্ট থমাস অ্যাকুইনাস ছিলেন এর পথিকৃত। এই যে এরিস্টটল নিয়ে বাদ-বিবাদ, দর্শনের পাঠ ও অনুসন্ধান, লোকদের ব্যাপক উrসুক্য, তা ইউরোপকে উপনীত করে নতুন বাস্তবতায়।যুগসঙ্কট হাজির হয় এ ধারায়। প্রশ্ন উঠে রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব নিয়েও। মানবীয় মননের ওপর চার্চের আধিপত্যের অধিকার নিয়েও। জবাব খোঁজা হয় এরিস্টটল থেকে। ইবনে রুশদ থেকে। জবাব অবশ্যই ছিলো চিন্তার মুক্তি, মানব মর্যাদা, সাম্য ও মানবীয় স্বাধীনতার পক্ষে।
অথচ ইতোপূর্বে ইউরোপে এ ছিলো প্রায় অসম্ভব। দর্শন চর্চা সেখানে ছিলো রীতিমত এক অপরাধ। রোমান সম্রাট জাস্টিয়ান ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে এক আদেশ জারী করে রোমান সাম্রাজ্যের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দর্শনশাস্ত্রের পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ করেন। স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে ধর্মের শত্রু মনে করা হচ্ছিলো প্রচণ্ডভাবে। এ ছিলো বহু শতকের ধারাবাহিকতা। ৩৯০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারটি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশপ থিওফিলাস । কারণ এর অস্তিত্বই ছিলো ধর্মবিরোধিতার প্রতিক। ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে নব্যপ্লেটোবাদী দার্শনিক ও জ্যোর্তিবিদ হাইপাশিয়াকে একই যুক্তিতে হত্যা করা হয় । তবে শেষ আঘাতটি হানেন জাস্টিনিয়ান। তার নিষেধাজ্ঞায় গ্রিক দর্শন ইউরোপ থেকে সম্পূর্নরুপে অবলুপ্ত হয়ে পড়ে।
গ্রিক দার্শনিকরা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন প্রাচ্যে। এথেন্স থেকে পলাতক সাতজন দার্শনিক আশ্রয় পান পারস্য সম্রাট ১ম খসরুর কাছে। তার কাছে রোমানরা যখন পরাজিত হয়, তিনি তাদেরকে সতর্ক্ করে দেন, যেন তারা নিজেদের দার্শনিকদের হত্যা না করে। কিন্তু হত্যা ও উচ্ছেদ জারি ছিলো সেখানে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের গ্রন্থাবলী হচ্ছিলো নিশ্চিহ্ন, বিলুপ্ত। যে অবধি মুসলিম বিজয় নিশ্চিত না হলো। মুসলিম সাম্রাজ্য পৃথিবীর প্রতিটি সভ্যতার জ্ঞানসম্পদ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলো।৭০৪ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আরবি ভাষায় গ্রিক দর্শনের (প্রধানত প্লেটো, আরিস্টটল ও পিথাগোরাসের দর্শন) অনুবাদ সম্পন্ন হলো। আব্বাসী খলীফা হারুনুর রশীদ ও মামুনুর রশীদের দারুল হিকমাহ ও বায়তুল হিকমাহ শুধু গ্রিক দর্শনকে বাঁচায়নি, অন্যান্য ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর জ্ঞানসম্পদকেও রক্ষা করেছে বিলুপ্তি থেকে। মুসলিম বিজয়ের একেবারে প্রথম দিন থেকে মুসলিমরা এ ব্যাপারে সজাগ ছিলেন। তাদের বিজয়ী তরবারি যেখানেই গেছে, জ্ঞানসম্পদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে গেছে।
কিন্তু অন্যান্য জাতির জ্ঞানের অনুবাদ ও সুরক্ষার চেয়ে মুসলিমদের সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবন ছিলো অনেক প্রসারিত। শুধু ধর্মতত্ত্ব নয় বরং দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক, ভূগোলবিদ, জ্যোতির্বিদ, খগোলবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, চিকিrসাবিদ, ভাষাতাত্ত্বিক, রসায়নবিদ, পদার্থবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, মনস্তত্ত্ববিদ, যুক্তিবিদ্যাবিশারদ তথা মানববিদ্যা ও প্রকৃতিবিদ্যার প্রতিটি শাখায় এমন অগণিত বিশেষজ্ঞের জন্ম দিয়েছে, যাদের তালিকা প্রদানে বহু খণ্ডের গ্রন্থ প্রয়োজন। তারা ছিলেন সারা বিশ্বের জ্ঞানার্থীদের শিক্ষক। প্রতিটি জাতির জ্ঞানসন্ধানীরা তাদের উদ্ভাবন ও ব্যাখ্যা তথা জ্ঞানকর্মের দিকে তাকিয়ে থাকতো। এটি সেই সময়, যখন ইউরোপ জ্ঞান ও চিন্তার মরুভূমি। সেখানে জ্ঞানের ফুল ফোঁটানোর আয়োজনকে মুসলিমদের স্পেনবিজয় নামে চিত্রিত করা যায়। স্পেন ও সিসিলির মুসলিম মনীষীরা ছিলেন ইউরোপের শিক্ষক। এবং তাদের অন্যতম একজন ছিলেন আবুল ওয়ালিদ মোহাম্মদ ইবনে আহমেদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে রুশদ। অন্যান্য মুসলিম পণ্ডিতদের মতো তিনি ছিলেন বহুবিদ্যাবিশারদ। উচ্চমার্গীয় আইনবিদ, ধর্মতত্ত্ববিদ, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, গনিতবিদ, ফকিহ, সমাজবিজ্ঞানী এবং ভাষাবিজ্ঞানী। প্রতিটি বিষয়ে তার রয়েছে বহু বই। তার শতাধিক বইয়ের সবগুলোই কালাতিক্রমী। প্রায় বিশ হাজার পৃষ্ঠা লিখে গেছেন এসব বিষয়ে। কিন্তু তার প্রধান কৃতিত্ব দর্শনে, আইনতত্ত্বে,চিকিসাবিদ্যায়। চিকিৎসাবিদ্যায় তার রচিত বিশটি গ্রন্থ তাকে শাস্ত্রটির বাঁকবদলের অন্যতম কারিগরে পরিণত করেছে। আধুনিক সার্জারির জনক বলা হয় তাকে। এসব পরিচয় তাকে কমই প্রকাশ করে সভ্যতার বিবর্তনে তার প্রভাবক ভূমিকার সাপেক্ষে।যার প্রতি সম্মান রেখে উদ্ভিদের একটি গণের নাম রাখা হয়েছে Averrhoa। যার মধ্যে রয়েছে Averrhoa bilimbi, Averrhoa carambola ।
ইউরোপীয় রেনেসাঁর গোড়ায় তার যে মাতৃদুগ্ধদায়ী ভূমিকা, এর বিচার যখন করা হয়, ইবনে রুশদকে এরিস্টটলের ঠিক পাশেই অধিষ্ঠিত দেখা যায়। রোজার বেকন ঠিকই বলেছেন, ‘ইবনে রুশদ প্রকৃতিবিজ্ঞানের দরোজা খুলে দিয়েছেন’, আর কে না জানে, এ দরোজা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে আধুনিক বিজ্ঞান!