আবদুল মান্নান সৈয়দ
মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় এসে প্রথমে মিরপুর সাড়ে এগারোয় বাসা ভাড়া করি। পরবর্তীতে মতিঝিলের আরামবাগ এলাকায় নব্বই দশকের কবি জামালউদ্দীন বারীর সঙ্গে মেসের জিন্দেগী শুরু করি। সেখান থেকেই একদিন হাজির হলাম গ্রীন রোডে। ৫৫ গ্রীন রোড। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ থাকেন এই গৃহে। তিনি, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ। ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’ পত্রিকার সম্পাদক ও কবি সাজ্জাদ বিপ্লব এর কাছ থেকে আমি ঠিকানা নেই কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ এর বাসভবনের। শুনেছি তিনি খুব মুডি। রাগী। ছোট কাগজ করি। তাই ভয়কে জয় করে আমি কবির সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। বললাম আমি তার উপর আমার ‘উদ্যান’ পত্রিকায় একটা সংখ্যা প্রকাশ করতে চাই। তিনি অবাক হলেন। কোন শহর থেকে এসেছি তা শুনে তিনি বসতে বললেন। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে রানু ভাবী চা নিয়ে এলেন। তিনি অকস্মাৎ আমাকে ষাটের কবি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ফারুক সিদ্দিকী, মনোজ দাশগুপ্ত ও রেজাউল করিম চৌধুরী এবং শেষে সাজ্জাদ বিপ্লব প্রসঙ্গে জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, বগুড়ার এরা আমার বন্ধু। আর সাজ্জাদ বিপ্লব এর লিটলম্যাগের মাস্টারহেড আমার হাতের লেখা। আমি এটা জানতাম আগে থেকেই। কিন্তু কবির মুখে শুনে বেশ ভালো লাগলো। আমি তার বন্ধুদের বিষয়ে বললাম, কে কোথায়, কেমন আছেন। তিনি শুনলেন। সংখ্যাটা কিভাবে হবে তিনি জানতে চাইলেন। আমি বললাম। কিছু লেখা আমি কবি জামাল উদ্দিন বারী কে সঙ্গে নিয়ে আরামবাগে কম্পোজ করতে দিয়েছি একথা কবিকে জানালাম। কবি শুধু বলেছিলেন, বেশতো। কাজ শুরু করে আমার কাছে এসেছো। কি চাও আমার কাছে? আমি তখন বললাম একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই আপনার। তিনি রাজি হলেন।
আফসোস আমি সেই কাজটি করতে পারিনি শেষ পর্যন্ত। বিজ্ঞাপন না পাওয়ায় পরবর্তীতে সংখ্যাটি প্রকাশনা স্থগিত হয়ে যায়। যা আমাকে আজো পীড়া দেয়।
কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ এর জন্ম ১৩৫০ সালের ১৮ শ্রাবণ। ১৯৪৩ সালের ০৩ আগস্ট। বাংলাভাষার সবচেয়ে আধুনিক কবিদের একজন তিনি। পাশ্চাত্যের আধুনিকতার প্রণোদনা ধারন করেন তিনি। তার কবিতার মধ্যে বারবার পরাবাস্তবতার বিষয় আশয় দৃশ্যগোচর হয়।পরাবাস্তববাদী বলেই তার কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়, স্বপ্ন যুক্তি ( Dream logic), মনস্তাত্ত্বিক নাটকীয়তা ( Psychological Drama), মুক্ত অনুষঙ্গ (Free association).
আবদুল মান্নান সৈয়দ রূপান্তরের কবি। দেখার যে চোখ তা ছিলো হাজার বছর সামনের দৃষ্টিভঙি।আবিষ্কার ও প্রণোদনা কে একফ্রেমে বন্দী করে তিনি কবিতার রংতুলির কারুকাজ করেছেন তার কবিতায়। কিংবদন্তি ফরাসি কবি আর্তুর রাবোর সঙ্গে তুলনা করে তাকে ডাকা হতো ষাট দশকে ” আফা তেরিবল”… মানে ‘ দুর্ধর্ষ বালক’….।
আবদুল মান্নান সৈয়দ এর বুদ্ধিদীপ্ততা ও পঠনপাঠনের অভিজ্ঞতা তাকে নিয়ে যায় নান্দনিক বোধের কেন্দ্রে। তার কবিতার বই এর নামেই আমরা চমকে উঠি। ” জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৭)”, … ” জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা (১৯৬৯),…” ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ (১৯৭৪)”…।
প্রত্যেক গ্রন্থে নিজেকে বিনির্মাণ করেছেন। ব্যাকরণ ভাঙা কবিতা তিনিই প্রথম লিখেছেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘ভেসেছিলাম ভাঙা ভেলায়’ ৭৮ পৃষ্ঠায় লিখেন, ” আরো দুর্গম ও জটিল লোকে প্রবেশ করতে চাই আমি–মানসের সুন্দরের দূরতম ভিতর মহলে “…।
আমরা একটি কবিতায় মনোযোগ দেই :
মাছ
শহর ঘুমিয়ে আছে।
মধ্যরাত্রি। তারা-ভরা বিশাল আকাশ।
দর্পনের মধ্য থেকে শুধু একটি উজ্জ্বল মাছ
বেরিয়ে এসেছে শব্দহীন।
ওকে শুধু দেখছে আমার চোখ।
নিঃশব্দে বলেছে চোখ :
মাছ, তুমি হারুনার রশিদ, নিশিপোশাকে বেরিয়ে
ঘুরেছ শহরময়―প্রাসাদে ও কুঁড়েঘরে।
দেখেছ শূন্য জুড়ে তারাদের চাকা ঘুরে যায়।
মাছ তুমি চলেছ কোথায়?
শহর ঘুমিয়ে আছে।
শুধু জেগে আছে চোর, বেশ্যা, পুলিশ এবং এক জন্মান্ধ গায়ক।
আর এক আশ্চর্য নিঃশব্দ মাছ। অগ্রসরমান মাছ।
ওকে শুধু দেখেছে আমার চোখ।
নিঃশব্দে বলেছে চোখ:
মাছ, তুমি কি আমারই চোখ?
এত রাত্রে নির্ঝরের জলে ঐ প্রাকৃতিক চাকা ঘুরে যায়।
মাছ, তুমি চলেছ কোথায়?
আবার লক্ষ্য করি :
” নিজের ভিতরে জলে নেমে গিয়ে সাঁতার জানি না
মেদিনীতরঙ্গে আমি বারেবারে ফিরে আসি, দেহত্রাণে
ডালপালাময় উড়ি মাছরাঙাদের প্রতিবাদে।
নিমিত্তের হন্তদ্বয় ধরে শিখব সাঁতার, জলে কাঁচের গেলাশ
মর্তের পায়ের নিচে বামনের মতো ছুরি
গাহন নিষিদ্ধ বুঝে–
কবে উঠব জরুরি সামাজিক–এই ভয়ে সন্ধ্যাকালে
উজ্জ্বল জিপসিসম শুয়ে থাকি মলিন বিছানা ভরে।
( সুবাতাস : জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ)
আর একটি কবিতা পাঠ করি :
সূর্যাস্ত ফেলছে নিঃশব্দে ফেরেশতাদের রঙচঙে কাপড়চোপড়
উচ্চন্ড দোকানবীথি ফুলে ওঠা ভিড়ে কোলাহল বালবে বাতাসে
এতোখুশি, যেন চাঁদে যাবে
জুতোর ফিতের প্রজাপতি উড়িয়ে লোকেরা যাচ্ছে লেকে পার্কে সিনেমায়
( লন্ঠন : জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা)
” সবুজ মশাল জ্বেলে নিসর্গ খেলছে তলোয়ারের কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ। তিনি শব্দের মাতাল। আবার কখনো বলছেন অনন্ত ভিখিরি হবো। আবার বলছেন, জানালার পাটাতনে কাঁধে কাঁধ বসি দুজনায়।
আধুনিক বাংলা কবিতায় আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রচলিত নন্দনতত্ত্ব পাশ কাটিয়ে নির্মাণ করেছেন নিজের সৌন্দর্য ভূমি। নিজের কবিতার পাটাতন। পরাবাস্তববাদী কবি হয়েও তাঁর দেখার সীমা অসীম বিস্তারী,অনুভবের ক্ষেত্র মর্মলোক,রুপায়নে প্রকল্পে নিজস্ব রঙতুলির আঁচড়। সৈয়দ নিজেই বলছেন, মনে হচ্ছে কবিতা আসছে, অনন্তকাল ধরে যে কবিতা লিখিত হবার প্রতিক্ষায় আছে কিন্তু লেখা হয়নি,মনে হয়, সেই কবিতার আত্মা ভর করেছে আমার উপর।
শব্দের যাদুকর ছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। অমর বাক্য বন্ধের ভাবানুষঙ্গে উঠে এসেছে জীবনের কোলাজধর্ম যা যাপিত জীবন থেকে উৎসারিত। নিবিড় সত্যের জটিল অনুবর্তনে প্রকাশিত তার নিজস্ব শিল্পানুভূতি। তার আবেগের আর্তনাদ আমাদের তার কবিতার দুয়ারে কড়া নাড়তে উদ্বুদ্ধ করে।