spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধ'বিদ্রোহী' কবিতার পৌরাণিক শব্দসমূহ

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

‘বিদ্রোহী’ কবিতার পৌরাণিক শব্দসমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম

বিদ্রোহী কবিতার ছন্দবিশ্লেষণ করে একটি প্রবন্ধ লিখেছি। কিন্তু একটা অতৃপ্তি কাজ করছিল। এই কবিতায় ব্যবহৃত পৌরাণিক শব্দগুলো নিয়ে যদি কিছু না লিখি, তাহলে ক্ষণে ক্ষণেই এই অতৃপ্তি আমাকে আহত করবে। কথায় কথায় আমরা প্রায়ই বলি ভারতীয়, ইসলামিক এবং গ্রীক পুরাণ থেকে প্রচুর শব্দ এবং চরিত্র এনে নজরুল এই কবিতাটি সমৃদ্ধ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে গ্রীক পুরাণ থেকে মাত্র একটি শব্দই এনেছেন, অর্ফিয়ুস, ইসলামিক শব্দগুলোর মধ্যে এসেছে আরশ, ইস্রাফিল, বোররাক, জিবরাইল, এর বেশি কিছু নয়। বেদ, মহাভারত, রামায়ন থেকেই এসেছে অধিকাংশ শব্দ ও চরিত্র। আজ এই রচনায় এইসব শব্দ ও চরিত্রের গভীরে গিয়ে কবিতাটিকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করব। নিশ্চয়ই আমার আগেও অনেকেই একাজ করেছেন, আমিও আমার মত করে লেখার চেষ্টা করছি।

‘ভুলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া

খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’

এখানে তিনি ভুলোক, দ্যুলোক, গোলক এর সঙ্গে আরশকেও টেনে এনেছেন। এর মূল কারণ হচ্ছে সাম্য। দুই ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি উর্ধ্বারোহণের বা সর্বত্র গমণের বিষয়টি প্রকাশ করেছেন। ভুলোক মানে যে পৃথিবী এটা আমরা সকলেই জানি, দ্যুলোক মানে যে স্বর্গ এটি অনেকের নাও জানা থাকতে পারে কারণ এই শব্দটি স্বর্গ অর্থে ততটা প্রচলিত নয়। গোলক এখানে কিন্তু গোল নয়। গোলক হচ্ছে স্বর্গের ভেতরে ভগবান বিষ্ণুর বাসগৃহ। ঘরটি গোল হবে এটি আমরা অনুমান করতে পারি। হোয়াইট হাউজে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের অফিসটিও ওভাল আকৃতির। ভারতের প্রধানমন্ত্রীও ভেবে দেখতে পারেন তার সরকারি বাসগৃহ বা কার্যালয়কে গোলকের আকৃতিতে পুনঃনির্মাণ করবেন কিনা। লক্ষ করে দেখুন যখনই ভগবান বিষ্ণুর বাসস্থান ‘গোলক’ এর কথা এলো পরের লাইনেই তিনি খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া উঠে গেলেন। আরশ হচ্ছে আল্লাহর আসন। ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থ ও বিশ্বাস মতে সাত আকাশের ওপরে, সত্তর হাজার আলোর পর্দা পেরিয়ে এক জায়গা আছে সেখানে অবস্থিত আরশ। সেখানেই আছেন আল্লাহ।

গোলক সম্পর্কে আরো একটু বলি। তার আগে বলা প্রয়োজন ভগবান বিষ্ণুর নানান নাম ও রূপ আছে। তিনিই কৃষ্ণ, তিনিই রাম। বেদে বর্ণিত বিষ্ণু অবশ্য সূর্য। তাই রবিবারের আরেক নাম বিষ্ণুবার। যেহেতু বিষ্ণুই কৃষ্ণ, তাই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাস্থল মথুরা স্বর্গের গোলকেই অবস্থিত।

‘মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর’

রুদ্র শব্দের অর্থ ক্ষুব্ধ। কিন্তু এটি একটি পৌরাণিক চরিত্র। ঋগ্বেদে রুদ্র চরিত্রের কথা বর্ণিত আছে বজ্রের দেবতা হিসেবে। জয়শ্রী হলেন বিজয়লক্ষ্মী দেবী। জয়ের দেবী। কী অসীম সাহস ও দক্ষতার সঙ্গে তিনি বলেছেন, আমার কপালে বিজয়ের দীপ্ত রাজটিকা জ্বলে যা বিজলীর মত। বিজলী বা বিদ্যুচ্চমক বোঝাতে ভগবান রুদ্রকে এনেছেন আর বিজয়ী বোঝাতে জয়ের দেবী জয়শ্রীকে উপস্থাপন করেছেন।

‘মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ’

ভগবান শিবের অনেকগুলো নাম আছে। তিনিই নটরাজ, তিনিই মহাদেব। মহাপ্রলয়ের সময় সমস্ত রাত তিনি তাণ্ডব নৃত্য নেচেছিলেন বলে তাকে নটরাজ উপাধি দেওয়া হয়। শিব শুধু ধ্বংসের নাচ তাণ্ডবনৃত্যই আবিস্কার করেননি, সৃষ্টির নাচ লাস্যও তিনি তৈরি করেছেন। শিবের বিভিন্ন রূপ। একদিকে তিনি কৈলাস পর্বতের সন্নাসী। অন্যদিকে তিনি একজন সংসারী, পার্বতীর স্বামী এবং কার্তিক ও গনেশের পিতা। তিনি যেমন সৃষ্টির তেমনি ধ্বংসের। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় আমরা যে কবিকে পাই তিনি যেন সাক্ষাৎ শিব। শিবের তাণ্ডব-নৃত্য শুধু নয় তাণ্ডব স্তোত্রও আছে। তাণ্ডব স্তোত্রের উৎপত্তি কিভাবে হলো সেই গল্পটি বলছি।

রাবণের সৎ ভাই কুবের ছিলেন লঙ্কার রাজা। তার ছিল এক দূর্লভ বিমান পুষ্পক। রাবণ কুবেরকে যুদ্ধে পরাজিত করে লঙ্কার রাজা হন। মনের আনন্দে তিনি পুষ্পক নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বের হন। কৈলাশ পর্বতের কাছে এলে রাবণের বিমান থেমে যায়। কৈলাশ পর্বত রাবণকে তার বিমানের দিক পরিবর্তন করতে বলে কারণ সেই সময় শিব বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। রাবণ তা প্রত্যাখান করে পুষ্পক থেকে নেমে আসেন। তিনি কৈলাশ পর্বতকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন। এতে সমস্ত পৃথিবী কেঁপে ওঠে। শিবের নিদ্রাভঙ্গ হয়। তিনি রাবণকে শিক্ষা দেবার জন্য পায়ের আঙুল দিয়ে কৈলাশ পর্বত চেপে ধরেন। এতে রাবণের হাত পিষে যেতে লাগল। রাবণ ব্যাথায় প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করতে লাগলেন। সেই চিৎকার স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছিল। এই শব্দকে সংস্কৃতে বলা হয় রব। রব শুনে মহর্ষি নারদ সেখানে হাজির হন। নারদের পরামর্শে লঙ্কাধিপতি রাবণ শিবের কৃপা লাভের জন্য তাণ্ডব-স্তোত্র পাঠ করতে শুরু করেন। সকাল-সন্ধ্যা ১৪ দিন তাণ্ডব স্তোত্র পাঠ করলে শিব খুশি হন। এবং কৈলাশ পর্বত থেকে পা সরিয়ে নেন।

‘আমি অভিশাপ পৃথ্বীর’

আমরা জানি পৃথ্বী শব্দের অর্থ পৃথিবী কিন্তু যখন কবি বলেন, ‘আমি অভিশাপ পৃথ্বীর’ তখন এর অন্য কোনো ব্যঞ্জনা আছে কিনা তা কিছুটা অনুসন্ধান করে দেখা যায়। পৃথিবীর প্রথম রাজা ছিলেন পৃথু। রাজা অর্থ রঞ্জনকারী। অর্থাৎ যিনি মানুষের মনোরঞ্জন করতে পারেন বা মানুষকে আনন্দ দিতে পারেন তিনিই রাজা। পৃথুই সর্বপ্রথম মানুষকে আনন্দ দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু তখন মাটি ছিল অসমতল, পাথুরে, রুক্ষ। ফসল হত না। প্রজারা অভিযোগ করলো, যেটুকু ফসল হয় তাও পৃথ্বী খেয়ে ফেলে। পৃথু তখন পৃথ্বীকে শাস্তি দেবার জন্য ধাওয়া করেন। পরে পৃথ্বীকে তিনি এই শর্তে ক্ষমা করেন যে পৃথ্বী এই পৃথিবীকে উর্বর করে দেবেন। পৃথ্বী বলেন, সব শস্য খেয়ে আমার পেটের মধ্যে অনেক দুধ তৈরি হয়েছে। তুমি মাটিকে সমতল করো এবং একটি বাছুর নিয়ে আসো যাতে দুধ দোহন করতে পারো। সেই দুধ দিয়ে মাটি উর্বরা হবে। তখন স্বয়ম্ভুব মনু, যিনি ছিলেন ব্রহ্মার মানসপুত্র এবং শতরূপার স্বামী, নিজেই বাছুর হয়ে নেমে আসেন। পৃথু তার তির, বর্শা দিয়ে মাটিকে সমতল করে তোলেন। বাছুরের সাহায্যে দুধ দোহন করেন। সেই দুধ সমতলে ঢেলে দেন পৃথু। পৃথ্বীর ওলানের দুধ কিছুতেই শেষ হয় না। তখন দেবতা, রাক্ষস, মানব সকলেই পৃথ্বীর দুধ দোহন করে সমতলে ছড়িয়ে দিতে থাকেন। এভাবেই মাটি উর্বরা হয়। পৃথুর নামের সাথে মিল রেখেই পৃথ্বীর নাম রাখা হয় এবং তার নামেই পৃথিবীর নাম হয়। পৃথ্বীর দুগ্ধে পৃথিবী উর্বরা হয়েছে বলেই পৃথ্বী বা পৃথিবীর নাম হয়েছে পৃথ্বী মাতা বা পৃথিবী মাতা।

‘আমি ভীম ভাসমান মাইন’

ভাসমান মাইনের সঙ্গে ভীমের কী সম্পর্ক? এই প্রশ্ন খুবই সঙ্গত। হস্তিনাপুরের রাজা পাণ্ডুর পাঁচ পুত্রই মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডব। ভীম দ্বিতীয় পুত্র। পাণ্ডু তার দুই স্ত্রী কুন্তী এবং মাদ্রীকে নিয়ে হরিণ শিকারে যান। কিমিন্দম মুনি তখন হরিণের রূপ ধরে এক হরিণীর সঙ্গে মিলনে লিপ্ত ছিলেন। পাণ্ডু দুটি হরিণকেই শিকার করলে এই অভিশাপ প্রাপ্ত হন যে তিনি সঙ্গমে রত হলেই তার মৃত্যু ঘটবে। রাণি কুন্তির ছিল দুর্বাশা মুনির আশির্বাদ। দুর্বাশা মুনির সাহায্যে তিনি দেবতাদের স্পর্শে (সঙ্গম ছাড়া) সন্তান লাভ করতে পারতেন। এভাবেই যুধিষ্ঠির, ভীম এবং অর্জুনের জন্ম হয়। অন্য দুই পাণ্ডব নকুল ও সহদেব তার সতীন মাদ্রীর পুত্র হলেও তিনি তাদেরকে নিজের পুত্রজ্ঞান করতেন। বিয়ের আগে সূর্যদেবের বরে কুন্তির আরেক পুত্র কর্ণের জন্ম হয়। যেহেতু পাণ্ডুর সঙ্গে বিয়ের আগে কর্ণের জন্ম হয় তাই কর্ণ কুন্তীর প্রথম সন্তান হলেও সে পাণ্ডব-ভ্রাতা নয়। ভীমের জন্ম হয় পবন বা বায়ুর দ্বারা। ভীম ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী। কথিত আছে তিনি ১০ হাজার হস্তিশক্তির অধিকারী ছিলেন। দুর্যোধন ভীমকে হত্যার উদ্দেশে বিষ প্রয়োগ করেন। পরে অজ্ঞান অবস্থায় তাকে নদীতে ফেলে দেন। নদীতে ভাসমান ভীমকে রক্ষা করেন নাগরাজ বাসুকী। বাসুকী ভীমের বিষ শুষে নিলে ভীম আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসেন। মহাশক্তিধর ভীমের দেহ যখন নদীতে ভাসছিল তখন কবি তাকে কল্পনা করেছেন একটি ভাসমাইন মাইন হিসেবে।

‘আমি ধুর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড়

অকাল বৈশাখীর’

মহাদেব বা শিবের আরেকটি বিশেষণ হচ্ছে ধুর্জটি। মাথায় জটাভার বা মহাবিশ্বের চিন্তাভার বহন করেন বলে তার নাম ধুর্জটি। আবার তিনি যখন স্বর্গ থেকে গঙ্গায় লাফিয়ে পড়েন তখন তার চুল সমস্ত আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। সূর্য ঢাকা পড়ে। আকাশ অন্ধকার হয়। অন্য এক মতে তাণ্ডবলীলার সময় তিনি যখন সংহারমূর্তি ধারণ করেন তখন তার ধুম্ররূপ প্রকাশ পায় এজন্য তার নাম ধুর্জটি। তবে এখানে কবি যখন ‘এলোকেশে ঝড় অকাল বৈশাখীর’ প্রকাশ করতে গিয়ে ধুর্জটিকে এনেছেন এখানে শিবের ব্যোমকেশ রূপটিই যথার্থ।

‘আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি’

সাগ্নিক শব্দের অর্থ হচ্ছে যে আগুন কখনো নেভে না। এখানে যজ্ঞের বা জ্ঞানের আলোর কথা বলা হয়েছে। আর সেই আলো কার ঘরে জ্বলে সবচেয়ে বেশি জমদগ্নি ছাড়া। জমদগ্নি ছিলেন একজন ঋষি, তার স্ত্রীর নাম রেণুকা। চার প্রকার বেদেই জমদগ্নির কথা উল্লেখ আছে। ব্রহ্মার মানসপুত্র মহর্ষি ভৃগুর উত্তর-পুরুষ জমদগ্নি। ভৃগুর পুত্র চ্যবন। চ্যবন ও তার স্ত্রী পৌলমির পুত্র আপ্রবান। আপ্রবান ও তার স্ত্রী রুচির পুত্র ঔর্ব। ঔর্বের পুত্র ঋচীক। ঋচীক ও তার স্ত্রী রাজকন্যা সত্যবতীর পুত্র জমদগ্নি।

জমদগ্নি একজন প্রাজ্ঞ ঋষি ছিলেন। তিনি রাজা প্রসেনজিতের কন্যা রেণুকাকে বিবাহ করে বহুকাল সুখী জীবন-যাপন করেন। তাদের পাঁচটি পুত্রসন্তান হয়।

একদিন পুত্রেরা ফল সংগ্রহের জন্য বনে গেলে ব্রতপরায়না রেণুকা স্নান করার জন্য নদীতে যান। ফেরার সময় রেণুকা দেখেন মর্ত্তিকাবতদেশের রাজা স্বর্ণপদ্মের মালাধারী চিত্ররথ তার স্ত্রীদের সঙ্গে জলকেলী করছেন। এই দৃশ্য দেখে রেণুকা কামাসক্ত হন। তিনি চিত্ররথের কথা ভাবতে ভাবতে সিক্তবসনে আশ্রমের দিকে হাঁটতে থাকেন। স্বগৃহে ফিরে এলে মহাজ্ঞানী জমদগ্নি রেণুকার মনের অবস্থা বুঝতে পারেন এবং স্ত্রীর পাপাচারে ক্ষিপ্ত হন। পরশুরাম ছাড়া অন্য চার পুত্র ফিরে এলে তিনি জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী প্রত্যেক পুত্রকে নির্দেশ দেন তাদের পাপিষ্ঠা মাতাকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু সকলেই অপারগতা প্রকাশ করে। নির্দেশ অমান্য করায় জমদগ্নি চার পুত্রকে শাপ দিলে তারা সবাই মনুষ্যজ্ঞান হারিয়ে পশুপাখির চেতনাসম্পন্ন প্রাণী হয়ে যান। পঞ্চম পুত্র পরশুরাম ফিরে এলে তিনি তাকে একই নির্দেশ দেন এবং পরশুরাম পিতৃ-আজ্ঞা পালন করেন। কুঠারাঘাতে মাতৃহত্যা করেন। এতে জমদগ্নি তুষ্ট হয়ে পরশুরামকে যত ইচ্ছা বর চাইতে বলেন। পরশুরাম মাতাকে জীবিত করার, তাকে পাপমুক্ত করার, নিজেকে মাতৃহত্যার পাপমুক্ত করার, হত্যার ঘটনা সকলের বিস্মৃত হবার, ভাইদের পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবার এবং যুদ্ধে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও দীর্ঘায়ু হবার বর চাইলেন। জমদগ্নি তথাস্তু বলে সকল বর দিলেন।

‘আমি ইন্দ্রাণী-সুত, হাতে চাঁদ ভালে সূর্য’

এখানে এসে কবি বৈপরীত্যে সহাবস্থান প্রকাশ করেছেন। পরের লাইনেই বলেছেন ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য’। ইন্দ্রাণী-সূত অর্থ হচ্ছে ইন্দ্রাণী-জাত বা ইন্দ্রাণীর মত। কে এই ইন্দ্রাণী তা জেনে নেয়া যাক। ইন্দ্রাণীর নাম ছিল শচী। তিনি ছিলেন ব্রহ্মার দশ মানসপুত্রের একজন পলোমার কন্যা। পলোমার জন্ম হয়েছিল ব্রহ্মার কান থেকে। শচীকে দেবরাজ ইন্দ্র বিয়ে করলে তার নাম হয় ইন্দ্রাণী। ইন্দ্রাণী ছিলেন অসম্ভব যৌনাবেদনময়ী নারী। ইন্দ্র এবং ইন্দ্রাণী দম্পতির ঘরে এক পুত্র ও এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। তাদের নাম যথাক্রমে জয়ন্ত এবং জয়ন্তী। দেবরাজ ইন্দ্র বিয়ের আগেই শচীর সঙ্গে যৌনকর্ম করেন। শচীর সতীত্ব নষ্ট করার কারণে তার পিতা পলোমা ইন্দ্রকে অভিশাপ দিতে পারেন এই ভয়ে ইন্দ্র পলোমাকে হত্যা করেন।

ইন্দ্র এবং ইন্দ্রাণীর কিছু মজার ঘটনা আছে। ব্রহ্মার বরে অবধ্য দৈত্যরাজ জলন্ধর ইন্দ্রকে যুদ্ধে পরাজিত করে স্বর্গচ্যুত করেন। নহুষ তখন স্বর্গের রাজা হন। রাজা হয়ে নহুষ উদ্ভিন্ন যৌবনা ইন্দ্রাণীকে পেতে চান। নহুষের লালসা থেকে রক্ষা পেতে ইন্দ্রাণী ঋষি এবং দেবতা বৃহস্পতির দ্বারস্থ হন। বৃহস্পতির মধ্যস্থতায় নহুষের কাছ থেকে কিছুটা সময় চেয়ে নেন ইন্দ্রাণী। ইন্দ্রাণী কিছুতেই তার স্বামী ইন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। ইন্দ্রাণী তখন উপশ্রুতির আরাধনা করেন। উপশ্রুতি হচ্ছে সংবাদ পরিবেশনের দেবী। ইন্দ্রাণীর আরাধনায় তুষ্ট হয়ে উপশ্রুতি তাকে ইন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। সব জেনে ইন্দ্র বলেন নহুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত অবস্থা আমার নেই। তুমি এক কাজ করো, নহুষকে রাজী করাও সে যেন ঋষি-বাহিত রথে চড়ে তোমাকে বিয়ে করতে যায়। নহুষ সপ্তর্ষি ও ব্রহ্মঋষি বাহিত রথে চড়ে বরযাত্রা করেন। সেইসব ঋষিদের মধ্যে অগস্ত্য মুনিও ছিলেন। হঠাৎ রথে উপবিষ্ট নহুষের পা পাদানী থেকে ফসকে গিয়ে অগস্ত্যর দেহ স্পর্শ করে। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে অগস্ত্য রাজাকে সাপ হওয়ার অভিশাপ দেন। এই অভিশাপের ফলে নহুষের পতন হয়। নহুষের পতনের পর সকলে মিলে পুনরায় ইন্দ্রকে স্বর্গের রাজা বানায়। এবং ইন্দ্রাণী তার স্বামী ইন্দ্রকে ফেরত পায়।

‘আমি কৃষ্ণকণ্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধির’

মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধির কবি হয়েছেন কৃষ্ণকন্ঠ। অর্থাৎ মন্থনের ফলে সমুদ্র থেকে উঠে আসা বিষ পান করে কবি কৃষ্ণকন্ঠ হয়েছেন। এর মধ্যেই যাবতীয় বক্তব্য নিহিত আছে। এর পেছনের গল্প না জানলেও আমাদের বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু যখন কৃষ্ণকণ্ঠ কে ছিলেন, কেন সমুদ্র মন্থন করা হয়েছিল, কেন সমুদ্র থেকে বিষ উঠে এসেছিল এইসব পৌরাণিক কাহিনী জেনে নিই তাহলে চরণটি আরো বেশি অর্থবহ হয়ে ওঠে। কবি যদি কৃষ্ণকণ্ঠ না বলে নীলকণ্ঠ বলতেন তাহলে আমাদের কাছে ঘটনাটি আরো পরিস্কার হত। তবে আমরা জানি কৃষ্ণকণ্ঠই নীলকণ্ঠ এবং নীলকণ্ঠ ভগবান শিবের অন্য আরেক নাম।

অমরত্ব লাভের জন্য দেবতারা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। দিব্যজ্ঞানে তারা জানতে পারেন অমরত্ব লাভের অমৃত পাওয়া যাবে সমুদ্র মন্থনে। তারা পৃথিবীর সকল সমুদ্র মন্থন করতে লাগলেন। এর ফলে সমুদ্র থেকে নানান কিছু উঠে আসতে লাগল। এক পর্যায়ে উঠে এলো এক সুবৃহৎ মৃৎপাত্র। দেবতারা ভাবলেন এর মধ্যেই আছে অমৃত। কিন্তু পাত্রের মুখ খুলে দেখলেন অমৃত নয় এর ভেতরে আছে বিষ। সেই বিষ যেখানে রাখা হবে সেই জায়গা হয়ে যাবে নিষ্ফলা, প্রাণশূন্য। ত্রিলোক জুড়ে দেখা দিল মহাদুর্যোগ, মহাঅমানিশা নেমে এলো পৃথিবীতে। কোথায় রাখা হবে এই বিষ। এর প্রভাবে যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন মহাদেব নিজেই এগিয়ে এলেন এবং সবটুকু বিষ নিজের কণ্ঠে ঢেলে দিলেন। বিষের প্রভাবে তার কন্ঠনালী নীল হয়ে গেল এবং মহাদেবের নতুন নাম হল নীলকন্ঠ, মতান্তরে কৃষ্ণকণ্ঠ।

‘আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর’

গঙ্গোত্রীর বন্ধনহারা ধারা। কী অসাধারণ চিত্রকল্প। পুরাণ অনুসারে রাজা ভগীরথের পূর্বপুরুষের পাপস্খলনের জন্য দেবী গঙ্গা গঙ্গোত্রী নামক স্থানে এসে নদীরূপে অবতীর্ণ হন। তার অবতরণের আগে রাজা ভগীরথ এখানে অনেকদিন তপস্যা করেন। আসলে অযোধ্যার রাজা সগরের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব চুরি হয়ে যায়। সগরের পুত্রেরা পাতালের কপিল মুনির আশ্রমে তা খুঁজে পান। কপিল মুনিকে অশ্বচোর ভাবার কারণে কপিল সগরের পুত্রদের পুড়িয়ে ছাই করে দেন। একমাত্র গঙ্গাজলের ছোঁয়া পেলেই তারা আবার জীবন ফিরে পাবেন। কিন্তু গঙ্গা তো থাকে স্বর্গে তাকে পাওয়া যাবে কিভাবে? শুরু হল তাকে পৃথিবীতে আনার উপাসনা। সগর ব্যর্থ হলেন। তার পুত্র অংশুমান ব্যর্থ হলো, তার পুত্র দীলিপও ব্যর্থ হলো। অবশেষে চতুর্থ পুরুষ ভগীরথীর প্রার্থনায় ব্রহ্মা তুষ্ট হলে গঙ্গা স্বর্গ থেকে নেমে আসেন এখানে। তাই এই জায়গার নাম হয় গঙ্গোত্রী।

ভৌগলিকভাবে গঙ্গোত্রী হচ্ছে একটি ছোটো শহর। এটি ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের উত্তরকাশী জেলায় অবস্থিত। এখানে গঙ্গাদেবীর নামে একটি মন্দির আছে। হিন্দুদের একটি পবিত্র তীর্থস্থান। গঙ্গোত্রী গঙ্গা নদীর উৎপত্তিস্থল। নদীটির নাম এখানে ভাগীরথী, এটি দেবপ্রয়াগে এসে অলকানন্দার সঙ্গে মিলিত হয়ে গঙ্গা নাম ধারণ করে। নদীর ধর্ম হচ্ছে সমতলের বুক চিরে লোকালয়ের বন্ধন ছিন্ন করা। পুরনো বন্ধন ফেলে নতুন নতুন লোকালয় প্লাবিত করা, নতুন বন্ধন তৈরি করা, তাও ক্ষণিকের। গঙ্গোত্রীর সেই বন্ধন হারা ধারাটি কবি ধরে ফেলেছেন। কীভাবে ধরেছেন? ব্যোমকেশ হয়ে। এখন জেনে নেয়া যাক ব্যোমকেশ জিনিসটা কি? ব্যোম অর্থ আকাশ আর কেশ অর্থ চুল। তাহলে আমরা বলতে পারি ব্যোমকেশ মানে হচ্ছে আকাশে ছড়ানো চুল। কিন্তু বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। এর একটি পৌরাণিক গল্প আছে। শিব ঠাকুর একবার স্বর্গ থেকে গঙ্গায় লাফিয়ে পড়েছিলেন। তখন তার চুল সমস্ত আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে শিবের আরেক নাম হয় ব্যোমকেশ।

‘আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহাহুঙ্কার’

কৈলাস পর্বতে রাবণের চিৎকারে ত্রিলোক প্রকম্পিত হয়েছিল। কিছুটা ইস্রাফিলের শিঙ্গার আভাস পাওয়া যায় সেই চিৎকারে। ইসলাম ধর্ম অনুসারে একদিন এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হয়ে যাবে। এবং তা হবে আল্লাহর নির্দেশে, নিয়মনিষ্ঠভাবেই। আল্লাহর নির্দেশে কাজ করেন একদল ফেরেশতা, তাদের মধ্যে প্রধান ফেরেশতা ৪ জন। জিব্রাইল, ইস্রাফিল, মিকাইল ও আজরাইল। ইস্রাফিলের দায়িত্ব হচ্ছে কেয়ামত ঘটানো, মানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধ্বংস করা। আল্লাহর নির্দেশে নির্দিষ্ট সময়ে তিনি তার বাঁশি বা শিঙ্গায় ফু দেবেন। তখন পৃথিবীর ধ্বংস কার্যক্রম শুরু হবে। বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত আছে তিনি তিনবার শিঙ্গায় ফু দেবেন। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র সবকিছু খসে পড়বে। পাহাড়গুলো তুলোর মতো উড়তে থাকবে, সমুদ্রের পানি আকাশে উঠে যাবে। কবির হৃদয়ে যখন শিবের তাণ্ডবনৃত্যের ছন্দ, অর্থাৎ ধ্বংসের উন্মাদনা তখন তিনি নিজেকে ইস্রাফিলের শিঙ্গার সেই মহাহুঙ্কারের সঙ্গে তুলনা করেন।

‘আমি পিনাক পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দণ্ড’

শিবের অব্যর্থ ধনুকের নাম পিনাক। এ-কারণে শিবকে ডাকা হত পিনাক পাণি। বিশেষ এই ধনুকটি তৈরি করেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। ঋগ্বেদ অনুযায়ী বিশ্বকর্মা নির্মাণের দেবতা। তিনি বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, ব্রহ্মার জন্য পুষ্পক বিমান, যেটি তিনি কুবেরকে দান করেন এবং পরে কুবেরের সৎ ভাই দশানন সেটি দখল করেন। দশানন কৈলাশ পর্বতে তাণ্ডব স্তোত্র পাঠ করে শিবের তুষ্টি লাভ করছিলেন বলে শিব তাকে রাবণ উপাধি দেন। স্থাপত্য শিল্পের দেবতা বিশ্বকর্মা দৃষ্টিনন্দন লঙ্কাপুরী তৈরি করেছিলেন বলেও উল্লেখ আছে। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মাণ্ডের সকল স্থাপত্য-নকশাই বিশ্বকর্মার। শিব তার ধনুকটিকে অস্ত্র হিসেবেই শুধু ব্যবহার করতেন না, এটিকে বাদ্যযন্ত্র হিসেবেও বাজাতেন। ধ্বংস এবং সৃষ্টির এই বৈপরীত্যই শিবকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। 

ডমরু একটি বাদ্যযন্ত্র, এটিও শিব বাজাতেন। মনে করা হয় ডমরু সবচেয়ে প্রাচীন একটি বাদ্যযন্ত্র। প্রাক-বৈদিক কালে ডমরুর অস্তিত্ব ছিল। 

ত্রিশূল একটি ধারালো অস্ত্র। দণ্ডের অগ্রভাগে তিনটি ধারালো মাথা বিশিষ্ট অস্ত্র এটি। এটিও শিবের অস্ত্র এবং এই অস্ত্রটিও বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে গৃহে কিংবা বিভিন্ন স্থাপনার চূড়োয় ত্রিশূল স্থাপন করেন। হস্তরেখাবিদেরা তালুতে, শাহাদাৎ আঙুলের নিচে, বৃহস্পতিক্ষেত্রে ত্রিশূল থাকাকে বিশেষ সৌভাগ্যের পরিচায়ক মনে করেন। 

বিশ্বকর্মা কিভাবে এবং কেন ত্রিশূল তৈরি করেন তার একটি মজার গল্প আছে। বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞা বিয়ে করেন সূর্য দেবতাকে। কিন্তু সূর্যের উত্তাপের জন্য তিনি তার স্বামীর কাছে যেতে পারছিলেন না। এই অপারগতার কথা পিতা বিশ্বকর্মাকে জানালে তিনি সূর্যের উত্তাপ কমিয়ে দেন। তখন সংজ্ঞা তার স্বামীর সাথে মিলিত হতে সক্ষম হন। এদিকে বিশ্বকর্মা সূর্য থেকে তুলে নেয়া উত্তাপ বা আলো দিয়ে তিনটি জিনিস তৈরি করেন। সেই ৩টি জিনিস হচ্ছে: দেবতাদের উড়াল-বাহন পুষ্পক রথ, সুদর্শন চক্র এবং ত্রিশূল। 

ধর্মরাজের অন্য নাম যম। তিনি মৃত্যু ও ন্যায়বিচারের দেবতা। তার একটি যমজ বোন আছে যার নাম যমী। বেদ, পুরাণ ও উপনিষদে যম ও যমীর কথা উল্লেখ আছে। যমের গায়ের রঙ ঝড়ো-মেঘের মত কালো বা প্রগাঢ় নীল। তিনি জল-মহিষের পিঠে চড়ে আসেন এবং তার হাতে একটি দণ্ড থাকে। যেটিকে কবি বলেছেন ধর্মরাজের দণ্ড।

‘আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড’

ভগবান বিষ্ণুর চারটি হাত। চার হাতে চারটি প্রতীক রাখেন, এগুলো হচ্ছে পদ্ম, শঙ্খ, চক্র, গদা। চক্র মানে সুদর্শন চক্র যার মধ্যে ১০৮ টি দাঁড় আছে। ১০৮ সংখ্যাটি হিন্দুধর্মের বিভিন্ন কিছুতে দেখা যায়। গায়ত্রী মন্ত্র ১০৮ বার গাওয়া হয়। ১০৮ টি পদ্মের পূজো দিয়ে দূর্গার সন্তুষ্টি লাভ করেছিলেন রাম, তাই রাবণ বধ সম্ভব হয়েছিল। বিষ্ণুর এক হাতে থাকে এই সুদর্শন চক্র যা ধর্মের প্রতীক। সুদর্শন চক্র বিশ্বকর্মা কিভাবে তৈরি করেছেন তা অন্যত্র আলোচনা করেছি।

বিষ্ণুর এক হাতে থাকে পদ্ম। পদ্ম হচ্ছে জ্ঞানের প্রতীক। এক হাতে থাকে শঙ্খ। এটি   যুদ্ধের প্রতীক। চতুর্থ হাতে থাকে গদা। এটি অশুভ নির্মুলের প্রতীক। নজরুল সেই কথাই বলেছেন, ‘আমি চক্র ও মহাশঙ্খ’। এর পরেই বলেন ‘আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড’। প্রণব মানে ওঁম (অউম), এই ওঁম ক্রমাগত উচ্চারণ করতে থাকলে ধ্বনির যে অত্যুঙ্গ অথচ শান্ত এক তরঙ্গ বা নাদ ওঠে তাই হলো প্রণব-নাদ।

‘আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বমিত্রা শিষ্য’

দুর্বাসা একজন ক্ষ্যাপা ক্রোধান্ধ ঋষি ছিলেন। তার মাতার নাম অনসূয়া এবং পিতার নাম অত্রি। দুর্বাসা অর্থ যার সঙ্গে বসবাস করা যায় না। কেন দুর্বাসা এতো ক্রোধান্বিত থাকতেন? কারণ তার জন্মই হয়েছে শিবের ক্রোধ থেকে। একবার ব্রহ্মার সঙ্গে শিবের মতানৈক্য দেখা দিলে শিব এতোই ক্রুদ্ধ হন যে ভয়ে সব দেবতা পালাতে শুরু করে। মহাদেবের স্ত্রী পার্বতী তার ক্রোধের কারণে তার সঙ্গে বসবাসে অপারগতা জানান। মহাদেব বা শিব তখন তার ক্রোধকে অত্রির স্ত্রী অনসূয়ার গর্ভে স্থাপন করে শান্ত হন। এই ক্রোধ থেকেই অনসূয়ার পুত্র দুর্বাসার জন্ম হয়। ঋষি দুর্বাসা তার নিজের স্ত্রীকেও অভিশাপ দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। সেই গল্পটি বলছি। ঔর্ব মুনির কন্যা কন্দলীকে বিবাহ করেন দুর্বাসা। কন্দলী ছিলেন অত্যন্ত কলহপ্রিয়া নারী। বিয়ের সময় ঋষি ঔর্ব দুর্বাসাকে বলেন দুর্বাসা যেন তার শত দোষ মার্জনা করেন। দুর্বাসা মুনিও কথা দেন। কিন্তু অতি অল্পদিনের মধ্যেই কন্দলীর শত দোষের কোটা পূর্ণ হয়ে যায়। ১০১ তম দোষটি করার সঙ্গে সঙ্গেই দুর্বাসা মুনি অভিশাপের আগুনে নিজের স্ত্রী কন্দলীকে পুড়ে ছাই করে ফেলেন। দুর্বাশার অভিশাপে ইন্দ্র শ্রীহীন হয়েছেন, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কৃষ্ণের মানবদেহ ত্যাগের কারণও দুর্বাসার শাপ। 

বিশ্বামিত্র একজন রাজা ছিলেন। তার পিতার নাম গাধি। গাধির পিতা ছিলেন কান্যকুজ্বরাজ কুশিক। অর্থাৎ কুশিকের পৌত্র বিশ্বমিত্রা। তিনি সসৈন্য মৃগয়ায় গিয়ে পিপাসার্ত হয়ে বশিষ্টের আশ্রমে আসেন। বশিষ্ট একজন ঋষি, ব্রহ্মার মানসপুত্র। বশিষ্টের ছিল এক কামধেনু। কামধেনুর নাম ছিল নন্দিনী। বশিষ্ট নন্দিনীকে বলেন রাজাকে আপ্যায়ন করতে। নন্দিনী ধুমায়িত অন্নরাশি, ডাল, দধি, পায়েশ, ঘৃত, মিষ্টান্ন দিয়ে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করেন। নন্দিনীর মনোহর আকৃতি দেখে বিশ্বমিত্রা ঋষিকে বলেন, আমার দশ কোটি ধেনু ও রাজ্য নিয়ে আমাকে এই কামধেনুটি দিয়ে দিন। বশিষ্ট তাতে রাজী না হলে বিশ্বমিত্রা জোর করে কামধেনু ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। নন্দিনী তখন বলেন, ভগবান বিশ্বমিত্রার সৈন্যদের কষাঘাতে আমি অনাথের মত বিলাপ করছি আর আপনি তা উপেক্ষা করছেন? বশিষ্ট বলেন ক্ষত্রিয়ের বল তেজ আর ব্রাহ্মণের বল ক্ষমায়। কল্যাণী, আমি তোমাকে ত্যাগ করিনি। যদি তোমার শক্তি থাকে তো আমার কাছেই থাকো। পয়স্বিনী কামধেনু তখন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে হাম্বা রবে সৈন্যদের বিতাড়িত করে। তার বিভিন্ন অঙ্গ থেকে নানান রকম সৈন্য সামন্ত বেরিয়ে এসে বিশ্বমিত্রার সৈন্যদের পর্যুদস্ত করে।

পরাজিত বিশ্বমিত্রা ক্ষত্রিয় বলকে ধিক দিয়ে বললেন, ব্রহ্মতেজই বল। এরপর বিশ্বমিত্রা রাজ্য ত্যাগ করে তপস্যায় আত্মত্যাগ করেন এবং ক্ষত্রিয় হয়েও তপস্যার জোরে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন। 

‘আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছ্বাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল’

প্রভঞ্জন শব্দের অর্থ ঝড়োবায়ু। কবি এই অর্থেই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তবে এই ঝড়োবায়ুরও একটি পৌরাণিক পরিচয় আছে। গন্ধবর্তী নগরে দিকপতি নামে এক বায়ু ছিল। দিকপতি মানে তিনি সকল দিকের রাজা ছিলেন, ইচ্ছেমত যে কোনো দিক থেকে প্রবাহিত হতে পারতেন এবং দিক নির্দেশ করতে পারতেন। অর্থাৎ সকল দিকের খোঁজ খবর রাখতেন। দিকপতি উপাধি বা বর লাভ করেছিলেন তিনি মহাদেবের আরাধনা করে। 

‘আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্ত মানব-বিজয়-কেতন’

দেবরাজ ইন্দ্রের প্রধান কাজ ছিল বজ্রধারণ, বৃষ্টিপ্রদান এবং নদী ও সমুদ্রের জল প্রবাহিত করা। ইন্দ্র একটি পৌরাণিক চরিত্র। তার পিতার নাম ছিল কশ্যপ এবং মাতার নাম অদিতি। তাকে দেবরাজ এজন্য বলা হত কারণ তার শক্তি দ্বারা অন্যান্য দেবতা পরিচালিত হত। বজ্র তার প্রধান অস্ত্র। তার নামেই স্বর্গের নাম হয় ইন্দ্রলোক। বেদ অনুযায়ী ইন্দ্র কোনো আলাদা চরিত্র নয়, তিনি পরম ব্রহ্মার একটি গুণবাচক প্রকাশ। ইন্দ্রের রাজধানীর নাম ছিল বৈজয়ন্ত। এ-কারণেই কবি বলেছেন আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্ত, অর্থাৎ পৃথিবীর এমন এক দরোজা যার ভেতরে স্বর্গরাজ্য বিদ্যমান। এবং সেই স্বর্গটি কেমন, যেখানে ‘মানব বিজয়-কেতন’ অর্থাৎ বড়ূ চণ্ডীদাসের ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’ পঙক্তিরই প্রতিধ্বনি। মানবতাই প্রধান যেই পৃথিবীতে সেটিই স্বর্গ, আমি সেই স্বর্গের দরোজা। 

‘তাজি বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার’     

তিনি একই সঙ্গে যেমন বিষ্ণুর গোলক এবং খোদার আরশ ছেদিয়া উঠেছেন ঠিক তেমনি মুহম্মদের বোররাক এবং ইন্দ্রের উচ্চৈঃশ্রবাকে একই সঙ্গে নিজের বাহন করেছেন। যারা নবী মুহম্মদের মেরাজের ঘটনা জানেন না তাদের জন্য বলছি, তিনি অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন (বলা হয় আলোর গতিসম্পন্ন) এক প্রাণী বোররাকে চড়ে পৃথিবী থেকে উড়ে গিয়েছিলেন আল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে। বোররাক তাকে সাত আকাশ অতিক্রম করে সিদ্দাতুল মুন্তাহাব পর্যন্ত নিয়ে যান। সিদ্দাতুল মুন্তাহাব হচ্ছে সীমান্ত বৃক্ষ। এরপরে বোররাকের আর যাওয়ার অনুমতি নেই। সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল অন্য এক যান তার নাম রফরফ। রফরফ তাকে সিদ্দাতুল মুন্তাহাব থেকে তুলে সত্তুর হাজার আলোর পর্দা পার হয়ে নিয়ে যান লওহে মহফুজে, যেখানে আরশের ওপর বসে আছেন আল্লাহ। পৃথিবীর হিসেবে এই ভ্রমণের ব্যপ্তি ছিল ২৭ বছর। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ঘটে যায় চোখের পলকে। তিনি ওজু করে বোররাকে চড়েন, ফিরে এসে দেখেন অজুর পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। 

আগে এক অংশে বলেছি দেবতারা অমরত্বের অমৃত অন্বেষণে সমুদ্র মন্থন করেছিলেন। সেই সময় সমুদ্র থেকে নানান কিছু উঠে আসে। সাত মস্তক বিশিষ্ট্য একটি শাদা ঘোড়াও তখন ক্ষীরসাগর থেকে উঠে আসে। এই ঘোড়াটির নামই ছিল উচ্চৈঃশ্রবা। দেবরাজ ইন্দ্র উচ্চৈঃশ্রবাকে কব্জা করেন এবং নিজের বাহন বানান। উচ্চৈঃশ্রবার কথা ভগবৎ গীতায়ও উল্লেখ আছে। উচ্চৈঃশ্রবার সাতটি মাথা ছিল, গায়ের রঙ ছিল শাদা এবং ওড়ার জন্য ছিল দুটি ডানা। এটিকে ঘোটককুলের রাজা মনে করা হয়।

এবার একটি মজার ঘটনা বলি। আগেই বলেছি দুর্বাসা মুনির বরে কুন্তি দেবতাদের সাক্ষাৎ লাভ করতে পারতেন এবং তাদের প্রসাদ খেয়ে গর্ভবতী হতে পারতেন। কুন্তির স্বামী পাণ্ডু যৌনমিলনে মারা যাবেন এই অভিশাপ প্রাপ্ত হয়েছিলেন বলে কুন্তির গর্ভে জন্ম নেয়া পাণ্ডবেরা ছিল বিভিন্ন দেবতার সন্তান। মহাবীর অর্জুন ছিলেন ইন্দ্রের পুত্র। দেবরাজ ইন্দ্রের আমন্ত্রণে অর্জুন স্বর্গ পরিভ্রমণে যান। সেই ভ্রমণের সঙ্গে মেরাজের ঘটনার কিছুটা মিল পেতে পারেন।  

আকাশ আলোকিত ও মেঘ বিদীর্ণ করে গম্ভীরনাদে ইন্দ্রের রথ অর্জুনের সম্মুখে উপস্থিত হল। বায়ুগতি সম্পন্ন দশ সহস্র অশ্ব সেই রথ বহন করে। রথের সারথি মাতলি অর্জুনকে বললেন, ইন্দ্রপুত্র, রথে ওঠো, দেবরাজ ও অন্য দেবতারা তোমাকে দেখার জন্য অপেক্ষায় আছে। আশ্চর্য রথ আকাশে উঠে মনুষ্যলোক থেকে অদৃশ্য হল। চন্দ্র, সূর্য পার হয়ে উজ্জ্বল ও বৃহৎ তারকার আলো দেখতে পেল অর্জুন। সাধু মাতলি বললেন, পার্থ, ভূতল থেকে যাদের তারকাস্বরূপ দেখেছ সেই পূণ্যবানেরা এখানে স্বস্থানে অবস্থান করছেন। 

অর্জুন অমরাবতীতে এলে দেবতা, গন্ধর্ব, সিদ্ধ ও মহর্ষিগণ হৃষ্ট হয়ে তাঁর সংবর্ধনা করলেন। তিনি নত মস্তকে প্রণাম করলে ইন্দ্র তাকে কোলে নিয়ে নিজের সিংহাসনে বসালেন। তুম্বুরু গন্ধর্বগণ গাইতে লাগলেন, ঘৃতাচী, মেনকা, রম্ভা, উর্বশী প্রভৃতি মনোহারিণী অপ্সরারা নাচতে লাগলেন। এরপর দেবতারা পাদ্য, অর্ঘ্য ও আচমনীয় দিয়ে তাকে ইন্দ্রের ভবনে নিয়ে গেলেন। ইন্দ্রের কাছে নানান রকম অস্ত্র চালনা শিক্ষা করে অর্জুন পাঁচ বৎসর অমরাবতীতে সুখে বাস করেন। তিনি ইন্দ্রের নির্দেশে গন্ধর্ব চিত্রসেনের কাছে নৃত্য গীত ও বাদ্য শেখেন। একদিন চিত্রসেন উর্বশীকে জানালেন, কল্যাণী, দেবরাজের আদেশে তোমাকে জানাচ্ছি যে অর্জুন তোমার প্রতি আসক্ত হয়েছেন। স্বর্গের অপ্সরা উর্বশী প্রীত হয়ে বলেন, আমিও তাঁর অনুরক্ত। সখা, তুমি যাও, আমি অর্জুনের সঙ্গে মিলিত হব। উর্বশী স্নান করে মনোহর অলঙ্কার ও গন্ধমাল্য ধারণ করে সান্ধ্যকালে চন্দ্র উদিত হলে অর্জুনের মহলে প্রবেশ করেন। তাঁর কোমল কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশপাশ পুস্পমালায় ভূষিত, মুখচন্দ্র যেন গগনের চন্দ্রকে আহ্বান করছে, চন্দন-চর্চিত হারশোভিত স্তনদ্বয় প্রতি পদক্ষেপে লম্ফিত হচ্ছে। অল্প মদ্যপান, কামাবেশ ও বিলাস-প্রসাদনের জন্য তিনি অতিশয় দর্শনীয়া হলেন। কিন্তু অর্জুন তাকে দেখে চক্ষু বন্ধ করে ফেলেন। তিনি উর্বশীকে নানান কৌশলে প্রত্যাখ্যান করলে উর্বশী তাকে নপুংসক বলে ভর্ৎসনা করেন এবং নপুংসক হবার অভিশাপ দেন। উর্বশী অভিশাপ দিয়েছেন শুনে ইন্দ্র স্মিতমুখে অর্জুনকে বলেন, বৎস, তোমার জন্য কুন্তী আজ সুপুত্রবতী হলেন। তুমি ধৈর্য্যে ঋষিগণকেও পরাজিত করেছ। উর্বশীর অভিশাপ ফলবে। অজ্ঞাতবাসকালে তুমি এক বৎসর নপুংসক নর্তক হয়ে থাকবে। এরপরে আবার পুরুষত্ব পাবে। 

‘ধরি বাসুকীর ফণা জাপটি’ 

তিনি যেন তেন কোনো  সাপের ফণা জাপটে ধরেননি, ধরেছেন একেবারে বাসুকীর ফণা, যে কি-না সর্পকূলের রাজা। বাসুকী কশ্যপ ও তার স্ত্রী কদ্রুর পুত্র। তার এক বোন ছিল যার নাম মনসা। বাসুকীর স্ত্রীর নাম তুষ্টি। বাসুকী ভগবান শিবের গলা পেঁচিয়ে থাকতেন। সমুদ্র মন্থনের সময় বাসুকীকে রজ্জু হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। কথিত আছে সমুদ্র মন্থনে উত্থিত অমৃত শুধু দেবতারা পান করেন, অসুরদের অমৃতবঞ্চিত করা হয়েছিল বলে তারা সহস্র বর্ষ সমুদ্র মন্থন করতে থাকেন। তখন বাসুকী তার মারাত্মক বিষ হলাহল ছেড়ে দেন। তা দিয়েই বিশ্ব বিপন্ন হতে বসেছিল। পরে শিব সেই বিষ নিজের কন্ঠে ঢেলে দিয়ে বিশ্বকে রক্ষা করেন। 

‘ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’

চার প্রধান ফেরেশতার একজন জিব্রাইল, যিনি আল্লাহর দূত। জিব্রাইলের প্রধান কাজ আল্লাহর বাণী নবী-রাসুলদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সকল ফেরেশতা আল্লাহর নূর বা আলোর তৈরী, সেই অর্থে জিব্রাইলের ডানাকে আগুনের ডানা বলা যেতে পারে। ফেরেশতাদের মধ্যে একজন ছিলেন আযাজিল, যিনি পরে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে ইবলিস বা শয়তান হয়ে যান, তিনি আগুনের তৈরী। আসলে আযাজিল ছিলেন এক জ্বিন-শিশু, অতিরিক্ত এবাদত-বন্দেগি করে ফেরেশতাদের কাতারে শামিল হন। ফেরেশতা, জ্বিন এবং ইনসান, এই তিন প্রকার প্রাণী তিন ধরণের কাঁচামাল দিয়ে তৈরি করেন আল্লাহ। ফেরেশতাদের তৈরি করেন আল্লাহর নূর দিয়ে, জ্বিনদের তৈরি করেন আগুন দিয়ে এবং ইনসান বা মানুষ তৈরি করেন মাটি দিয়ে। সেই দিক থেকে জিব্রাইলের ডানাকে আগুনের ডানা বলায় কেউ কেউ অখুশি হতে পারেন। তবে এটিকে আলোর প্রতীক হিসেবে দেখা যেতে পারে। এই কবিতাটির মূল সুর হচ্ছে দ্রোহ তাই আলোর মতো স্নিগ্ধ শব্দ ব্যবহার না করে নজরুল আগুনের মতো তেজোদ্দীপ্ত শব্দ ব্যবহার করেছেন। এই প্রয়োগটিকে যেন ধর্মান্ধ মানুষেরা ভুল না বোঝেন তাই এই ব্যাখ্যাটি দেওয়া বোধ করি দরকার ছিল।

‘আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী’

গ্রীক পুরাণ থেকে এই একটি শব্দই কবি তুলে এনেছেন বিদ্রোহী কবিতার জন্য। অর্ফিয়াস দেবতা অ্যাপোলোর পুত্র। তিনি ছিলেন একজন সঙ্গীত সাধক, কবি এবং দেবতা। তার দখলে ছিল সুরের জাদু। তিনি সঙ্গীতের জাদু দিয়ে পশু-পাখি, বৃক্ষ-তৃণ, দেবতা-রাক্ষস সবাইকে বশ করতে পারতেন। তার বাজনা শুনে পাথরেরা নৃত্য করত। অর্ফিয়াস যে বাদ্যযন্ত্রটি বাজাতেন সেটির নাম লায়ার (Lyre)। উপরের দিকটা ঢেউখেলানো ইউ আকৃতির একটি কাঠের মধ্যে ৭টি তার বাঁধা বাদ্যযন্ত্র লায়ার। এই বাদ্যযন্ত্রটি প্রথম আবিস্কৃত হয় খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ অব্দে, মিশরে।   

কাঠ এবং তার দিয়ে নির্মিত বাধ্যযন্ত্র হচ্ছে লুট (Lute)। লুট বাজানো হয় তারের মধ্যে আঙুল বা অন্য কিছু দিয়ে তরঙ্গ তুলে। ফাপা দণ্ডের মধ্যে ছিদ্র করে বানানো হয় বাঁশি (Flute)। বাঁশি বাজানো হয় ফুঁ দিয়ে। দুটি বাদ্যযন্ত্রই খুব কাছকাছি এবং সমগোত্রীয়। অর্ফিয়াসের লায়ার একটি লুট কিন্তু এটিকে বাঁশরী বলে কাজী নজরুল ইসলাম তেমন ভুল করেননি। অথবা কবি অর্ফিয়াসের হাতে কল্পনায় বাঁশিই দেখেছেন। কিন্তু এখানে বক্তব্যটা হচ্ছে এই, তিনি এমন এক শিল্পীর বাদ্যযন্ত্র যার বাজনা শুনে পৃথিবীর সকলেই বশ হয়ে যান। সেই সময়ে উপমহাদেশের কে না নজরুলের গান, কবিতার ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন।

‘আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী’

অর্ফিয়াসের চার পঙক্তি পরেই কবি বলেন ‘আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী’। শ্রীকৃষ্ণই শ্যাম। তার প্রেমিক রূপটি ‘শ্যামের বাঁশি’র মধ্য দিয়ে চিত্রায়িত হয়েছে বেশি। কৃষ্ণ প্রধানত তিন প্রকারের বাঁশি বাজাতেন, সেগুলি হচ্ছে বেনু, মুরলী এবং বংশী। বেনু সবচেয়ে ছোটো। এতে ছয়টি ছিদ্র থাকে। মুরলী এক হাত লম্বা, এর মাথায় একটি এবং গায়ে চারটি ছিদ্র থাকে। বংশী মুরলীর চেয়ে একটু ছোটো। এতে নয়টি ছিদ্র থাকে। কৃষ্ণের প্রিয় অস্ত্র সুদর্শনচক্র। বাঁশিও ছিল তার খুব প্রিয়। তিনি সব সময় বাঁশিকে নিজের অঙ্গের মতো সঙ্গে ধারণ করতেন। এর কারণ হিসেবে একটি গল্প আছে। একবার বাঁশঝাড়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি বাঁশকে তার জন্য প্রাণত্যাগ করতে বলেন। বাঁশ সানন্দে কৃষ্ণের জন্য প্রাণত্যাগ করে। সেই বাঁশ দিয়ে তিনি বাঁশি তৈরি করেন। যেহেতু বাঁশ তার জন্য প্রাণত্যাগ করেছে তাই তিনি তাকে মর্যাদা দিতেই বাঁশিকে সারাক্ষণ নিজের অঙ্গের মতো ধারণ করেন। অর্ফিয়াসের মতোই শ্যামের বাঁশিতেও জাদু ছিল। তার বাঁশির সুরে রাধা এবং গোপিনীরাই শুধু পাগল হয়নি, বনের পশুপাখি, মানুষ ও দেবতা সকলেই তার বাঁশি শুনে মুগ্ধ হত। ভগবান বিষ্ণু নয় বার নয়টি অবতাররূপে পৃথিবীতে এসেছেন। অষ্টম অবতার ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। নবম বার তিনি এসেছিলেন বুদ্ধ হিসেবে। তাই গৌতম বুদ্ধকেও হিন্দুরা তাদের অবতার হিসেবে মানে। দশম বার তিনি আসবেন কলিযুগে, তখন তার নাম হবে কল্কি অবতার।

কৃষ্ণের বাঁশি নিয়ে অনেক গল্প আছে। তার বাঁশি বাজানো শেখার গল্পটি বলি। এক বৃদ্ধকে বাঁশি বাজাতে দেখে শিশু কৃষ্ণ বলেন, আমি বাঁশি বাজানো শিখতে চাই। বৃদ্ধ বলেন তুমি খুব ছোটো, এত কম বয়সে শিখতে পারবে না। কৃষ্ণ তখন কাঁদতে শুরু করেন। বৃদ্ধ তার কান্না শুনে দয়ার্দ্র হন। তখন কৃষ্ণের হাতে একটি বাঁশি দিয়ে বলেন, আমি আগে ফুঁ দেই, ঠিক একইভাবে তুমি পরে ফুঁ দেবে। বৃদ্ধ বাশিতে ফুঁ দেওয়ার পরে কৃষ্ণ ফুঁ দিলেন। তখন বাঁশিতে এমন এক সুর উঠলো যা ইহলোকে এবং ইন্দ্রলোকে আর কেউ কখনো শোনেনি। বৃদ্ধ বুঝে গেলেন এই শিশু সাধারণ কোনো শিশু নয়। বৃদ্ধ তখন শিশু কৃষ্ণের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। 

বলা হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল তাল কৃষ্ণের বাঁশির সুরে নিয়ন্ত্রিত। 

‘ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া’

মৃত্যুর পরে পাপীদের শাস্তি ভোগের কথা সব ধর্মেই আছে। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন পাপীদের শাস্তি দেওয়া হবে নরকে, মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন তাদের স্থান হবে দোজখে। কবি এই কবিতার অন্য অনেক জায়গার মতো এখানেও দুই ধর্মের প্রসঙ্গ একসাথে টেনেছেন। তিনি সপ্ত নরকের কথা বলেছেন। মুসলমান ধর্মে সাতটি দোজখের কথা খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও হিন্দুধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে কখনো ২৮ টি, কখনো ২১ টি, কখনো ৭টি এবং কখনো ৪টি নরকের কথা উল্লেখ আছে। সপ্ত নরক বলতে তিনি হিন্দুদের ৭টি নরকের কথাই বলেছেন, মুসলমানদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে একটি দোজখের নাম উল্লেখ করেছেন ‘হাবিয়া’ যেটি সবচেয়ে বড়ো ও ভয়ঙ্কর দোজখ। তিনি বলেছেন, ‘আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া/ ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া’। অর্থাৎ কবি নিজের দ্রোহী তেজের এমন এক উচ্চাসনে উঠে গেছেন যখন তার ভয়ে সাত (সব) নরক এবং সর্বোচ্চ দোজখও নিভে যায়।

‘আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু বক্ষ হইতে যুগল কন্যা’

এই বিষয়টি বোঝার জন্য আমাকেও সমুদ্রমন্থনে নামতে হয়েছে। দশ অবতাররূপী বিষ্ণুর ভিন্ন ভিন্ন রূপের ছটা সহ্য করতে হয়েছে, মুগ্ধও হয়েছি এই প্রগাঢ় অবগাহনে। বিষ্ণু বক্ষে কোন যুগল কন্যা স্থাপিত যা কবিকে ছিনিয়ে আনতে হয়েছে? আসুন দেখা যাক কে ছিলেন বিষ্ণু। ব্রহ্মাকে সর্বোচ্চ ভগবান মনে করা হয় অথচ সেই ব্রহ্মার জন্মও নাকি বিষ্ণুর নাভী থেকে হয়েছে। তাহলে বিষ্ণু কে? বিষ্ণু বৈষ্ণব ধর্মের সর্বোচ্চ ঈশ্বর বা পরমেশ্বর। সত্যযুগে বিষ্ণু চার বার আবির্ভূত হন। প্রথমবার আসেন মৎস্যরূপে। বিষ্ণুর মৎস্য অবতাররূপে আবির্ভাবের একটি মজার গল্প আছে। পৃথিবীর প্রথম মানব মনু নদীতে হাত ধুতে গেলে তার হাতে একটি ছোট্ট মাছ উঠে আসে। তিনি সেটিকে একটি জলপাত্রে এনে রাখেন। মৎস্যটি খুব দ্রুত বড়ো হতে থাকলে তিনি তাকে পুকুরে, পরে নদীতে এবং সবশেষে সমুদ্রে রাখেন। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয় না। মৎস্যটি অতিকায় বৃহৎ রূপ ধারণ করে এবং মনুকে বলে সাত দিনের মধ্যে মহাপ্রলয় ঘটবে। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। সে যেন সকল ঔষধি গাছ,  সপ্তর্ষী, বীজ, বাসুকী নাগ ও অন্যান্য প্রাণীকে নিয়ে একটি নৌকায় ওঠে। এরপর মহাপ্রলয়ে সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেলে মনু ও তার নৌকায় রাখা সকল প্রাণী বেঁচে যায়। এই ঘটনাটির সঙ্গে মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত নূহের প্লাবনের মিল পাওয়া যায়।

দ্বিতীয় বার বিষ্ণু আসে কূর্ম বা কচ্ছপ অবতাররূপে। এই ঘটনাটি ঘটে সমুদ্রমন্থনকালে।  তৃতীয় বার তিনি আসেন বরাহের রূপ ধরে। পুরাণে বর্ণিত আছে হীরণ্যক্ষ নামক এক রাক্ষস ভূদেবীকে (বা পৃথিবীকে) সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন তার স্তন্য পান করার জন্য। বিষ্ণু বরাহ-অবতার (শূকরাকৃতি) হয়ে এক হাজার বর্ষ যুদ্ধ করে হীরণ্যক্ষকে পরাজিত করেন এবং হত্যা করেন। এরপর ভূদেবীকে সমুদ্রের নিচ থেকে তুলে আনেন এবং তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।

সত্যযুগে তিনি সর্বশেষ আবির্ভূত হন নৃসিংহরূপে। দেহ মানুষের কিন্তু মুখ সিংহের। বেদেও মানুষ ও সিংহের দেহ সম্বলিত বনচারী দেবতার কথা উল্লেখ আছে। হীরণ্যক্ষের মৃত্যুর পর তার ভাই হীরণ্যকশিপু প্রচণ্ড বিষ্ণু বিদ্বেষী ছিলেন। তিনি বিষ্ণুর ওপর খুব ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু হীরণ্যকশিপুর স্ত্রী কায়াদুর গর্ভে জন্ম নেয়া পুত্র প্রহ্লাদ, যিনি ঘটনাক্রমে নারদের ঘরে বেড়ে ওঠেন, ছিলেন ভীষণ বিষ্ণুভক্ত। এজন্য ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি নিজ পুত্রকেও হত্যা করতে চেষ্টা করেন। হীরণ্যকশিপু তার পুত্র প্রহ্লাদকে জিজ্ঞেস করেন, কোথায় আছে বিষ্ণু? প্রহ্লাদ একটি স্তম্ভ দেখিয়ে বলেন, এখানে তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধান্বিত হয়ে গদার আঘাতে তিনি স্তম্ভটি ভেঙে ফেলেন। তখন সেখান থেকে অর্ধেক মানুষ অর্ধেক সিংহরূপী নৃসিংহ অবতার বেরিয়ে আসেন। হীরণ্যকশিপুর বর ছিল যে তাকে ভূমিতে বা আকাশে হত্যা করা যাবে না। তাকে দিনে কিংবা রাতে হত্যা করা যাবে না। নৃসিংহ তাকে দিন ও রাত্রির মাঝখানে, প্রদোষকালে, আপন জঙ্ঘার ওপর রেখে হত্যা করেন।

ত্রেতা যুগে তার আবির্ভাব ঘটে তিনবার। প্রথমবার আসেন খর্বাকৃতির বামন হয়ে। ত্রেতাযুগে অসুরদের দ্বারা দেবতারা পরাজিত হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। তখন দেবমাতা অদিতি পুনরায় শক্তিশালী পুত্রের জন্য বিষ্ণুর আরাধনা করেন। ভগবান বিষ্ণু তখন কশ্যপের ঔরসে অদিতির গর্ভে জন্মগ্রহণের অঙ্গীকার করেন। যথারীতি তার জন্ম হয় বামন অবতাররূপে। এরপর তিনি জমদগ্নি এবং রেণুকার ঘরে পরশুরাম হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। জমদগ্নি ব্রাহ্মণ ছিলেন কিন্তু রেণুকা ছিলেন ক্ষত্রিয়। পরশুরাম ছিলন ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়। কঠোর তপস্যা করে তিনি শিবের নিকট থেকে অস্ত্র হিসেবে পরশু বা কুঠারলাভ করেন। অযোধ্যার রাজা রাম বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। রামের বনবাস, রাবণের সীতা হরণ এবং রাম-রাবণের যুদ্ধ ও রামের লঙ্কা বিজয়ের ওপর প্রচুর সাহিত্য রচিত হয়েছে। মোটামুটি এইসব গল্প আমাদের সকলেরই জানা।

এরপর আসে দ্বাপর যুগ। এই যুগে তিনি কৃষ্ণ অবতাররূপে আবির্ভুত হত। শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে অন্যত্র কিছুটা আলোকপাত করেছি। কলি যুগ শুরু হলে হিন্দুধর্মের বৈষ্ণব শাখা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন বিষ্ণুর নবম অবতাররূপে বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ নিজে তা অস্বীকার করে বলেছেন তিনি ভগবান বা অবতার নন। বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবতপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ, অগ্নিপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, পদ্মপুরাণ প্রভৃতি পুরাণে বুদ্ধের কথা উল্লেখ আছে। ভবিষ্যপুরাণে বর্ণিত আছে, ‘এই সময়, কলি যুগে, বিষ্ণু শাক্যমুনি গৌতম রূপে জন্মগ্রহণ করলেন’। হিন্দু পণ্ডিতেরা মনে করেন হিন্দুদের মধ্যে প্রাণী হত্যা বন্ধ করার জন্য ভগবান বিষ্ণু বুদ্ধ অবতাররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। 

বিষ্ণুর সহস্র নাম আছে। এটি শুধু কথার কথা না তার এক হাজার নামের তালিকা সম্বলিত স্তোত্র হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিষ্ণুনাম জপ করার কথা বৈষ্ণবদের প্রায়শই বলতে শুনি। তার সহস্ত্র নামের মধ্যে শিবের নামও আছে। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন অন্য দুই প্রধান অবতার শিব এবং ব্রহ্মা বিষ্ণুর মধ্যেই অবস্থান করেন। 

সমুদ্রমন্থনে উঠে আসা লক্ষ্মী বিষ্ণুর স্ত্রী ছিলেন। এ ছাড়া বিষ্ণুর দেহ থেকে ব্রহ্মার জন্মের সময় দূর্গার আবির্ভাব ঘটেছিল। বরাহ অবতার হিসেবে তিনি ভূদেবীকে বিয়ে করেন। রাম অবতাররূপে তিনি সীতাকে পত্নী হিসেবে পেয়েছিলেন এবং কৃষ্ণ অবতাররূপে রাধাকে করেছিলেন প্রেমিকা। এ ছাড়া ষোল’শ বা ষোল হাজার গোপিনীর কথাও আমরা জানি। মোটামুটি এই হলো বিষ্ণুর নারীযোগ। 

তাহলে নজরুল বিষ্ণু বক্ষ হইতে কোন দুই কন্যাকে ছিনিয়ে নেবার হুমকি দিলেন? এটা কি এই কবিতার ত্রুটি? কন্যা এখানে প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিষ্ণুর বক্ষে আমরা দুটি জিনিস দেখতে পাই। একটি হচ্ছে শ্রীবৎস চিহ্ন, অন্যটি কৌস্তভ মনি। শ্রীবৎস চিহ্নের ভেতরে তার প্রিয়তমা স্ত্রী লক্ষ্মী  বাস করেন। এটি তার প্রেম। কৌস্তব মনি হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন। শিবের মতে বিষ্ণু ছাড়া অন্য কোনো দেবতার এই রত্ন ধারণ করার ক্ষমতা নেই। এই দুটিই বিষ্ণুর অত্যন্ত প্রিয় এবং তা সর্বদা তার বুকে থাকত। কবি এই দুটিকেই দুই কন্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। 

‘আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্ব্বনাশী

আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’

ছিন্নমস্তা এবং চণ্ডী ভিন্ন নামে একই চরিত্র। ছিন্নমস্তার অন্য নাম প্রচণ্ডচণ্ডীকা। ছিন্নমস্তা শিবের স্ত্রী পার্বতীর ভিন্ন রূপ বলে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ আছে। তিনি নিজের মাথা কেটে এক হাতে ধরে আছেন। তার মস্তক বিযুক্ত ধর থেকে ত্রিধারায় রক্ত ফিনকি দিয়ে উঠছে। নিজেরই বিচ্ছিন্ন মস্তক একটি ধারা পান করছে এবং তার দুই সখী ডাকিনী ও বর্ণনী (যাদের অন্য নাম জয়া ও বিজয়া) অন্য দুটি ধারা থেকে পান করছে। তার পায়ের নিচে সঙ্গমরত দম্পতি পিষ্ট হতে দেখা যায়। তান্ত্রিক ও তিব্বতী বৌদ্ধদের এক গুরুত্বপূর্ণ দেবী ছিন্নমুণ্ডা। গবেষকেরা মনে করেন হিন্দুদের ছিন্নমস্তা এবং বৌদ্ধদের ছিন্নমুণ্ডা একই দেবী। 

ছিন্নমস্তাকে নিয়ে বেশ কিছু কিংবদন্তি আছে। একদিন মন্দাকিনী নদীতে স্নান করতে গেলে শিবের স্ত্রী পার্বতী কামার্ত হয়ে পড়েন। তখন তার দেহ কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। তার দুই সখী ক্ষুধার্ত হলে তিনি নখ দিয়ে নিজের মস্তক বিযুক্ত করে সখীদের রক্তপান করান। এই কাজের মধ্য দিয়ে তিনি নিজের কাম প্রশমিত করেন বলে ছিন্নমস্তাকে কামের এবং কাম নিয়ন্ত্রণের দেবী মনে করা হয়। অন্য এক গল্পে আছে দেবাসুরের যুদ্ধে দেবতারা মহাশক্তির কাছে শক্তি প্রার্থনা করলে দেবী পার্বতী প্রচণ্ডচণ্ডীকা হিসেবে দেবগণের সাহায্যার্থে আবির্ভূত হন। এজন্য তার অন্য নাম প্রচণ্ডচণ্ডীকা। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও তার ক্রোধ থামেনি। তাই তিনি নিজের মস্তক নিজেই ছিন্ন করেন। তার দুই সখী ডাকিনী ও বর্ণনীর জন্ম নিয়েও গল্প আছে। একবার শিবের সঙ্গে সঙ্গমকালে তিনি বিপরীত রতিতে (শিবের ওপরে) অবস্থান করছিলেন। এ সময়ে শিবের অনভিপ্রেত বীর্যস্খলন ঘটে গেলে তিনি প্রচণ্ড রেগে যান। তখন তার ক্রোধ থেকে জন্ম নেয় ডাকিনী ও বর্ণনী। 

দেবীমাহাত্ম্যম গ্রন্থে ত্রিনয়না চণ্ডীর কথা উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থে তাকে সর্বোচ্চ দেবী বলা হয়েছে। তার মধ্যেই দূর্গা, কালী এবং সরস্বতীর সমন্বয় ঘটেছে। পশ্চিমঙ্গের হিন্দুরা চণ্ডীপূজা করেন। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্য চণ্ডীমঙ্গলকাব্য। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি কবি মানিক দত্ত। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, মুক্তারাম সেন, হরিরাম, দ্বিজ মাধব প্রভৃতি কবি চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করেন। 

বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল নিজের প্রচণ্ডতা বোঝাতেই ছিন্নমস্তা বা চণ্ডীকে এনেছেন এবং তিনি একই সঙ্গে কতটা শান্ত তা প্রকাশের জন্য বলেছেন জাহান্নামের আগুনে বসেও তিনি পুস্পের হাসি হাসেন। এই কবিতার বিভিন্ন স্তবকে তিনি নিজের সর্বোচ্চ বৈপরীত্য প্রকাশ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে কবিতাটি কবিদের স্বাধীন সত্ত্বার এক অন্যতম মেনিফেস্টো হয়ে ওঠে।

ইসলাম ধর্মমতে সাত দোযখের একটি, সবচেয়ে ছোটটি, হলো জাহান্নাম। অবশ্য শুধু দোজখ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবেও জাহান্নাম শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

‘আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার

নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার’

ভগবান বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার হিসেবে আবির্ভাব ঘটে পরশুরামের। ঋষি জমদগ্নি এবং ক্ষত্রিয় কন্যা রেণুকার পুত্র পরশুরাম। শিবের আরাধনা করে তিনি ব্রাহ্মণ হওয়া সত্বেও শিবপ্রদত্ত পরশু বা কুঠার যুদ্ধাস্ত্র লাভ করেন। জমদগ্নির ছিল এক অত্যাশ্চর্য ধেনু যেটি দেবরাজ ইন্দ্র তাকে উপহার দিয়েছিলেন। ঋষি বশিষ্টের কামধেনুর মতোই এই ধেনুটি বহুলোকের আপ্যায়ন করতে পারত। ক্ষত্রিয় রাজা কার্তবীর্য প্রলুব্ধ হয়ে জমদগ্নির ধেনুটি চুরি করে। এতে পরশুরাম ক্ষিপ্ত হয়। অন্য এক মতে একদিন পরশুরামের অনুপস্থিতিতে কার্তবীর্য তাদের গৃহে এসে জমদগ্নির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। ঘটনা যেটিই হোক পরশুরাম কার্তবীর্যের ওপর ক্ষুব্ধ হয় এবং তাকে ধাওয়া করে হত্যা করে। এই ঘটনায় কার্তবীর্যের বীরযোদ্ধা ক্ষত্রিয় পুত্রেরা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে ঋষি জমদগ্নিকে হত্যা করে। পিতৃহত্যার বদলে পিতৃহত্যা। পরশুরাম এতে এতোই ক্ষিপ্ত হন যে তিনি কার্তবীর্যের পুত্রদেরই শুধু না, প্রতিজ্ঞা করেন পৃথিবীকেই নিঃক্ষত্রিয় করে ফেলবেন। কথিত আছে তিনি পৃথিবীকে ১৯ বার, কোনো কোনো মতে ২১ বার, নিঃক্ষত্রিয় করেন। পরশুরামের ক্ষত্রিয় নিধনের ব্যাখ্যা হিশেবে বলা হয়, তখন দুষ্ট ক্ষত্রিয়ের সংখ্যা পৃথিবীতে খুব বেড়ে গিয়েছিল। পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পরশুরাম দুষ্ট ক্ষত্রিয়দের হত্যা করেন। 

মহাভারতে আছে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য এবং কর্ণকে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা দেন পরশুরাম। কর্ণ পরশুরামের কাছে মিথ্যা বলেছিলেন। নিজেকে ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। সেজন্য পরশুরাম তার যুদ্ধ-শিক্ষাগুরু হওয়া সত্বেও এই অভিশাপ দেন যে সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় সে তার যুদ্ধবিদ্যা ভুলে যাবে।

হিন্দুধর্মে যে আট চিরঞ্জীব পুরুষ আছেন পরশুরাম তাদের একজন। 

অন্যত্র বলেছি, পরশুরামের কঠোর কুঠার স্বীয় মাতাকেও হত্যা করতে কেঁপে ওঠেনি। তিনি তার আরাধ্য ভগবান শিবের সঙ্গে দেখা করতে কৈলাসে গেলে শিবপুত্র গনেশ তাকে বাঁধা দেওয়ায় তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে কুঠার ছুঁড়ে মারেন। এতে গণেশের দাঁত ভেঙে যায়। পরশুরামের কুঠার পিতা শিব-প্রদত্ত হওয়ায় গণেশ তা প্রতিহত করেননি।

কবি কঠোরতা বোঝানোর জন্য পরশুরামের কুঠার চিত্রকল্পটি ব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে নিঃক্ষত্রিয় করার একটি ভিন্ন অর্থ আছে। যুদ্ধবাজ ক্ষত্রিয়রা না থাকলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠীত হবে। 

‘আমি হল বলরাম স্কন্ধে

আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব

সৃষ্টির মহানন্দে’

বলরাম ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। বলরামের জন্ম নিয়ে একটি কিংবদন্তি আছে। কংসের কারাগারে বন্দি বসুদেব ও দেবকীর সপ্তম গর্ভে বলরাম আসেন। কিন্তু কংসের হাত থেকে শিশুটিকে রক্ষা করার জন্য শ্রীহরির নির্দেশে মহামায়া সেই ভ্রুণ দেবকীর গর্ভ থেকে সরিয়ে গোকুলের নন্দগৃহে রোহিণীর গর্ভে স্থাপন করেন। রোহিণীর গর্ভে শিশুটির জন্ম হলে যাদব বংশের গুরু গর্গাচার্জ তার নাম রাখেন বলরাম। 

বলরামকে কবি কেন হল বলরাম বলেছেন? তা জানতে হলে আমাদের আরো একটি গল্প জানতে হবে। বলরাম একদিন যমুনায় যান। তিনি যমুনাকে তার সঙ্গে খেলতে বলেন। যমুনা খেলতে রাজী না হওয়ায় তিনি যমুনাকে হল বা লাঙল দিয়ে টেনে নিয়ে আসেন। তখন তার নাম হয় হলধর। লাঙল সঙ্গে রাখার কারণে তাকে কৃষির দেবতাও বলা হয়। এই বিষয়টিই কবি এই চরণ দুটিতে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলরামের কাঁধে চড়ে তার লাঙল দিয়ে সৃষ্টির আনন্দে বিশ্বকে ‘উপাড়ি’ ফেলবেন, মানে কর্ষণ করবেন। 

আমি পড়ি আর বিস্মিত হই ২২ বছরের এক যুবক কবির মিথের কার্যকর ব্যবহার দেখে। 

‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন’

ভৃগু সম্পর্কে আগেও কিছুটা আলোকপাত করেছি। তিনি মহাজ্ঞানী সপ্তর্ষীর এক ঋষি এবং ব্রহ্মার দশ মানসপুত্রের একজন। ব্রহ্মার যে দশজন মানসপুত্র অর্থাৎ চিন্তাপ্রসূত সন্তান ছিলেন (ব্রেইনচাইল্ড বলা যেতে পারে) তারা হলেন, অঙ্গিরস, অত্রি, ভৃগু, চিত্রগুপ্ত, দক্ষ, হিমবান, জাম্বুবান, কাম, ক্রতু, কুমার, মরিচী, নারদ, পুলহ, পুলস্ত্য, শতরূপা, স্বয়ম্ভু মনু ও বশিষ্ঠ। এদেরকে প্রজাপতি ঋষি নামে অভিহিত করা হয়। ঋষিরা ছিলেন অগাধ জ্ঞানের অধিকারী। তারা দেবতা, রাক্ষস সকললেই অভিশাপ বা বর দিতে পারতেন।

ভৃগু ছিলেন ঋষিদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী। একদিন অন্য ঋষিরা এসে ভৃগুকে বলেন, শিব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু এই তিন ভগবানের মধ্যে কে সবচেয়ে বড়ো এই তর্কে ঋষিকূল বিভক্ত, আপনি তো সবচেয়ে জ্ঞানী ঋষি, আপনিই বলে দিন কে সবচেয়ে বড়ো। ভৃগু তখন ব্রহ্মা, শিব হয়ে বিষ্ণুর কাছে যান। যখন তিনি বিষ্ণুগৃহে উপস্থিত হন তখন বিষ্ণু ঘুমাচ্ছিলেন। বিষ্ণুর ঘুম ভাঙাতে ভৃগু ভগবানের বুকে পা ঠেকিয়ে ধাক্কা দেন। 

এই বিষয়টিকেই কবি এই পঙক্তিতে চিত্রায়িত করেছেন। এই প্রতীকের মাধ্যমে নজরুল ন্যায়ান্ধ বৃটিশরাজের বুকে লাথি দিয়ে তার ঘুম ভাঙাতে চেয়েছেন।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা