শান্তা মারিয়া
প্রখ্যাত আফ্রো-আমেরিকান লেখক অ্যালেক্স হ্যালির রুটস উপন্যাসটির কথা অনেকেই জানেন। অ্যালেক্স হ্যালি তার শিকড়ের সন্ধানে ফিরে গিয়েছিলেন আফ্রিকায়। খুঁজে পেয়েছিলেন তার পূর্ব পুরুষ কুন্তা কিন্তের জন্মগ্রাম। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী এবং অপরাজিত উপন্যাস দুটিও বহুল পঠিত। উপন্যাসের নায়ক অপু তার সন্তান কাজলকে নিয়ে আসে জন্মগ্রামে। ফিরে আসে তার শিকড়ের কাছে।
এমনিভাবে সকলকেই হয়তো কখনও না কখনও শিকড়ের সন্ধানে অভিযাত্রা করতে হয়। আজ বলতে চাই আমার সেই ফিরে দেখার কাহিনী। আমার পিতামহ প্রখ্যাত বহুভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্মস্থান বসিরহাটের পিয়ারা গ্রামে আমি সম্প্রতি গিয়েছিলাম এমনি শিকড়ের সন্ধানে। সে আজ থেকে একশ বছর আগের গল্প।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা, বসিরহাট মহকুমা, হারোয়ার পিয়ারা গ্রাম। শব্দগুলো ভীষণ পুরনো গানের মতো শুনে এসেছি শৈশব থেকে। কখনও দেখিনি। তবু মনে মনে কল্পনা করেছি। বাবার কাছে শুনতাম মুন্সিবাড়ির গল্প। তার বাপ দাদার ভিটের গল্প। মুন্সি মফিজুদ্দিনের সংসারের গল্প। বিদ্যাধরী নদীর গল্প।
শুরুটা পুরোই রূপকথা। কেউ বলে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির আমলে আবার কেউ বলে মোগল বাদশাহ শাহজাহানের সময় এক দরবেশ এসেছিলেন আরব থেকে দিল্লিতে। নাম তার আব্বাস মক্কী। সঙ্গে ছিলেন তার শিষ্য দরবেশ শেখ দারা মালিক।
বাংলার অবিভক্ত ২৪ পরগণার দেগঙ্গা, বেড়াচাঁপা, চন্দ্রকেতু রাজার গড়সহ বসিরহাটের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা ইসলাম ধর্ম প্রচারের অনুমতি চান। দরবেশরা যখন শাহী মহলে পৌছান তখন নাকি বাদশাহ ভোজনে বসেছিলেন। দরবেশদের আগমন সংবাদ পেয়ে ভোজন কক্ষেই তাদের স্বাগত জানান। তারপর চব্বিশ পরগনার অন্যতম হারোয়া অঞ্চলের বালান্ডা পরগনা লাখেরাজ(করমুক্ত) সম্পত্তি হিসেবে লিখে দেন। বাদশাহ তার আংটি ঝোলের বাটিতে ডুবিয়ে সিলমোহর দেন শাহী ফরমানে।
সেই ফরমান নিয়ে দুই দরবেশ চলে আসেন চব্বিশ পরগনার চন্দ্রকেতু রাজার গড় রাজ্যে। স্থানীয় ভাষায় হযরত আব্বাস মক্কীর নাম হয় পীর গোরাচাঁদ। ফরসা রঙকে ওই অঞ্চলে বলা হয় ‘গোরা’। গৌরবর্ণের অপভ্রংশ হলো গোরা শব্দটি। পীর গোরাচাঁদকে প্রথম স্বাগত জানান একজন গোয়ালা। এটা অবশ্য ঐতিহাসিকভাবে সঠিক নয়। তবে এ ধরনের গল্প কারও কারও মুখে শুনেছি।
সেই ঘোষবংশীয় ব্যক্তি পীরের জন্য নিয়ে আসেন সফেন গোদুগ্ধ।
পীর গোরাচাঁদ ও তার শিষ্য শেখ দারা মালিক বালান্ডা পরগনা অঞ্চলে ধর্ম প্রচার করতে থাকেন।
আর সবক্ষেত্রে যা ঘটে, সাধারণত দরিদ্র শ্রেণীর মেহনতি মানুষরাই নতুন ধর্মে আশ্রয় খোঁজে জীবনযাপনে কিছুটা সুবাতাস ও উচ্চ শ্রেণীর সামাজিক নিপীড়ন থেকে প্রতিকার পাওয়ার আশায়। মোটকথা সেকালে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের চাপে, জাতপাত, ছোঁয়াছুঁয়ি ইত্যাদির বিরুদ্ধে সমাজের অন্তজ শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রসার লাভ করতে থাকে। আর অবধারিতভাবে বিরোধ বাধে স্থানীয় সামন্ত প্রভু ও অভিজাত কায়েমী স্বার্থের শ্রেণীর সঙ্গে। স্থানীয় রাজা চন্দ্রকেতুর সঙ্গে যুদ্ধে আহত হন পীর গোরাচাঁদ। তার ক্ষতস্থানে লাগানো হয় চুন সুরকি। কথিত আছে সেই থেকে সেকালে গৃহনির্মাণের সময় এ অঞ্চলে পীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চুন সুরকি ব্যবহার না করে অন্য উপাদান ব্যবহার করা হতো।
পীর গোরাচাঁদের মৃত্যুর পর তার সমাধি হয় বিদ্যাধরী নদীর তীরে। মাজার ও খানকা শরীফের দেখভাল করতে থাকেন শেখ দারা মালিক। পরর্তিকালে শেখ দারামালিকের বংশধররাই এই অঞ্চলের লাখেরাজ জমিতে বসবাস করেন।
এই বংশের একজনের নাম ছিল মুন্সি গোলাম আবেদ। তিনি লর্ড অকল্যান্ডের মুন্সি(সচিব) ছিলেন। এখানকার মুন্সিবাড়ির লোকেরা চিরদিনই বিদ্যাচর্চার জন্য বিখ্যাত ছিলেন।
মুন্সিবাড়ির ছেলে মুন্সি মফিজুদ্দিনও জানতেন ইংরেজি, বাংলা, উর্দু, ফার্সি ও আরবিভাষা। মফিজুদ্দিন ও তার স্ত্রী হুরুন্নেসার ঘরেই জন্ম নেন শেখ মুহম্মদ ইব্রাহিম। কিন্তু আকিকার নামটি পছন্দ হয়নি মায়ের। তাই তিনি ছেলের নাম রাখেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। উপমহাদেশের বিখ্যাত বহুভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম, বাল্যকাল এমনকি প্রথম যৌবনও কেটেছে এই মুন্সিবাড়িতে তার বাপ ঠাকুর্দার ভিটায়। শেখ দারা মালিক ছিলেন তার ঊর্ধতন চতুর্দশ(১৪তম) পুরুষ।
১৯২১ সালে শহীদুল্লাহ চলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরি নিয়ে পূর্ববঙ্গে। ঢাকা শহরেই গড়ে ওঠে তাঁর আবাস। তাঁর সমাধিও ঢাকায় শহীদুল্লাহ হলের প্রাঙ্গণে। শহীদুল্লাহর স্ত্রী মরগুবা খাতুনও ছিলেন দেগঙ্গার কাছে ভাসলিয়া গ্রামের জমিদারের কন্যা।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর মরগুবা খাতুনের আর কখনও ফেরা হয়নি বাপ-শ্বশুরের ভিটায়। তার কবরও রয়েছে ঢাকা শহরেই। হুরুন্নেসাও ঢাকা শহরে ছেলের কাছেই থাকতেন। জন্মস্থান, সেই নিজস্ব গ্রামে ফেরার জন্য তিনি কি কখনও আকুল হননি?
আমি ছোটবেলায় যখন বন্ধুদের কাছে তাদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার গল্প শুনতাম তখন মনে মনে ভাবতাম পিয়ারা গ্রামের কথা। বাবার মুখে শুনে শুনে একটা ছবি দাঁড় করানোর চেষ্টা করতাম। কেমন ছিল প্রদীপের আলোয় ঘেরা সেই ভিটাবাড়ি? কেমন ছিল সেই মাটির ঘরের এককোণে রেড়ির তেলের বাতিতে জ্ঞানতাপসের অক্ষরজ্ঞান লাভের সেই প্রথম দিনগুলো?
১৯২১ থেকে ২০২২। একশ বছর। ১১ জুন যখন আমি কোলকাতার দমদম থেকে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটের উদ্দেশ্যে ‘দমদম-হাসনাবাদ’ লাইনের ট্রেনে চাপি তখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না সত্যিই যাচ্ছি ফিরে শিকড়ের সন্ধানে। সঙ্গে ছিলেন আমার হাজবেন্ড কবি শাহিন রিজভি।
বসিরহাটে আমাকে ভিটেবাড়ি দেখানোর জন্য বারাসাত থেকে যোগ দিলেন প্রাবন্ধিক ও চেতনা পত্রিকার সম্পাদক রবীন দাস এবং অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানের গবেষক লেখক ঋষি ঘোষ। দুজনেই অমায়িক ভালো মানুষ এবং অত্যন্ত বন্ধুবৎসল অন্তঃকরণের অধিকারী।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট ট্রেনযাত্রার পর আমরা পৌছুঁলাম হারোয়া স্টেশনে। স্টেশন থেকে দুমিনিট হেঁটে হাজির হলাম এক বিশাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ কামরুজ্জামান সাহেব আমাদের সাদর অভ্যর্থনা করলেন। প্রতিষ্ঠানেরই একটি গাড়িরও ব্যবস্থা করে দিলেন। গাড়ির চালকের নাম হাবিবুল্লাহ। তরুণ ছেলে। বেশ বিনয়ী এবং খোঁজ খবরও রাখে। কামরুজ্জামান সাহেব বলে দিয়েছিলেন শহীদুল্লাহ পরিবারের এক সদস্যর কাছে আমাদের নিয়ে যেতে। প্রথমে তাই চললাম সেদিকে।
পিয়ারা গ্রামের কাছেই বড় সড়কের উপর বিশাল এক পেট্রোল পাম্প। সেই পেট্রোল পাম্পের মালিক হলেন ওহিদুল্লাহ সাহেব। তিনি আমার আত্মীয়।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছোটভাই ছিলেন মুহম্মদ খলিলুল্লাহ। তার ছেলের নাম নুরুউল্লাহ। নুরুউল্লাহর ছেলে ওহিদুল্লাহ। সৌম্য চেহারার মাঝবয়সী ভদ্রলোক। উচ্চশিক্ষিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী। ব্যবসার দৌলতে যথেষ্ট অর্থবিত্তের অধিকারী। বললেন, তার বড়ভাই ডা. হেদায়েতুল্লাহ এ অঞ্চলের নামকরা চিকিৎসক। তার কাছে জানতে পারলাম পিয়ারা গ্রামের মুন্সিবাড়িতে এখন তার মা ও বোন আছেন।
ওহিদুল্লাহভাইয়ের অফিসকক্ষে একটি আলমারিতে বেশকিছু বই। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পর্কিত বইগুলোর মধ্যে আমার বাবা মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর(আ.জা.ম তকীয়ূল্লাহ) লেখা মুক্তির দিশারী শহীদুল্লাহ বইটি দেখে অবাক হলাম বৈকি। আমার ধারণা ছিল বাবার লেখা এই বইটি কোনরকম প্রচার পায়নি। এটি যে তার আত্মীয়দের কাছে গ্রামের বাড়িতে পৌছে গেছে সেটি সত্যিই বিস্ময়ের। ওহিদুল্লাহভাই ব্যস্ত মানুষ। তবু যথেষ্ট আপ্যায়ন করলেন আমাদের।
তারপর জানালেন এখানে শহীদুল্লাহ বিদ্যা নিকেতন নামে একটি স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে সেটিকে মাদ্রাসা বানানো হয়েছে। ওহিদুল্লাহভাই মোটেই চান না এটি মাদ্রাসা হোক। যা হোক স্কুলটি চলছে ভালোই। সে স্কুলের হেড মাস্টার সাহেবকে ডেকে পাঠিয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ করালেন।
হেডমাস্টার মশায়ের নাম শাহাবুদ্দিন মোল্লা। তিনি বসিরহাট আদালতের একজন আইনজীবী ছিলেন। পরে ওহিদুল্লাহ ভাইয়ের কথায় স্কুলটির দায়িত্ব নিয়েছেন। মনে পড়লো এই বসিরহাট আদালতেই প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন শহীদুল্লাহ। পরে স্ত্রী মরগুবা খাতুনের অনুরোধে পেশা পরিবর্তন করে ফিরে যান কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে।
মাস্টার মশায় আমাদের নিয়ে গেলেন শহীদুল্লাহ বিদ্যা নিকেতন নামের স্কুলটির প্রাঙ্গণে। দোতলা স্কুলভবনটি বেশ সুন্দর। খোলামেলা। কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে এবার আমাদের নিয়ে গাড়ি এগিয়ে গেল মুন্সিবাড়ির দিকে।
গ্রামের পথ দিয়ে প্রবেশ করে গাড়ি এসে দাঁড়ালো আমাদের বাড়ির সামনে। আচ্ছা এটা আমি কি লিখলাম? ‘আমাদের বাড়ি’। কি অর্থ হয় এ কথাটার? একশ বছর আগে এখানকার পাট চুকিয়ে কি আমার ঠাকুর্দা চলে যাননি? আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কি ঢাকা শহরে নয়? অবশ্যই তাই।
কিন্তু তারপরেও কেন যেন মনে হচ্ছে এটা আমার ঘর, আমার ঠিকানা।
মাটির বাড়ি।ইলেকট্রিসিটি আছে। ফ্যানও ঘুরছে। এখানে এখন রয়েছেন ওহিদুল্লাহ ভাইয়ের মা মাকসুদা খাতুন মেরি। বয়স ৮৫ বছর। আরও আছেন তার মেয়ে ও জামাতা।
মাকসুদা খাতুন সম্পর্কে আমার চাচী হন। তিনি শহীদুল্লাহর আরেক ভাইয়ের মেয়ে। তাই সম্পর্কে আমার ফুপুও হন তিনি। ফরসা চেহারার মানুষ, পরনে ধবধবে সাদা শাড়ি।
সত্যি বলতে কি এতক্ষণ, মানে স্কুল বা অন্য জায়গা ঘুরে আমি তেমন কোন ইমোশোন বোধ করিনি। কৌতুহল হয়েছে, আবেগ নয়।
কিন্তু এই প্রবীণা ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর প্রথমবারের মতো বুকের ভিতরে কেমন একটা অনুভূতি হলো। মনে হলো হয়তো আমার দাদী(ঠাকুরমা) দেখতে এমনই ছিলেন।
মাকসুদাচাচী আমার দাদা-দাদী দুজনকেই দেখেছেন। দাদী যে খুব সুন্দরী ছিলেন সেকথাও বললেন। এগুলো আমার জানা তথ্য। কিন্তু তার গলার স্বরে, বাচনভঙ্গীতে, কথার টানে চব্বিশ পরগনার খাঁটি সুরে মনের ভিতর জেগে ওঠে পূর্ব জন্মের স্মৃতি। চোখের সামনে দেখতে পাই মুন্সিবাড়ির জমজমাট দিনগুলোকে।
তাদের পাশের বাড়িটি ছিল মুন্সি মফিজুদ্দিনের নিজস্ব ভিটাবাড়ি, শহীদুল্লাহর জন্ম যে ঘরে, যেটি জ্ঞানতাপসের আঁতুড় ঘর। সেই বাড়িটিতে এখন কেউ থাকে না। ভিটে পড়ে আছে জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায়। বাড়িটি ইটের তৈরি। পুরনো দিনের মোটা দেওয়াল।ছোট ছোট ইট। এ বাড়ির বয়স কম করে হলেও দেড়শ বছর তো হবেই। আরও বেশি হতে পারে। ভেঙে পড়া ভিটেতে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম টালি ছাওয়া বাড়ির কংকাল। এটাই আমার পূর্ব প্রজন্মের মানুষের আবাসস্থল। এখানে এখন সন্ধ্যে প্রদীপ জ্বালানোর মতো কেউ নেই।
একসময় এই গৃহ ছিল ভরভরন্ত। এরই দাওয়ায় বসে মুন্সি মফিজুদ্দিন পুঁথিপাঠ করতেন। এই আঙিনায় বালক শহীদুল্লাহ খেলা করতেন। তরুণী হুরুন্নেসা এখানে বসেই স্বামী পুত্র কন্যাদের পরিবেশন করতেন আহার। এই বাড়িতেই নতুন বউ হয়ে এসেছিলেন ঠাকুরমা মরগুবা খাতুন। এই গ্রামে অতখানি রূপসী নাকি আর কেউ ছিল না। শহীদুল্লাহর বিয়ে হয় ১৯১০ সালে। সে সময় তিনি কোলকাতায় থাকতেন। প্রায়ই নাকি লুকিয়ে দেখা করতে আসতেন তরুণী বধূর সঙ্গে।
জঙ্গুলে জমিতে দাঁড়িয়ে পোড়ো বাড়িটি হয়তো শোনাতে চায় সেসব দিনের গল্প। মুন্সি মফিজুদ্দিনের আত্মা কি দেখতে পাচ্ছে আমাকে? তার প্রোপৌত্রীকে? আমার মধ্য দিয়ে কি এ ভিটেয় ফিরে এলেন হুরুন্নেসা আর মরগুবা খাতুন?
এই বাড়িতে ছোটবেলায় আমার বাবা অনেকবার এসেছেন। এমনকি পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে পাঁচ বছরের রাজবন্দী জীবন থেকে মুক্ত হয়ে এসেছিলেন এখানে। বছরখানেক ছিলেনও। আহা, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যদি এখানে আসা হতো?
গ্রামের প্রকৃতি কি সবুজ, কি নিবিড়। বাড়ির একপাশে আমাদের আমবাগান। সামনে পুকুর। শীতল তার জলে স্নান করছে, বালকের দল। আমার মনে ভেসে উঠছে দেড়শো দুশো বছর আগের এক গ্রামের ছবি। হয়তো আমিই ছিলাম এখানে অন্য রূপে, অন্য কোন নামে।
আর মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই। এবার আমাদের গন্তব্য পীর গোরাচাঁদের মাজার। বেশ বড় এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে মাজার শরীফ। কয়েক শতাব্দি পুরনো এই সমাধিস্থল। ফাল্গুন মাসে এখানে এখনও মেলা বসে। ঘোষবাড়ির বাসিন্দারা প্রথম এসে মাজারকে দুধ দিয়ে স্নান করান। সেই যে তারা পীর গোরাচাঁদকে দুধপান করিয়েছিলেন সেই স্মৃতি, সেই ঐতিহ্য আর সেই অধিকারবলেই মাজারে প্রথম দুগ্ধ দান করার অধিকার ঘোষদের।
এখানে বটের ঝুড়িতে সুতো বাঁধতে আসেন হিন্দু মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের মানুষই। মাজারকে কেন্দ্র করে বেশ একটি বাজারও গড়ে উঠেছে এখানে।
মাজারের পাশেই বিদ্যাধরী নদী। কত শতাব্দি পার হয়েছে, বদলে গেছে গ্রামের পরিবেশ, এসেছে নতুন মুখ, ১৯৪৭ এ বিভক্ত হয়েছে মাতৃভূমি, নদী কিন্তু নির্বিকার। সে বয়ে চলেছে সব স্মৃতিকে সযত্নে বুকে ধরে রেখে। এই নদী যেন আমার কতকালের চেনা। অনেক জন্ম আগে এই নদীর তীরেই ছিল আমার বসতি।
দিনটি ছিল ভীষণ গরম। বৃষ্টির অপেক্ষায় ছটফট করছিলাম দমদম স্টেশনে। এত অস্বস্তি লাগছিল যে অনেকবার মনে হয়েছিল গিয়ে কাজ নেই। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো যখন গ্রামে গেলাম তখন কি এক শীতল শান্তি সর্বাঙ্গে পরশ বুলিয়ে দিলো।
প্রকৃতি মায়ের মতো। যতদূরেই চলে যাক সন্তান, মা ঠিক মনে রাখে। অপেক্ষা করে থাকে। ফিরে এলে কোলে বসায় আদরের পরশ বুলায়। আমার ও এই গ্রামের মধ্যে এক শতাব্দির ব্যবধান। কিন্তু দুজন দুজনকে চিনে নিতে একটুও দেরি হলো না। ঠিক আপন করে নিলাম পরষ্পরকে।
আমার রক্তের ভিতরে রয়ে গেছে এই গ্রামের স্নেহস্পর্শ, রয়ে গেছে শিকড়ের টান।