কাজী জহিরুল ইসলাম
২০১৫ সাল। ঢাকা থেকে ঘুরে এলে কবি শহীদ কাদরী জিজ্ঞেস করেন, কেমন কাটাইলা মিয়া? একজন বিখ্যাত কবি, যিনি বহুদিন দেশে যান না, তিনি যখন জিজ্ঞেস করেন, কেমন কাটাইলা মিয়া, তখন তিনি আসলে কী জানতে চান তা আমি ভালো করেই জানি। আমি বলি, শহীদ ভাই, আপনার সঙ্গে আমার একটা ভালো যোগাযোগ আছে এটা তো ঢাকার কবি, সাহিত্যিকরা জানেনই, অনেকেই আপনার খোঁজ-খবর নিলেন। তিনি খুশি হন, আরো কিছু জানতে চান। আমি বলি, অনেকেই আপনার ‘সঙ্গতি’ কবিতা মুখস্ত শুনিয়ে দিলেন। মনে হচ্ছিল, শহীদ কাদরী মানেই ‘সঙ্গতি’, এখনও এই কবিতা ভীষণ জনপ্রিয়। একথা শুনেই তিনি ক্ষেপে যান। শোনো মিয়া, জনপ্রিয়তা একটা ফালতু জিনিস, কখন যে কী জনপ্রিয় হয় বোঝা মুশকিল। এক সময় তো শহীদ কাদরী মানেই ছিল “তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা” অথচ এগুলির চেয়ে অনেক ভালো কবিতা আমি লিখেছি, সেইসব কবিতা নিয়া কেউ কথা বলে না।
আমি বলবো না যে জনপ্রিয়তা একটা ফালতু জিনিস, তবে অপেক্ষাকৃত হালকা, সরাসরি, নাটকীয়, গল্পপ্রবণ এবং আবেগী কবিতাগুলোই অধিক জনপ্রিয় হয়। আমার রচিত কবিতাগুলোর মধ্যে আবৃত্তিশিল্পীরা বেশি পড়েন মুক্তিযুদ্ধ, পা, বাড়ি আছ, বঙ্গবন্ধু এই কবিতাগুলো। সবচেয়ে বেশি পঠিত কবিতা মুক্তিযুদ্ধ।
১৯ এপ্রিল ২০২৩। সকাল ১১ টা ৫ মিনিটে মেসেঞ্জারে দুটো কবিতার অডিও এলো। পাঠিয়েছেন আবৃত্তিশিল্পী এবং আবৃত্তির প্রশিক্ষক মাহমুদা আখতার। তার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি, কথাও হয়নি, এমনকি ফেইসবুকেও আমরা যুক্ত নই। ফেইসবুকে বন্ধু না হলে মেসেঞ্জারের মেসেজগুলো সরাসরি ইনবক্সে আসে না। অন্য এক জায়গায় থাকে, সেখান থেকে প্রেরককে গ্রহণ করলে তার মেসেজ ইনবক্সে আসে। এইরকম মেসেজ আমি চেক করি হঠাৎ হঠাৎ, কখনো সপ্তাহে একবার, খুব ব্যস্ত থাকলে মাসেও চেক করা হয় না। কিন্তু এই মেসেজটি যেদিন এসেছে ঘটনাক্রমে সেদিনই আমি অবন্ধুদের মেসেজ যেখানে থাকে সেখানে ঢুকেছিলাম। তিনি যে দুটি কবিতার অডিও পাঠিয়েছেন সেগুলো হচ্ছে মুহম্মদ নূরুল হুদার “যতদুর বাংলা ভাষা ততদূর এই বাংলাদেশ” এবং আমার লেখা “মুক্তিযুদ্ধ”। হুদা ভাইয়েরটিতে মিউজিক আছে, আমারটিতে মিউজিক নেই। আমি অবশ্য এই বৈষম্যের জন্য অভিযোগ করিনি, ধন্যবাদ দিয়ে বলেছি, ভালো হয়েছে। পরে আরেকটি মেসেজে বলেছি, হুদা ভাইয়ের কবিতাটি খুব ভালো করেছেন।
তিনি হয়ত আমার কবিতায় কেন মিউজিক নেই এর ব্যাখ্যা দেবার একটা দায় বোধ করেছেন। এরপর লম্বা ভয়েজ মেসেজ পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি ” মুক্তিযুদ্ধ” কবিতাটির সঙ্গে তার দীর্ঘ সম্পৃক্ততার বেশ কিছু গল্প বলেন।
আজ থেকে অনেক বছর আগে তিনি জাদুঘরে বা শিল্পকলায় মাহিদুল ইসলামের কণ্ঠে প্রথম এই কবিতাটি মঞ্চে আবৃত্তি করতে শোনেন। তিনি জানান, খুব বড়ো একটি অনুষ্ঠান ছিল সেটি। অনুষ্ঠানের পরে আমি মাহি ভাইকে বলি, কবিতাটি খুব সুন্দর, আমাকে দেবেন, আমি এটা করতে চাই। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে কাগজ বের করে আমাকে দেন। পরের বছর আমি কবিতাটি মুখস্ত করে বিজয় দিবসে বিটিভিতে আবৃত্তি করি। এরপর বাংলাদেশ বেতারে একাধিকবার করি। একক আবৃত্তি করি, ডুয়েট করি। আমার প্রশিক্ষণার্থীদের এই কবিতাটি নিয়মিত শেখাই।
বিটিভিতে কবিতাটি করার পরে বিখ্যাত আবৃত্তিকার ডালিয়া আহমেদ আমাকে বলেন, এতো সুন্দর, এটা আমাকে দিস তো মাহমুদা। তখন তো আমি মুখস্ত করে পড়েছি, আমার কাছে কাগজ ছিল না। তাই তখন আমি তাকে দিতে পারিনি। আমার একটি সংকলন আছে, চয়নিকা, সেখানে এই কবিতাটি আছে। সেই সংকলনটি ডালিয়া আহমেদ কিনে নিয়েছেন। আমি ডালিয়া আপাকে বলেছিলাম, আপনি আমার কাছে একটি কবিতা চেয়েছিলেন, মনে আছে? সেই কবিতাটি এই সংকলনে আছে। আমি যখন এটি আমার প্রশিক্ষণার্থীদের শেখাই ওদেরকে কবিতাটির বিভিন্ন অংশ ভাগ ভাগ করে লিখে দিই। তাই একসঙ্গে পুরো কবিতাটি কোথাও লেখা ছিল না। তা ছাড়া মাহি ভাইয়ের কাগজটি তো ততদিনে ছিঁড়ে গেছে।
আপনাকে যে অডিও ক্লিপটি পাঠিয়েছি এটি খালি গলায় করা এজন্য যে এটি আমি আমার প্রশিক্ষণার্থীদের বোঝার জন্য দিই। আর মুহম্মদ নূরুল হুদা ভাইয়ের কবিতাটি বিটিভির জন্য করেছিলাম, সেটি দিয়েছি। আপনার কবিতাটি যখন বিটিভিতে করেছিলাম তখন তো স্মার্ট ফোনের যুগ ছিলো না তাই রেকর্ড করাও হয়নি।
এই কবিতা নিয়ে আরো বহু গল্প আছে। কয়েক বছর আগে এক আড্ডায়, প্রসঙ্গত, আমি এই কবিতার কয়েকটি লাইন শুনিয়েছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে কবি জাহিদ হায়দার সচকিত হয়ে প্রশ্ন করেন, এটা আপনার লেখা? আমি বলি, হ্যাঁ। তিনি বলেন, এই কবিতার আবৃত্তি আমি বহুবার বহু জায়গায় শুনেছি।
এর জন্মের গল্পটিও কম মজার নয়। তখন আমার বয়স ১৮ বছর, মাত্র কলেজ ছেড়েছি। সামনে ১৬ই ডিসেম্বর। বাড্ডার একটি ক্লাব বিজয় দিবসের সংকলন বের করবে, আমাকে বলল, বিজয় দিবসের ওপর একটি কবিতা লিখে দিও তো। আমি তো মহাখুশি, আমার কাছে কবিতা চেয়েছে। রাতেই বাসায় গিয়ে এই কবিতাটি লিখে ফেলি। সেই ১৮ বছর বয়সে লেখা কবিতা যে এতো জনপ্রিয় হবে কখনো কী ভেবেছিলাম! শহীদ ভাই, ঠিকই বলেছেন, কোন কবিতা যে কখন জনপ্রিয় হয় তার কোনো ঠিক নেই।
আমি নিউইয়র্কে আসি ২০১১ সালে, সম্ভবত ২০১২ সালের কথা, পরিবার তখন লন্ডনে, আমি এখানে একা। হাতে সময়ের অভাব নেই। গুগলে, ইউটিউবে নানান কিছু খুঁজি। হঠাৎ একদিন ভেসে উঠলো, কেউ একজন আবৃত্তি করছেন, “মুক্তিযুদ্ধ” কবিতাটি। আবৃত্তিকারের নাম বদরুল আহসান খান। অনেক পরে ফেইসবুকে তার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। ইউটিউবে তার কণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধ কবিতার আবৃত্তি আমার তেমন ভালো লাগেনি। যা ভালো লেগেছে তা হচ্ছে, আমার কবিতা কেউ একজন আবৃত্তি করছেন কিন্তু তখনো আমি জানতাম না শুধু বদরুল আহসান খান একা না, আরো অনেকেই এই কবিতা ইতোমধ্যেই আবৃত্তি করেছেন।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৩ এপ্রিল ২০২৩।