spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধসামাজিকতা থেকে মানবিকতায় : কবির দায়, কবিতার দায়

লিখেছেন : তৈমুর খান

সামাজিকতা থেকে মানবিকতায় : কবির দায়, কবিতার দায়

তৈমুর খান

maple leaf

সামাজিক ও মানবিক দায়বদ্ধতা থেকেই প্রতিটি কবির উত্থান সূচিত হয়। যদিও কবির ব্যক্তিজীবনের শূন্যতা বড় হয়ে ওঠে কবিতায়, যদিও ব্যক্তিজীবনের অবদমনের ভাষাকেই তিনি রহস্যময় কবিতায় ছায়াপাত ঘটান, তবুও সেই ব্যক্তিজীবনই নৈব্যক্তিক সমষ্টি চেতনায় যূথবদ্ধতার পরিচয় দেয়। কেননা ব্যক্তিজীবনের সমষ্টিই সমাজজীবনের আধার। আবার সমাজজীবনই আবহমান মানবজীবনের তথা মানবসভ্যতার পরিচয় বহন করে। একজন কবি কখনোই তাঁর সময়কালকে উপেক্ষা করতে পারেন না। তাঁর সমাজজীবনের অবনমন অথবা উৎকর্ষ তাঁকেও স্পর্শ করে। সমাজের অবক্ষয়, অথবা সংঘাত যে মানবজীবনেরও অন্তরায় এবং সংকট ডেকে আনে তা বলাই বাহুল্য। ১৯৪২ সালের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। নিরাপত্তাহীন জীবনে স্বপ্নভঙ্গের অভিশাপ নিয়ে তিল তিল করে তারা মৃত্যুকে উপলব্ধি করছিল। সেই অন্তহীন অনিবার্য উদাসীনতাকে ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যের ‘বিভিন্ন কোরাস’ কবিতায় জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন:

“নিকটে মরুর মতো মহাদেশ ছড়ায়ে রয়েছে :

যতদূর চোখ যায়— অনুভব করি;

তবু তাকে সমুদ্রের তিতীর্ষু আলোর মতো মনে ক’রে নিয়ে

আমাদের জানালায় অনেক মানুষ,

চেয়ে আছে দিনমান হেঁয়ালির দিকে।

তাদের মুখের পানে চেয়ে মনে হয়

হয়তো বা সমুদ্রের সুর শোনে তারা,

ভীত মুখশ্রীর সাথে এ-রকম অনন্য বিস্ময়

মিশে আছে ;—তাহারা অনেক কাল আমাদের দেশে

ঘুরে–ফিরে বেড়িয়েছে শারীরিক জিনিসের মতো;”

 মরুর মতো মহাদেশকে সমুদ্রের তিতীর্ষু  আলোর মতো মনে করে নিয়ে আসন্ন ধ্বংসময় জীবনবোধকে যারা স্বপ্নের জানালায় দেখতে চেয়েছে, জীবনানন্দ সেইসব মানুষদেরই উপলব্ধি করেছেন। তাদের চেয়ে থাকা হেঁয়ালির মতো মনে হলেও হয়তো সময় পরিবর্তনের অপেক্ষায় রয়েছে তারা। ভীত সন্ত্রস্ত মুখের সঙ্গে তাদের আশ্চর্য হওয়ার রূপটিও ফুটে উঠেছে। মানবশরীর ধারণ করলেও অর্থাৎ তারা জীবন্ত হলেও ‘শারীরিক জিনিস’ অর্থাৎ আবেগ ও স্বপ্নশূন্য অনুভূতিহীন বস্তুর মতো।

 কবিতার শেষ দিকে অবক্ষয় আর সামাজিক মূল্যবোধের চিহ্ন মুছে যাওয়া জীবনের ঢলকেই চারিদিকে দেখেছেন। কবির বিবেক সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই নিরন্তর যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, কবিতা সেই কষ্ট থেকেই নির্মাণের পথপরিক্রমায় চিত্রকল্পে সামিল হয়েছে:

“ডাইনে আর বাঁয়ে

চেয়ে দ্যাখে মানুষের দুঃখ, ক্লান্তি, দীপ্তি, অধঃপতনের সীমা ;

ঊনিশশো বেয়াল্লিশ সালে ঠেকে পুনরায় নতুন গরিমা

পেতে চায় ধোঁয়া, রক্ত, অন্ধ আঁধারের খাত বেয়ে ;

ঘাসের চেয়েও বেশি মেয়ে ;

নদীর চেয়েও বেশি ঊনিশশো তেতাল্লিশ, চুয়াল্লিশ উৎক্রান্ত পুরুষের হাল ;”

 মানুষের দুঃখ ক্লান্তি অধঃপতনের সীমা কতদূর বিস্তৃত বোঝানোর জন্যই কবি ‘নদী’ ও ‘ঘাস’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন। নদীর চেয়েও বেশি উৎক্রান্ত পুরুষের হাল এবং ঘাসের চেয়েও সংখ্যা বেশি বেগানা নারীর। ইতিহাসসিদ্ধ এইসব তথ্যের ভেতর দিয়েই সেইসময়ের জীবনের হতাশা ও দীর্ঘশ্বাসকে তিনি মুদ্রিত করেছেন। সময়কালের উল্লেখের মধ্যদিয়েই তার সত্যতার নির্দেশ দিয়েছেন। ঠিক তেমনই কবি শামসুর রাহমানও। ‘বারবার ফিরে আসে’ কবিতায় লিখলেন:

“‘আবার আসবো ফিরে’ ব’লে সজীব কিশোর

শার্টের আস্তিন দ্রুত গোটাতে গোটাতে

শ্লোগানের নিভাঁজ উল্লাসে

বারবার মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।

একটি মায়ের চোখ থেকে

করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই

আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোরে আকাশ হ’য়ে যায়।

একটি বধূর

সংসার উজাড়-করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,

আরেক বধূর বুক খাঁ-খাঁ গোরস্থান হ’য়ে যায়,

একটি পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি

ঝ’রে পড়তে না পড়তেই

আরেক পিতার বুক-শূন্য-করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ

নেমে যায় নীরন্ধ্র কবরে।”

 বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য, বাংলার সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য, নিজ স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য বারবার প্রাণ দিতে হয়েছে বহু বাঙালি সন্তানকে। সেই বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন তথা স্বাধীনতা আন্দোলন, অথবা অত্যাচারী-শোষণমুক্ত দেশ গড়ার জন্য বহু তরুণ তাজা যুবকের লাশ হওয়ার কবিতা লিখেছেন। দেশের অস্থির সময়ে রক্তাক্ত স্বদেশের আর্তনাদ কবিকেও নির্ঘুম করেছে। মুখ ফিরিয়েছেন যন্ত্রণার দিকে, মানুষের দিকে। বাল্মীকির চোখের মতোই শোকে কবির চোখেও অশ্রু নেমে এসেছে। শব্দগুলি হৃদয় থেকেই কষ্টের বুদবুদ হয়ে ভেসে উঠেছে। এই সামাজিক দায়বদ্ধতাই শামসুর রাহমানের কবিতার মূল বিষয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘আমি চলে যেতে পারি’ কাব্যের

‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?’ কবিতায় লিখেছেন:

“এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে

চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়

এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে

চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়

যেতে পারি

যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি

কিন্তু, কেন যাবো?

সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো

যাবো

কিন্তু, এখনি যাবো না

তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবো

একাকী যাবো না, অসময়ে।।”

 সন্তানের মুখ ধরে চুমু খাওয়ার মধ্যে যেমন পিতৃত্বের পরিচয় আছে, তেমনি নিখাদ অপত্য স্নেহের পরিচয়ও আছে। সকলকে একসঙ্গে কাছে টানার,অথবা সকলের সঙ্গে থাকার বাসনার মধ্যেই কবির সামাজিক দায় তথা মানবিক কর্তব্যটিও পরিস্ফুট হয়েছে। কবিতা কোনোকালেই সামাজিক দায়কে এড়িয়ে যেতে পারেনি। মানবিক দায়ও পালন করেছে।

সুবোধ সরকার ‘রজনীগন্ধা কফিন’ নামক কবিতায় লিখেছেন:

“তোমাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি দামিনী

সারাদেশ জুড়ে আমরা কেঁদেছি, সারাদেশ জুড়ে আমরা ফুঁসেছি।

ভারত রাষ্ট্র বাঁচাতে পারেনি তোমাকে।

জনজোয়ারের চাপে মাথা নত করেছে অশোকস্তম্ভ

দেশের বাইরে পাঠিয়ে তোমাকে ফেরৎ আনতে পারিনি, ফেরৎ আনতে পারিনি তোমাকে দামিনী।

ফেরৎ এসেছে রজনীগন্ধা কফিন, ফেরৎ এসেছে আমার ভারত কন্যা।

আমার মেয়েটি তের দিন ধরে মৃত্যু সরাতে সরাতে

তের দিনে হল অনন্যা।”

 গ্রাম থেকে দিল্লিতে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া মেধাবী ছাত্রী দামিনীর গণধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনা সারাদেশের মানুষের হৃদয়কে কম্পিত করেছিল। সারাদেশের মানুষ প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কবিও চুপ থাকতে পারেননি। কবিতায় একদিকে প্রতিবাদ, অন্যদিকে মনের কষ্টকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কবি যে সামাজিক এবং মানবিক সে কথা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিটি পুরুষ হৃদয়ই কবির মতোই দামিনীর পিতা হয়ে উঠেছিল।

 সমাজে ধর্ষণ খুন শোষণ অত্যাচার অনাচার কখনোই শেষ হবে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে কখনো কখনো প্রজাসাধারণের ওপরও নেমে আসছে অমানবিক বিধি-বিধান। ধর্মীয় সহিংসতা থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক নানা ক্রিয়াকণ্ড। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বাড়ছে। অশিক্ষা-কুশিক্ষার প্রচলন ঘটছে। এসবের বিরুদ্ধেই কবিরা কলম তুলে নিচ্ছেন। যে শান্তি ও সহাবস্থানের স্বপ্ন নিয়ে মানবসভ্যতার রূপ তাঁরা দেখতে চান, তা স্বপ্ন হয়েই থেকে যাচ্ছে। আর এই কারণেই কবিতা লেখার প্রয়োজন হচ্ছে। নোবেল বিজয়ী কবি সিমাস হেনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন: “If you have the words, there’s always a chance that you’ll find the way.”

(Seamus Heaney, Stepping Stones: Interviews with Seamus Heaney)

অর্থাৎ যদি আপনার কাছে শব্দ থাকে তবে সর্বদা একটি সুযোগ রয়েছে যে আপনি উপায় খুঁজে পাবেন। এই উপায় খোঁজার তাগিদেই প্রতিটি সৃজনশীল মানুষই সক্রিয় হয়ে ওঠেন। নবারুণ ভট্টাচার্য লিখেছেন:

“এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না

এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না

এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না

এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না

আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব

বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান

সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম

অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী

প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছে মতো

ডেকে নেব টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মত দীঘি

ভালোবাসা-যার থেকে আলোকবর্ষ দুরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি—

তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন।”

 এই কবিতা তো তখনই লেখা যায়, যখন কবি সমস্ত মানুষের হয়ে কথা বলতে পারেন। সমস্ত মানুষের যন্ত্রণাকে নিজের যন্ত্রণা ভাবতে পারেন। সমস্ত মানুষের আনন্দ পাওয়ার স্বপ্নকে নিজের স্বপ্ন করে তোলেন। সমস্ত মানুষের আকাঙ্ক্ষিত শান্তি ও ভালোবাসার জগতের কল্পনাকে নিজস্ব কল্পনায় রূপান্তরিত করতে পারেন। একটা মানুষের মৃত্যুও কবির কাছে মানবিকতার মৃত্যু। এই মৃত্যুকে মেনে নেওয়া মানে নিজেরই বিবেকের মৃত্যু। তাই কবির দরকার গর্জে ওঠা। কবি মৃদুল দাশগুপ্ত সরাসরি এই গর্জন লিখলেন তাঁর কবিতায়:

“ক্রন্দনরতা জননীর পাশে

এখন যদি না থাকি

তবে কেন এ লেখা,কেন গান গাওয়া

কেন তবে আঁকাআঁকি?

নিহত ভাইদের শবদেহ দেখে

না-ই  যদি হয় ক্রোধ

কেন ভালোবাসা,কেন বা সমাজ

কীসের মূল্যবো!

যে-মেয়ে নিখোঁজ,ছিন্নভিন্ন

জঙ্গলে তাকে পেয়ে

আমি কি তাকাব আকাশের দিকে

বিধির বিচার চেয়ে?

আমি তা পারি না। যা পারি কেবল

সে-ই কবিতায় জাগে

আমার বিবেক,আমার বারুদ

বিস্ফোরণের আগে।”

 প্রতিবাদের বারুদ যা বিবেকেরই নামান্তর তা কবির অন্তরেই লুকিয়ে থাকে। প্রতিবাদ যদি তিনি না করেন তাহলে বৃথাই লেখালেখি, আঁকাআঁকি, শিল্প সাধনা। কবির হৃদয়ে যেমন ভালোবাসার অবস্থান, তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠাও তাঁর কর্তব্য। যদি আমরা কবিব্যক্তিত্বকে চিনতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর হৃদয়ের খোঁজও রাখতে পারি।

দিনেমার দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, কবি, সামাজিক সমালোচক এবং ধর্মীয় লেখক যাঁকে প্রথম অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়,সেই সোরেন কিয়ের্কেগার্ড (১৮১৩-১৮৫৫) আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছেন:

“What is a poet? An unhappy man who hides deep anguish in his heart, but whose lips are so formed that when the sigh and cry pass through them, it sounds like lovely music…. And people flock around the poet and say: ‘Sing again soon’ – that is, ‘May new sufferings torment your soul but your lips be fashioned as before, for the cry would only frighten us, but the music, that is blissful.”

(Soren Kierkegaard, Either/Or)

 অর্থাৎ কবি কাকে বলে? একজন অসুখী মানুষ যে তাঁর হৃদয়ে গভীর যন্ত্রণা লুকিয়ে রাখে, কিন্তু যার ঠোঁট এমনভাবে গঠিত যে দীর্ঘশ্বাস এবং কান্না যখন তাদের মধ্য দিয়ে যায়, তখন এটি মনোরম সঙ্গীতের মতো শোনায় … এবং লোকেরা কবিকে ঘিরে ধরে বলে: ‘শীঘ্রই আবার গাও’—অর্থাৎ, ‘নতুন যন্ত্রণা যেন আপনার আত্মাকে যন্ত্রণা দেয় কিন্তু আপনার ঠোঁট আগের মতোই সাজে, কারণ কান্না আমাদের ভয় দেখায়, কিন্তু সঙ্গীত,সেটাই আনন্দদায়ক। কবিতা তো তাই,যা saddest thought হয়েও sweetest song-এর জন্ম দেয়। কবিদের কি তাহলে ছলনা চলে? চালাকি করে কি কবিতা রচনা সম্ভব?

 প্রকৃত কবিতায় কখনোই চালাকি থাকে না। যে শিল্পে অন্তরের স্পর্শ থাকে না, সেই শিল্প শিল্পই নয়। আজকের কবিরাও কি এই দায় এড়াতে পেরেছেন?

   না, কোনো কবিই পারেননি। বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে, মানুষ ও সময়কে অস্বীকার করে, নিজস্ব যন্ত্রণাকে আমল না দিয়ে—পাখি-ফুল-চাঁদ দেখে কবিতা লিখতে। রবীন্দ্রনাথ ‘নবজাতক’ কাব্যে লিখেছিলেন:

 “আপনার উচ্চতট হতে

 নামিতে পারে না সে যে সমস্তের ঘোলা গঙ্গা স্রোতে।”

 ‘ঘোলা গঙ্গাস্রোত’ যে বোহেমিয়ান জনস্রোত, সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার কলকোলাহল, সেখানে নিজের আভিজাত্য নিয়ে দূরে থাকা কবি কখনোই মিশতে পারেন না। কিন্তু কবির বিবেক কবিকে নাড়া দেয়। মনোকষ্টের বিপন্নতা উপলব্ধি করেন। এই বোধ আরও প্রগাঢ় হয়ে ধরা দেয় ‘চিত্রা’ কাব্যে:

“কবি, তবে উঠে এস,যদি থাকে প্রাণ

তবে তাই লহ সাথে,—তবে তাই কর আজি দান!

বড় দুঃখ, বড় ব্যথা,—সম্মুখেতে কষ্টের সংসার

বড়ই দরিদ্র, শূন্য, বড় ক্ষুদ্র, বদ্ধ অন্ধকার!-

অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,

চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু।”

 শুধুমাত্র নিজের ভালোই ভালো নয়, সকলের ভালো করার মধ্য দিয়েই নিজের ভালো সূচিত হয়। তাই দুঃখের সময়, ব্যথার সময়, কষ্টের সময় কবিকেই উঠে আসতে হয়। কবিকেই দাঁড়াতে হয় সেইসব ম্লানমুখ শিক্ষাহীন স্বাস্থ্যহীন অন্নবস্ত্রহীন মানুষের পাশে, না হলে তিনি কবি কিসের? শ্রীজাত লিখলেন:

“এর পরেও চুপ করে থাকা

এর পরেও সংযমী সময়

এর পরেও পতপত পতাকা

এর পরেও দৃঢ় কনভয়

এর পরেও সন্দেহ অতীত

এর পরেও চকচকে স্যালুট

এর পরেও লক্ষ্য শুধু জিত

এর পরেও বাহিনী মজুত

এর পরেও শব্দশালীনতা

এর পরেও স্তুতি আর স্তব

এর পরেও টক শো আর কথা

এর পরেও কবিতা উৎসব

এর পরেও বিশ্বাস, প্রণতি

এর পরেও ঘুম আসবে চোখে

এর পরেও বাকি আছে ক্ষতি

এর পরেও ভোট দেবে লোকে ।”

 শাসক যখন মানুষের এতই ক্ষতি করে দেয়, একের পর এক জনবিরোধী নীতির জন্ম দেয়, জান-মালের নিরাপত্তা দিতে পারে না, বেঁচে থাকাই যখন খাদের কিনারায়—তখনও কি সেই সরকারকে ভোট দেওয়া যায়? বিশ্বাস করা যায়? শালীনতা বজায় রেখে কথা বলা যায়? স্যালুট করা যায়? ভোটের জন্য তাঁর হয়ে টকশোতে অংশগ্রহণ করা যায়? কবি প্রশ্ন তুলে দিলেন। প্রশ্ন তোলা কবির দায়, সচেতন করাও কবির দায়। মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণ করারও কবির স্বপ্ন। শ্রীজাত তাঁর লেখার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করে চলেছেন। কখনো বিরোধাভাসে, কখনো রূপক অলংকারে, কখনো তির্যক ভঙ্গিতে তিনি প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

 সাম্প্রতিকের আর এক কবিও ভিন্ন ধারার কবিতায় তাঁর মনোকষ্টকে চালিত করছেন। এক বিষণ্ন পৃথিবী থেকে আনন্দময় মহাজীবনের খোঁজ করেছেন। মেটাফোর অলংকার প্রয়োগ করে এবং সচল ইমাজিনের সাহায্যে তাঁর আবেগকে প্রজ্ঞাময় উপলব্ধির দরজায় উপনীত করছেন।

 তিনি হলেন কবি গোলাম রসুল।  তাঁর

‘লাল হয়ে আছে রাগী আকাশ’ কাব্যটিতে   অবক্ষয়ী চেতনায় এক নরকের বিষাদময় চিত্রকল্পের ভেতর কবি আমাদের টেনে নিয়ে চলেছেন। বাস্তবিক এই পৃথিবীতে কবির স্বয়ংক্রিয় অভিযাপন। বহুমুখী সত্তার জাগরণে এবং উপলব্ধির নৈঃশাব্দ্যিক ব্যাপ্তিতে মোচড় খেতে খেতে আমরা এক মহাজাগতিক অভ্যাস আয়ত্ত করে নিচ্ছি। কবি বলেছেন “মৃত্যু নিয়ে আমার মনখারাপ করার অভ্যাস তাই আমি নরকের সন্ধ্যাকে স্মরণ করছি /  আমার স্মারকে ভারাক্রান্ত সূর্যের ছবি / আর নাম না জানা পূর্ণিমার চাঁদের পিঠে উঠে পৃথিবী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে”   —তখন ব্যক্তি নয়, সামগ্রিক সত্তারই নরকবাসের ছবিটি ‘রোগগ্রস্ত অন্ধকারে’ পর্যাপ্ত হয়ে ওঠে। আর্থার রিম্বাউদ একটি প্রবন্ধে বলেছেন   ‘I belive that I am in hell, therefore I am there.’ এখানে সেই প্রতিধ্বনিই শোনা যায়। যখন কবি বারবার বলেন ‘আমার হৃদয় পাথরের মতো কষ্ট পাচ্ছে’   অথবা ‘বৃষ্টিমুখর মৃত্যু’ নিয়ে কবি ‘প্রাচীনকালের একা’ হয়ে হাহাকারের পীড়িত বাজনায় ডুবে যান। পৃথিবী যখন নরক, কবির চেতনাও বিলুপ্ত প্রাচীন ইনহিউম্যানের আকাঙ্ক্ষায় পর্যুদস্ত। দি মিথ্ অফ্ সিসিফাস-এ আলবার্ট কামু বলেছেন ‘At the heart of all beauty lies something inhuman.’  গোলাম রসুলের কবিতায় একথারই রূপান্তর ঘটেছে ‘পৃথিবী এখন শীতল একগুচ্ছ ঘুমের মতো’ অথবা ‘আমাদের জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে’  এই মানবতা শূন্য নরক দর্শনের ভেতর আমরা প্রাচীন আত্মারই মর্মরিত কান্নাকে উপলব্ধি করতে পারছি। কবি মানবিক বলেই এই পৃথিবীর নারকীয় রূপটি দেখে পীড়িত হয়েছেন। তার হৃদয় ভেঙে পড়েছে। তখনই তিনি ঊর্ধ্বমুখী ভিন্নতর এক আশ্রয় এর খোঁজ করেছেন। এই অবক্ষয়, মূল্যবোধহীন রক্তাক্ত পৃথিবী থেকে  ঊর্ধ্বমুখহীনতার যাত্রা তাঁর কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

সত্তর দশকের কবি নিখিলকুমার সরকারের ‘নানারঙের হাইফেন’ কাব্যেও কবিতার ভিন্ন দর্শনে এক মানবিক প্রত্যয়কেই তুলে ধরেছেন। তিনি বহুল প্রচলিত জনপ্রিয় কবি নন, কারণ তিনি কম লেখেন, তাঁর পাঠকও কম। বাংলা কবিতার ভিন্নপথ ও ভিন্নস্বরের অনুসন্ধান করেন, বলেই সবশ্রেণির পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারেন না। বিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্যে যে কিউবিজম্ (Cubism) আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল, সেই পথকেই তিনি অনুসরণ করেছেন। কিউবিজম শিল্পীর সৃষ্ট জগৎ ও প্রকৃতিই প্রধান লক্ষ্য। শিল্পীই তাঁর বাস্তবতা ও রহস্যের গোলকধাঁধা সৃষ্টি করেন। পাল সেজান এই প্রসঙ্গে বলেছেন : ‘Art is a harmony parallel with nature.'(Paul Cezanne, Cezanne. Mont Sainte Victoire) 

অর্থাৎ শিল্পও প্রকৃতির সমান্তরালভাবে গড়ে উঠবে। কবিতাগুলিতে প্রকৃতির সঙ্গে অন্তর্লীন মানবীয় প্রবৃত্তির এক সমান্তরাল সম্পর্ক এবং কবি নিজস্ব বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। আত্মরতির স্ফুরিত অবগাহনে দোদুল্যমান কবি নিজের ছায়াতেই সম্মোহিত হয়েছেন। নার্সিসাস্ এমনই বহুলতায় সক্রিয় ও স্বয়ংক্রিয় যে জীবনের স্বতশ্চলতাকে প্রগাঢ় করে তুলেছে। ক্ষরণ ও শোভনের পর্যায়গুলি ছাপিয়ে গেছে কবির প্রত্ন-প্যাশন। জর্জর বাস্তবকে নান্দনিক মোহটানে ঘোরের প্রাচুর্য দান করেছে। সহজ অনাড়ম্বর, উপমা বর্জিত ভাষার সন্নিধানে কবি উন্মোচন করেছেন তাঁর মর্মযাপনকে : ‘চির-একুশ নন্দনকাননের বাইরে বেরোতেই দেয়নি, এখনও প্রেম অসময়ের বৃষ্টিতে স্নান করে, সর্দিফর্দি লাগে না, অথচ প্রেমের কত বয়স হল ভাবুন তো’ (প্রেমকথা ২)

এই প্রেম তো ভাষা, ফেব্রুয়ারি মাস, কবিতা এবং প্রাজ্ঞজীবনও । এই প্রেমযাপন চিরন্তন পৃথিবীকেই চেনায়। মানবিক সত্তার জাগরণকে বোঝায় । সংস্কৃতি ও সম্পর্কের ভেতর শয্যা পাতে। কিন্তু

 ‘আপাতত স্ক্রিপ্টে প্রেম নেই’ 

তা না থাক, জীবনের জার্নিতে প্রেমের পর্যটন চলছেই। আবার ফিরে আসবে। লাইফ সিনেমায় দেখা যাবে। স্ক্রিপ্ট রাইটার জানেন না, পরের দৃশ্যগুলিতে কী লেখা হবে। তিনিই লিখবেন কিনা তাও জানেন না। অনিশ্চয়তার ক্রিয়াগুলি থেকেই এই খণ্ডতা ও দ্বান্দ্বিকতা জীবনেরই দৃশ্যপটে ফুটে ওঠা এক বিস্ময়। 

     ‘প্রেমকথা’র নিবিড় পর্যায়গুলি থেকে যে আত্মভাষ্য উঠে এসেছে তা সব  ঋতু পার করে ভেসে গেছে অন্তহীন শূন্যতায়। জানালা নিজেই নিজের জানালা নিরীক্ষণ করেছে। বাউল সাধকের মতো নিজের ভেতর নিজেরই রহস্য নিয়ে খেলা। বাউলকথার ধাঁধায় পাঠককে নিয়ে যাওয়া :

‘বয়ঃসন্ধির জ্যোৎস্নায় ভেসে যেতে যেতে 

নিষিদ্ধ জানালায় চোখ পড়তেই দেখে ফেলেছিল 

অলোকসামান্য দৃশ্যটি : চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে…’

কিন্তু সেই চাঁদ তো সর্বৈব সমানুভূতির দরজায় পৌঁছায় না কোনোদিন। তবু  ঋতুপর্ণা ষোলোকলায় আবর্তিত হতে হতে উনিশে পা দেয়। প্রেমের আদিসত্তার বিবর্তন থেকে বন্যপ্রাণী বাঘের ভেতরও কবির কামনা ও প্রশ্রয় বিতত চিদানন্দময় :

“আমি বাঘ 

আমি মানুষ 

আমি বাঘমানুষ” 

বাঘ খণ্ড সত্তা, মানুষও খণ্ড সত্তা ; তেমনি বেড়াল মেয়ে, আঁচড়-কামড়, রতিগন্ধময় ও রমণী শৃঙ্গারের রমণী এসে উঁকি দেয়।

    আরণ্যক বিনিময়ে সব ভেদ মুছে গেলে আদি ও অনন্ত প্রান্ত মিলে যায়। সেখানে চন্দনবন, অ্যাসাইলাম, সংশোধনাগার রাত্রির রূপকথার অঙ্গ হয়ে ওঠে। খরগোশ-কচ্ছপের গল্পে মানুষের বৈরাগ্য ও ভাষা, চলন ও কথন, পথ ও গন্তব্য মিশে যায়। চরিত্রের বদল ঘটে না। সুররিয়ালিস্টিক ঘটনায় কবি দেখতে পান :

“কচ্ছপ পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে —ননস্টপ 

গন্তব্য থেকে তার অস্তিত্বের ব্যবধান কমে আসছে 

কমে আসছে দ্রুত… হঠাৎই এক অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি উড়ে এসে 

খরগোশের ঘুম ভাঙিয়ে দিল —আবার তার দৌড়ানো শুরু” 

                                                 (খরগোশ বনাম কচ্ছপ) 

এই পাণ্ডুলিপির আয়োজনেই আমাদের দৌড় থামে না। কথা ফুরিয়ে যায়। আলো ফুরিয়ে যায়, কিন্তু জীবন ফুরায় না। না-কথা না-আলোর ভেতর আমাদের উপকথা, উপগান, ভাঙা ঐশ্বর্য আর অর্ধপ্রজ্ঞা এবং হিংসা ও অহিংসার বিবরণ ঢলে পড়ে। কবিতা সেই নাগালেই অথবা অন্ধ বিপন্নতায় লোকজ সমীহ থেকে আলো পায়। আমরা পুতুল হয়ে, প্রদীপ হয়ে, শো-কেসে, ড্রয়ারে, টেবিলে অবস্থান করি। 

মেমরি কার্ড থেকে নিজেকে তুলে নিয়ে চলে যাবার সময় দু’জনের মধ্যবর্তী শূন্যতা জুড়ে একটাই শুধু হাইফেন। এটাই সভ্যতার সম্পর্ককে অনুগত উষ্ণতায় কাছাকাছি আনে। ত্রিভুজ, ফানুস থেকে উদ্বাহু বৃক্ষ, শরীরী ভাষা, রক্তনদী, কবন্ধ চরিত্র হয়ে যায়। কবিতাকে নিজস্ব চালেই আত্মনিষ্ঠ কথনের বুননে এক সংলাপধর্মী ব্যাকরণহীন পথে নিয়ে যেতে পেরেছেন। কবির ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ কম। বিষয়বস্তুরও সম্পূর্ণতা নেই। আদিম ভিত্তির উপর বিষয়কে দাঁড় করানোর পথই কবি অবলম্বন করেছেন। সবকিছুকে খণ্ডিতভাবেই দেখেছেন। একাধিক দৃষ্টিকোণ আরোপ করেছেন। বিষয়কে ভেঙে, জ্যামিতিক আকারের উপর জুড়ে দিয়ে ইচ্ছেমতো রূপ পাল্টে দিয়েছেন । অসংখ্য দৃশ্যপট, ক্রিয়া সংযোগ, অলংকারহীন আবেগহীন বিজ্ঞান ও গণিতের ভেতর ভাবনাকে চালিত করেছেন।এই সেই মানবিক সত্তারই বহুমুখী চলন।

   বাংলা কবিতা দর্শনে-ক্ষরণে-মননে-উপলব্ধিতে এবং আত্মচেতনায় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অগ্রসর হয়ে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই কবিতার বৈচিত্র্যময়তা বহুদিগন্ত উন্মোচন করছে। কবি নিয়াজুল হকের ‘হেলমেট পরে নিয়েছি’ কাব্যে ঝকঝকে স্মার্ট কবিতাগুলি এই দিগন্তেরই অংশ। সাতের দশক থেকে লেখালেখি শুরু করলেও তেমন ভাবে নিজেকে কখনো পেশাদার লেখক করে তোলেননি। সর্বদা ব্যতিক্রমী পথ অন্বেষণই করে গেছেন।  তাঁর প্রতিটি কবিতাই মেধাবী তরবারির মতো সূক্ষ্ম ও তীব্র। জীবনের প্রতি, সময়ের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি এবং তথাকথিত অমানবিক ধ্বংসের প্রতি তীব্র শ্লেষের কশাঘাত হেনেছেন। নির্মেদ অর্থাৎ বাহুল্য শব্দবর্জিত কবিতায় যে ইমেজিস্ট প্রেক্ষণ রচনা করেছেন এই মুহূর্তে তা খুব কম কবির মধ্যেই দেখা যায়। বিষয়কে ধারণ করেও বিষয়হীন প্রজ্ঞায় এম্পটিনেসের ভেতর নিজেকে চালনা করেছেন এবং সেখানেই সর্বময় অনন্তের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। নীতি-আদর্শের অবক্ষয়, শোষক-শাসকের প্রতারণা, মূল্যবোধহীন সমাজের উত্থান সবকিছুর সামনেই কবি হেলমেট পরে দাঁড়িয়েছেন আর নিজেকে যুগযাত্রীর ভূমিকায় সৈনিক করে তুলেছেন। সাহস ও দৃঢ়তায়, দার্শনিকের প্রজ্ঞা নিয়ে ঘোষণা করেছেন:

‘তোমরা/ জীবন নিয়ে, মৃত্যু নিয়ে, নিরাপত্তা নিয়ে/ একটুও ভাবিত হয়ো না/ দৈনন্দিন থাপ্পড় খাওয়ার মতোই/ সবই তো আপেক্ষিক’

 এইখানে এসেই কবি নির্ঝর হয়ে যান। মোহ-মালিন্য দূর হয়ে যায়। নিজেকেও ঋষির মতো মনে হয়। সমগ্র কাব্যটিতেই এই বোধের ঝাঁকুনি উপলব্ধি করেন পাঠক। যে গন্তব্যের অভিমুখে আমাদের উড়ান, সেই গন্তব্য যখন অনন্ত তখন নিজেরই বিনির্মাণ ফিরে আসতে বাধ্য—কবি এটাই বিশ্বাস করেন। তাই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকেই সূর্যের উদয় দেখতে পান। ঈশ্বরের মৃতদেহ জনগণই বয়ে নিয়ে যায়। নিজের লুকানো জার্সির কথাও উপলব্ধি হয়। পাথরকেও ফুল হয়ে ফুটতে দেখেন। এই বিনির্মাণ শব্দের মধ্যেও ফিরে এসেছে। হত্যার দৃশ্য দেখে তখন কবির মনে হয়: ‘লম্বা-চওড়া গোল/ কতরকম অপমান’। অপমানকে একই সঙ্গে তিনটে ভিন্ন বিশেষণে তিনি বিশেষিত করেন। ইংরেজি সাহিত্যিক, তাত্ত্বিক ও সমালোচক টেরি ঈগলটন(১৯৪৩) এই কারণেই বলেছেন ‘Deconstruction insists not that truth is illusory but that it is institutional.’ (Terry Eagleton)

অর্থাৎ ডিকনস্ট্রাকশন জোর দেয় যে সত্যটি অলীক নয় বরং এটি প্রাতিষ্ঠানিক।

 এই প্রতিষ্ঠানিক রাষ্ট্র,সামাজ ও ব্যক্তির সত্যের কাছেই নিয়াজুল হক আমাদের উপস্থিত করেছেন। সব ভাবনার মধ্যেই যে তাঁর মানবিক ও সামাজিক দায় না বললেও চলে।

 আজ আমাদের অনেকেরই প্রশ্ন কবি কি সামাজিক ও মানবিক দায় আর বহন করছেন না? একথা কিছুটা হলেও সত্যি। কবিতায় ভিন্ন পথ খুঁজতে গিয়ে কবিরা যে বিভ্রান্ত হয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যের পাঠক মাত্রই জানেন। বিষয়হীন কবিতা, দুর্বোধ্য কবিতা, না কবিতা, পোস্টমডার্ন কবিতা প্রভৃতি বহু কবিতাই আজকের দিনে প্রচলিত। বহু কবি আছেন তাঁরা কী লিখছেন তা নিজেরাই জানেন না। সামাজিক বা মানবিক কথাটির গুরুত্বই বা কতখানি, অথবা কবিতা লেখার উদ্দেশ্যই বা কী এ সম্পর্কে ধারণা না থাকলে কারও পক্ষেই কবিতা লেখা সম্ভব হবে না। প্রকৃত কবি কখনোই সমাজ বহির্ভূত কিংবা মানবিকচেতনা বহির্ভূত কবিতা লিখতে পারেন না। মানবজীবনের প্রতিটি পর্যায়ের প্রতিটি বাঁকে প্রবৃত্তির জাগরণ টের পাওয়া যায়। প্রতিটি বাঁকেই আলো-অন্ধকারের সম্মোহন ভাষা খুঁজতে থাকে। ব্যক্তিজীবন থেকে সামাজিকজীবনে নানা অসামঞ্জস্য বিরাজ করে। যা বলা হয় না, যা পাওয়া যায় না, যা কষ্ট দেয়, যা অবক্ষয় ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়—প্রকৃত কবিগণ সেসবকে কি ভুলে থাকতে পারেন? এই কারণেই ফিলিস্তিনিদের জাতীয় কবি  মাহমুদ দারবিশ ( ১৯৪১-২০০৮)  তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন: “Poetry and beauty are always making peace. When you read something beautiful you find coexistence; it breaks walls down.”

 অর্থাৎ  কবিতা এবং সৌন্দর্য সর্বদা শান্তি তৈরি করে। সুন্দর কিছু পড়লে আপনি সহাবস্থান খুঁজে পান; এটা দেয়াল ভেঙে দেয়। এই সহাবস্থানের, এই ভালোবাসার, এই শান্তির, এই ঐক্যের বার্তা একমাত্র কবিতাই দিতে পারে।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা