🍁
তৈমুর খান
🐦
বইয়ের কথা শুনলেই মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।বইকে কেন এত ভালবাসতে শিখেছিলাম আজও ভাবি। যখন অক্ষর জ্ঞানও হয়নি, তখনও বাবার বই পড়া নিশ্চুপ হয়ে শুনতাম। বাবা পড়তেন বিষাদসিন্ধু, হাতেমতাই, বড় মউতনামা, আলিফলায়লা। বোঝার ক্ষমতা হয়নি, কিন্তু পাঠের ধ্বনিতরঙ্গ নিশ্চুপে শ্রবণ করার আনন্দ দান করত। তারপর একটু বড় হলেই মায়ের বাক্স থেকে উদ্ধার করেছিলাম বাবার ছোটবেলার স্কুলজীবনের কয়েকটি বই তার সঙ্গে বিয়েতে উপহার হিসেবে পাওয়া ‘মনোয়ারা’ উপন্যাসটি। প্রথম পড়তে শিখেই এই ‘মনোয়ারা’ উপন্যাসটি পড়ে ফেলি। তারপর থেকেই বই পড়ার নেশা পেয়ে বসে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি না পেরোতেই কোন্ ছোটবেলায় বাবার কাছে কান্নাকাটি করেছিলাম একটা বইয়ের জন্য। আজও মনে পড়ে, একটা অজ গাঁয়ে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়ে সেটা কতটা অযৌক্তিক ও পরিবারের পক্ষে বিরুদ্ধতা ছিল। দিন-আনি দিন-খাই বাবা কোথায় টাকা পাবে আমার মতো ছেলেকে বই কিনে দেবে? তখনও কি এসব ভাবনা ছিল? ছিল না বলেই বই কিনতে যাওয়ার জন্য টাকা চেয়ে জেদ ধরেছিলাম। না, তখন বইমেলা ছিল না। শহরের কয়েকটি বইয়ের দোকান। কাচের শোকেসে সাজানো আছে রঙিন ছবিওয়ালা বইগুলি। বাবার কাছেই শুনেছি দেশ-বিদেশের রূপকথা নাকি খুব ভালো বই। তাতে রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প আছে। ভূত-প্রেতের কত রকম কাণ্ডকারখানা আছে। এসব আমাকে জানতেই হবে। ওটা আমার চাইই চাই।
এভাবেই বড় হয়ে গেছি, কিন্তু সেই থেকেই বেড়ে গেছে বইয়ের প্রতি একটি মহাটান। বইমেলা মহাবইয়ের বাজার নিয়ে উপস্থিত হয়। আর বইমেলাতেই পাওয়া যায় মনের মতন বই। তাই আমার উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় থেকেই বইমেলায় আসা শুরু। বই কেনার জন্য সারাবছর ধরে একটু একটু করে টাকা জমানো আর অপেক্ষা করা, কবে আসবে বইমেলা। প্রথমদিকে বাবার উৎসাহেই প্রাচীন সাহিত্য সংগ্রহ—বেদ-বেদান্ত, পুরাণ-পাঁচালি, আরব্য-পারস্য উপকথা, শেক্সপিয়ার সমগ্র, কালিদাস সমগ্র কত কত বই। বাবা ও আমি সন্ধ্যেবেলা লম্ফুর আলোয় বসে যাচ্ছি পড়তে। কতদিনে একটা শেষ করে আর একটা নতুন পাঠ শুরু হবে।
তারপর বঙ্কিম-শরৎ-তারাশঙ্কর-বিভূতি একে একে সংগ্রহ করে বিস্মিত হচ্ছি। আমাদের মনের কথা লেখকরা কী করে বুঝতে পেরেছিলেন আর একে একে সব লিখে গেছেন। পড়তে পড়তে কখনো চোখে জল এসে যাচ্ছে। কখনো খুব রাগ হচ্ছে। কখনো চুপচাপ হয়ে শুধু ভেবে চলেছি। বইগুলি কত কত দুর্লভ খনি মনে হচ্ছে। মানব জীবনের কত দীর্ঘশ্বাস, কষ্ট আর স্বপ্নেরা ঘুমিয়ে আছে শব্দ ও অক্ষরের মধ্যে।
তখনই একটু একটু করে প্রথম স্বাদ পেতে শুরু করেছি শক্তি-সুনীল-সুভাষ-ভাস্কর-শামসুর-আল মাহমুদ-জয়-এর কবিতারও। নতুন কাব্যগ্রন্থগুলি টাকার অভাবে কিনতে পারিনি। কাব্যের নামগুলি একটা একটা করে খাতায় লিখে রেখেছি। স্বপ্ন দেখেছি আগামী বইমেলায় কয়েকটা কিনবোই। কিন্তু বইমেলায় এসেও সম্ভব হয়নি। হাতে তুলে নিয়ে কী এক সুখ অনুভব করতে চেয়েছি তখন। নতুন বইয়ের একটা ঘ্রাণ হৃদয়কে স্পন্দিত করেছে। কয়েকটি শব্দ বাক্য আঙ্গিক এক ঝলক দেখার সুবাদে মনে হয়েছে পুণ্যলাভ করলাম। মনের অপূর্ণতা নিয়ে ফিরতে হয়েছে। না, কোনো কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সাহস হয়নি, কিন্তু তাঁদের ভাবনার সঙ্গে কত কথা বলে গিয়েছি। যে দু-একটা বই কিনতে পেরেছি তা-ই বাড়ি ফিরে নাওয়া-খাওয়া ভুলে মশগুল হয়ে পড়েছি। ঘুমানোর সময় মাথার পাশে রেখে দিয়েছি, ঘুম ভাঙলে আবার হাত দিয়ে স্পর্শ করেছি।
তবে অনেকটা পথ অতিক্রম করে কিছুটা হলেও এই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি। এখন বই রাখার জন্য কয়েকটি নতুন বুকসেলফও তৈরি করতে হয়েছে। প্রতিবছর বইমেলা থেকে নতুন বইয়েরা এসে বুকশেলফে ঢুকবে। আমি একান্ত মুহূর্তে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করব। আদর করব। গ্রাম থেকে কলকাতায় পড়তে আসা ছেলেটি এ বছর কী বই প্রকাশ করল, বইমেলাতে খুঁজে খুঁজে তাঁর বইও আনব। আমার সন্তানদের জন্য শুধু ভূতের বই আর খুঁজি না, আলোর আবাবিলকেও খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসি। অন্ধকার পৃথিবীতে নিজস্ব আলো চাই। যে আলো ইহকাল পরকালেও রাস্তা দেখাবে। বয়সের সঙ্গে ভাবনাও পাল্টে যায়। চিন্তনে ও চেতনায় তখন অন্য কিছুর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই সেই ছোটবেলারও এক সময় বড়বেলার পথে উত্তরণ ঘটে। কিন্তু বইমেলার প্রতি টান নিরন্তর চলতেই থাকে এর কখনো ছেদ পড়ে না।
তাই আজও বইমেলা আমার কাছে মননের তীর্থক্ষেত্র। বই সংগ্রহ আমার কাছে পুণ্য অর্জনের মাধ্যম। বই পাঠ আমার কাছে ঈশ্বরের সন্নিদ্ধি লাভে অগ্রসর হওয়ার হওয়ার সোপান। বাবা এই পুণ্যপথে আমাকে দীক্ষিত করে গেছেন। জেলা বইমেলা, মহাকুমা বইমেলা ও আঞ্চলিক বইমেলা অথবা কলকাতা বইমেলায় দীর্ঘপথ অতিক্রম করেই আমাকে আসতে হয়। আগে কতবার খালি হাতেও আসতে হয়েছে। টাকা না থাকলেও প্রচেষ্টার খামতি হয়নি। আজও নতুন নতুন কাব্যগ্রন্থ, নতুন নতুন গল্পকার ও কবিদের প্রতি আমার অদম্য কৌতূহল জাগে। কেমন লিখছেন তাঁরা, কী লিখছেন তাঁরা, সাহিত্যের কী পরিবর্তন হল এসব নিয়ে ভাবতেও ভালোবাসি। বইয়ের গন্ধ, কবি-সাহিত্যিকদের হাসি হাসি মুখ, হইহল্লা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েক কাপ চা-কফি, ইয়ার-বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা, চানাচুর-মুড়ি, লিটিল ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যা সব মিলিয়েই বইমেলায় আমার পূর্ণতা। পাঠকদের কয়েকজনের সঙ্গে সেলফি নেওয়া, নিজের বইয়ে স্বাক্ষর করা এসবও বইমেলায় এক একটা আনন্দঘন মুহূর্ত।
ছোটবেলায় কেনা দেশ-বিদেশের রূপকথা আজও আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় নতুন নতুন আবিষ্কারের দিকে। ভালোবাসার দিকে। অনেক জীবন প্রত্যাশা ও স্বপ্নের দিকে এবং কল্যাণময় এক সভ্যতা নির্মাণের দিকে। আমি আমার তীর্থক্ষেত্রে পুণ্য লাভের লোভ সামলাতে পারি না। মনের উদ্দাম ঘোড়াটি মানতে চায় না আমার অপারগতার কোনো পরামর্শও।
লিখেছেন : তৈমুর খান
বইমেলা আজও আমার তীর্থক্ষেত্র
সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ
গোলাপ গোলাপ
on
তিনজন কবি
on
রবীন্দ্রনাথ
on
রবীন্দ্রনাথ
on
রবীন্দ্রনাথ
on
মৌলাধুনিকতা
on
মৌলাধুনিকতা
on
অক্ষয় কীর্তি
on
অক্ষয় কীর্তি
on
আমার সময়
on
অক্ষয় কীর্তি
on
অক্ষয় কীর্তি
on
অক্ষয় কীর্তি
on
অক্ষয় কীর্তি
on
অক্ষয় কীর্তি
on
অক্ষয় কীর্তি
on
শুরুর কথা
on
শুরুর কথা
on
ঈদের কবিতা
on
ঈদের কবিতা
on
ঈদের কবিতা
on
স্মৃতির ঈদ
on
ঈদ স্মৃতি
on
ঈদ স্মৃতি
on
ঈদ স্মৃতি
on
স্মৃতির ঈদ
on
স্মৃতির ঈদ
on
স্মৃতির ঈদ
on
আমার ঈদ
on
ঈদের আনন্দ
on
প্রিয়াংকা
on
প্রিয়াংকা
on
গুচ্ছ কবিতা
on
কাব্যজীবনকথা
on