আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
বাংলাদেশের অনেক কবি ‘রুবাই’ বা চার লাইনের কবিতা লিখেছেন। অনেকে ‘রুবাই’ রচনা শুরু করেছেন। ‘রুবাই’ যারা পড়বেন, তারা একটু খেয়াল করলেই অন্য কবিতা থেকে ‘রুবাই’ এর পার্থক্য বুঝতে পারবেন। কবিতার যে ব্যাকরণ, সেই ব্যাকরণের বিশেষ ছন্দ ব্যবহৃত হয় রুবাই এ। প্রথম দুই লাইন ও চতুর্থ লাইনে অন্তমিল ‘রুবাই’ এর অন্যতম বৈশিষ্ট।
এ মুহূর্তে আমি আমার ঘনিষ্ট তিনজন কবির ‘রুবাই’ পাঠের সুযোগ লাভ করছি। কবি কাজী জহিরুল ইসলামের “রুবাইয়াৎ-ই-জহির,” কবি শাহীন রেজার “রুবাইয়াৎ-ই-শাহীন,” এবং কবি ওমর বিশ্বাসের “রুবাইয়াৎ-ই-ওমর বিশ্বাস।” তাদের কাব্য প্রতিভার কাছে আমি আনত। এর আগেও আমি বেশ কয়েকজন কবির ‘রুবাই’ পড়েছি। তাদের মধ্যে বুলবুল সরওয়ার, মানজুর মুজাম্মদ, শামসুল আরেফীন, গোলাম রাব্বানী খান ও আ শ ম বাবর আলী অন্যতম।
কিন্তু আমার কাছে “রুবাইয়াৎ” মানেই ওমর খৈয়াম এবং ওমর খৈয়াম মানেই “রুবাইয়াৎ। খৈয়ামের ‘রুবাই’ এর বাংলা অনুবাদ অনেকে করেছেন। কিন্তু কিছু অনুবাদ ছাড়া বেশির ভাগই ভাবানুবাদ। এমনকি সৈয়দ মুজতবা আলী খৈয়ামের রুবাইয়াতের যে অনুবাদ করেছেন, তারও অধিকাংশ অনুবাদ খৈয়ামের ‘রুবাই’ এর ভাবানুবাদ।
স্কুল পার হওয়ার আগেই কাজী নজরুল ইসলামের অনুবাদে পড়া ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ এবং ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ’ পড়া শেষ করেছি দাবি করলে অনেকে কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। কিন্তু আসলে ওই বয়সেই ‘ডাঙর’ ‘ডাঙর’ মানুষের পাঠোপযোগী অনেক বই পড়ে ফেলেছিলাম। ‘হাফিজ’ এর দিওয়ান তখন মাথায় জায়গা করে নিতে না পারলেও খৈয়ামের ‘রুবাই’ এর অনেকগুলো মুখস্ত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আরো কয়েকজনের অনুবাদে খৈয়ামের রুবাই পড়ার সুযোগ হয়েছে। আমার সুরাসক্তি বা সাকি-অনুরাগ না থাকলেও খৈয়ামের অনেক ‘রুবাই’ এখনও দেহমনে উত্তাপ আনে, হৃদয়ে ঝড়ের তাণ্ডব সৃষ্টি হয়। যেমন:
“শাস্ত্র বিধান এই যদি হয়, হাজির হব রোজ হাসরে
সঙ্গে নিয়ে যা কিছু সব থাকবে যাহা মোর কবরে;
দিয়ো আমার লাশের সাথে, রেখো আমার এই মিনতি
লাস্যময়ী তন্বী বধূ, লাল-শিরাজি পাত্র ভরে।”
আমি নিজে ‘ডাঙর’ হওয়ার পর ফিটজেরাল্ডের ইংরেজি অনুবাদে খৈয়ামের ‘রুবাই’ পড়েছি এবং আমি স্বয়ং হ্যান্স ভ্যান রোসামের ইংরেজি অনুবাদ থেকে খৈয়ামের ‘রুবাই’ এর গদ্যানুবাদ বা আক্ষরিক অনুবাদ করতে গিয়ে দেখেছি যে, কাজী নজরুল ইসলাম খৈয়ামের কাছ থেকে রুবাই এর ধরন ধার করলেও খৈয়ামের রুবাই এর দর্শন এবং ধর্মীয় সংশয়বাদকে গ্রহণ করেননি। তবুও তার অনুবাদ ভালো লেগেছে। যেমন:
“এক সোরাহি সুরা দিয়ো, একটু রুটির ছিলকে আর,
প্রিয়া সাকি, তাহার সাথে একখানি বই কবিতার,
জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথ,
এই যদি পাই চাইব নাকো তখ্ত আমি শাহানশার!”
আমি বাঙালি কবি বন্ধুদের যে রুবাইগুলো পড়ছি এবং আগে যাদের রুবাই পড়েছি, তাদের কয়েকজনের ‘রুবাই’ এর সঙ্গে আমার কবি বন্ধু ছাড়াও কবিতাপ্রেমী বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিতে প্রত্যেকের একটি করে ‘রুবাই’ উপস্থাপন করছি। আশা করি তারা আমার কবি বন্ধুদের ‘রুবাই’ সম্পর্কে জানতে পারবেন।
রুবাইয়াৎ-ই-জহির
“তোমার নামে জ্ঞান-সাগরে নৌকাখানি ভেসে যাক
পড়ছি আমি, ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাযি খালাক।
কী দায় আমার ভুল নগরে নৌকা যদি ভিড়তে চায়
মাঝ-দরিয়ায় ডুবুক তরী, দিক-দিশাহীন ঘুরতে থাক।”
রুবাইয়াৎ-ই-শাহীন
“চলে গেলে রেখো না স্মৃতিচিহ্ন কোনো
এ দেহ মিলাবে ধুলায় শুধু এইটুকু মেনো
মানুষেরা চলে যায় অকাতরে মানুষের মতো
এই আমি পাখি হবো এ কথাটি তুমি জেনো।”
রুবাইয়াৎ-ই-ওমর বিশ্বাস
“প্রশ্ন ছিল মনের ভিতর যাচ্ছি কোথায় মাতাল সুরে
স্বপ্নভূমি ছুঁয়ে দিলাম সুখের বিলাস একটু দূরে
থাকবে পড়ে ভোরের শপথ কল্পনা ও আলপনা মন
ত্যাগের নদী শব্দ কাটে নিঃসঙ্গতায় আপনি ঘুরে।”
রুবাইয়াৎ-ই-বুলবুল সরওয়ার
“দূর থেকে তুমি পাঠিয়ে দিয়েছো মিঠা চুম্বন তাই
আকাশে বাতাসে নব বসন্ত, বৃষ্টির ছোঁয়া পাই
অথচ যখন প্রেমহীন তুমি মনে হয় চৈত্রের
খরা জীর্ণতা ছাড়া পৃথিবীতে কোমলতা কিছু নাই।”
রুবাইয়াৎ-ই-মানজুর
“আলোর ভেতর আলো খুঁজি, চোখের ভেতর চোখ,
হারিয়ে গেল অচিনপুরে আপন সকল লোক,
শুকনো আকাশ দেখে কাঁদে নীলপিয়াসি মন,
মানুষগুলোর রক্ত কণা জ্যোৎস্নাধোয়া হোক।”
রুবাইয়াৎ-ই-রাব্বানী
“নিজের উপর জুলুমকারী পাপী-তাপী বান্দা কভু
আল্লাহ তা’লার রহম হতে কেউ হবে না নিরাশ কভু
নিশ্চয়ই তিনি মাফ করে দেন বান্দার আছে যত পাপ
ক্ষমাশীল আর দয়ার সাগর তিনি হলেন মহান প্রভু।”
রুবাইয়াৎ-ই-আরেফীন
“দুর্গা দেবীর শরীর এখন অসীম ব্যথায় জর্জরিত
চুলের শোভা পুরো সবুজ, মুখের শোভা তিরোহিত
তার নিরীহ কোয়েলগুলো কাঁদছে নীরব আর্তনাদে
আরেফীনের কণ্ঠে কিছু হচ্ছে আর উচ্চারিত।”
জানুয়ারি ২০, ২০২৪