মেঘ
আমি তো মেঘ
তোমায় আমি বৃষ্টি দিয়ে ছুঁই।
তোমার গায়ে রৌদ্র এসে হামলে পড়ে যদি,
বর্ষাজলে কলঙ্ক-দাগ ধুই।
ভ্রমণ নেশা, ছুটে বেড়াই দূর-দূরান্ত নীলে।
আমার ছায়ায় ক্লান্তি মোছে
নতুন দেশের কত হাজার লোক,
অপবাদে খিস্তি করে কেউ
আমি নাকি দিনের আলো সহসা খাই গিলে।
হাওয়ার শকট নেয় ভাসিয়ে
দেশ-মহাদেশ দেখছি ঘুরে ঘুরে।
তোমায় ফেলে যাচ্ছি আমি দূরে?
পাগলি মেয়ে,
চোখ বোঁজো তো,
এবার দেখো,
আমি তো রোজ উড়ে বেড়াই
এক বালিকার মনের আকাশ জুড়ে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৪ জুন ২০২৩।
শ্রাবণ-ভাদর মাসে
পাটের জাঁকের নিচে ঘাঁই মারে এলগন-কাটারিয়া মাছ
ভেঙে পড়ে ঋতুর জলজ ধ্যান কম্পন তরঙ্গে দুলে দুলে
ধ্যানী বক শুভ্র এক ডানার তরঙ্গ তুলে ঝাঁপ দেয় জলে
গোধুলি-সন্ধ্যার ম্রিয়মান জলরেখা ভেঙে তুলে আনে রাতের আহার
বাঁশঝাড়ে অগোছালো বাসা ভেঙে ইতি-উতি চোখ মেলে ভয়
ঝড়ের আতঙ্ক ঠেলে ক্ষুধায় দুভাগ হয় হলুদাভ ঠোঁটের নিগড়
ছোটো দুই শিশুবক কাকস্য-মহাপ্রাণ-কর্কস শব্দে খোঁজে মাতৃছায়া।
মেঘনার শাখা ধরে ভাটির স্রোতের টানে হাট থেকে ফিরে যায় কুমারের নাও
গুটিধরা জল ফুঁড়ে উঠে আসে সোদাগন্ধ জলের মাদক
শ্রাবণ-ভাদর মাসে নিরাক মেঘের বুক মায়াভরা জলে,
ছায়া ফেলে প্রগাঢ় বৃত্তের রেখা, নীড়ে ফেরা পাখিদের ঝাঁক।
উঠোনে কাঁথার ফোড়ে সোনারং স্বপ্ন বোনে পোয়াতি নতুন বধূ একা
কুটুমের মতো রাত নেমে এলে প্রকাণ্ড উঠোনে
কাঁথার বাগান থেকে বৃন্ত ছিঁড়ে ছিঁড়ে পাড়ার কিশোরী বধূ
সহস্র তারকা-ফুল উড়ন্ত চুমুর মতো ছুঁড়ে দেয় রাতের আকাশ অভিমুখে।
ম্যানহাটন, নিউইয়র্ক। ২৫ এপ্রিল ২০২৩।
দুটি বাড়ি
একটি বাড়ি চেরি ব্লসম অন্যটি খুব শুভ্র ম্যাগনোলিয়া,
একটি বাড়ি আনন্দধাম অন্যটি খুব দুঃখ জাগানিয়া।
একটি বাড়ি কাল সকালে ঘর-পালাবে
আজ সারারাত প্রস্তুতি নেয় তার,
আটকে পড়া এই বাড়িকে
অন্য বাড়ির সাহস এসে করবে কি উদ্ধার?
একটি বাড়ি শ্রাবণ ধারা জলের নিচে ভাসে
একটি বাড়ি হেমন্ত রোদ খলবলিয়ে হাসে।
একটি বাড়ি ভাঙতে ভাঙতে জল
অন্যটি খুব নদীর পাড়ে আনন্দ মহল।
একটি বাড়ি পাখি হলে অন্যটি হয় নীল
মেঘের নিচে ডানা মেলে বৈকালী গাংচিল।
একটি যদি কানকোতে ভর, নদীর খোঁজে ছোটে
অন্যটি জল-গঙ্গা হয়ে উঠোন জুড়ে ফোঁটে।
যদি দেখো পথ হয়ে যায় দুরন্ত এক বাড়ি
এক নিমেষে অন্যটি হয় নিষ্ঠ পথচারী।
এই দু’বাড়ি পরস্পরের ঘোচালো বদনাম
ওরা এখন সবার প্রিয় ভালোবাসার গ্রাম।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১২ মার্চ ২০২৩।
প্রমিত-বৃত্ত
তোমাদের সাহেবী কবিতাগুলো স্যুট-টাই পরে গঙ্গাস্নানে নেমে পড়ে;
দেশিগুলো নেংটি পরে ঢুকে পড়ে কর্পোরেট সভায়,
বহুজাতিক কোম্পানির নান্দনিক সুউচ্চ ভবনে।
কতোবার বলবো একথা আর
নেংটি পরলেই গান্ধী হওয়া যায় না।
মন্দিরেই যখন যাবে তো গেরুয়া-চর্চাই করো,
একদিন বস্ত্র মলিন হয়ত হবে, খসে পড়বে গা থেকে,
আব্রু না ঢাকার অপরাধে কেউ দোষ দেবে না তখন।
প্রমিত-বৃত্তে হাসফাস লাগে?
এটিই সভ্যতা,
পৃথিবীর প্রথম প্রমিত-উচ্চারণ ধর্ম-বৃত্ত,
তোমাকে কেন্দ্রের আলোর দিকেই টেনেছিল।
সেই আলোতেই পুড়িয়েছ বৃত্তের দেয়াল।
দেয়াল ভাঙার সবচেয়ে উপযুক্ত হাতুড়ি তো দেয়াল-বৃত্তের কেন্দ্রেই রক্ষিত,
খোঁজো ওকে,
শিখে নাও মন্দ্রধী ওঁ থেকে উচ্চারিত মন্ত্রের গূঢ়ার্থ,
তুমি তো বৃত্তই দেখোনি, ভাঙবে কী বলো তো?
বৃত্তের ভেতরে ঢোকো আগে;
এবার লুণ্ঠন করো কেন্দ্রের ঐশ্বর্য,
এরপর বৃত্ত ভাঙো…
যখন দাঁড়াবে এসে উন্মুক্ত উদ্যানে,
ভালো করে তাকাও তোমার চারপাশে,
কী দেখছো? এক সুবৃহৎ বৃত্ত।
একটি নতুন এবং বৃহৎ বৃত্তের ভেতরে এখন তোমার অবস্থান,
বৃত্তাবর্ত থেকে প্রকৃতপক্ষে কারোর মুক্তি নেই।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩।
শীতের প্রেইরি
কাচের দরোজা,
ওপাশে শীতের মাইক্রোবাস ছুটছে।
দরোজার কাচে
মানুষের মুখ নানা রঙের, ফুটছে।
জবুথবু গাছ হুডতোলা,
ফুটপাতে হাঁটে, ছায়া, মায়া অশ্বত্থের।
বিচিত্র স্ট্র, পত্রগুচ্ছ, চুমুকে চুমুকে
রোদেলা দুপুর, লা-নিনা প্রসূত প্রবল প্রপঞ্চ-প্রহরের।
বন্ধ্যা রমণীর চোখ আলো ফেলে আসন্ন বসন্তে,
মৃত ডাল আড়মোড়া ভাঙে;
পুষ্পবীথি-রঙে প্রেইরি রমণীরা পৃথিবীর নির্জন স্টেশনে বসে একত্রে একাকী
অতিকায় বুনো বিহঙ্গ-বিকেল রাঙে।
জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩।
এই বাড়িটা
এই বাড়িটার বব ছাটা চুল।
বিকেলবেলা বারান্দাতে করুণ দুটি ঘুঘু
বিষণ্নতা রোপন করে;
মাঝের ফ্লাটে হাওয়ায় দোলে লম্বা কানের দুল।
এই বাড়িটা তাঁতের শাড়ি।
হৈমন্তী হাওয়া এসে ছাদ ঝাড়ু দেয়
প্রায়ান্ধ রোজ প্রদোষকালে;
ছাদ-বাগানে বাড়ছে দুটি রক্ত-আনার,
তরতরিয়ে বাড়ছে তাড়াতাড়ি।
এই বাড়িটার কপালে নীল টিপ।
দুপুরবেলা চিলেকোঠায় ডায়াস্পরা মেঘ,
ব্লাক-লেভেলে মাতাল হতে আসে।
এই বাড়িটা কী উজ্জ্বল এক দ্বীপ,
চতুর্দিকে ঢেউয়ের তালে বাল্মিকী-হাঁস ভাসে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
তুষার-অভিযাত্রী
ধুসর ব্লেজার পথ দেখায় রাত্রির
নিরাপদ সঙ্গী তুষার-অভিযাত্রীর।
শাদা হ্যাট এক জ্বলে আছে অত্যুজ্জ্বল
আলোকবর্তিকা সে এ-পথের প্রবল।
ছেঁড়া বুটজোড়া ভয় তাড়াতে সশব্দ
স্বপ্নের সুদীর্ঘ রাস্তা বাজে, রাত্রি স্তব্ধ।
ভৌতিক বাতাসে ওড়ে স্কার্ফের দু’ডানা
নিসঙ্গ রাতের পাখি নিবাস অজানা।
অরণ্যের শুভ্র সিঁথি গতিময় দাগ
স্বপ্নের যাত্রায় দ্রুত ছড়ায় পরাগ।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৭ জানুয়ারি ২০২৩
শীতকন্যা
কুয়াশা-জাল ছিঁড়বো বলে সূর্য দিলো নোখ
শীতকন্যার দুই চোখে জল আব্রুহারা শোক।
নগ্ন শীতের অশ্রুজলে শুভ্র জানুয়ারি
ক্লোজেট থেকে ম্যাগনোলিয়া নামায় রঙিন শাড়ি।
ইতি-উতি চোখ মেলে চায় টিউলিপের পোনা
হাইড্রেঞ্জা তৈরি হাতে গুচ্ছ কাচা-সোনা।
ওভারকোটের বুক-পকেটে চলছে আজব ঘড়ি
লেপের নিচে ফেব্রুয়ারির উষ্ণ জড়াজড়ি।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৬ জানুয়ারি ২০২৩।
প্রতিবাস্তব কবিতা
মাংসের ভেতরে ডিপফ্রিজ ফুলকপি হয়ে আছে,
মধ্যবিত্ত গৃহিণীদের জ্বলন্ত চুলোগুচ্ছ শব্জি-আনাজ বাগানে ঝুলন্ত বাদুড়,
সারি সারি স্কুলবাস শিশুদের কোলে,
ব্যাকপ্যাকে
শিশুরা রঙিন মলাটের মাঝখানে প্রযুক্তি-সভ্য নতুন পৃথিবীর পাঠ।
সকালের উষ্ণ কফি নবদম্পতির কামপ্রবণ ঠোঁটের উত্তাপ নিঙড়ে নেয় ফোঁটা ফোঁটা।
সেলফোনগুলো সারাদিন আঙুলের স্ক্রিনে টেপাটিপি করে;
ভার্চুয়াল রস ছলকে ছলকে ওঠে আনন্দ-কলসে।
যুগ পাল্টে গেছে
এখন টিভিতে বসে না লেদার সোফাগুলো আর,
আঙুলের গাছেই ফুটছে বিনোদন পুস্প,
গুচ্ছ গুচ্ছ রসালো ওয়েব-সিরিয়াল।
কবিতার জটিল শব্দেরা, উপন্যাসের উর্বশী রম্ভা,
নিয়ত এখন চুমু খায় আঙুলের উষ্ণতায়।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৬ ডিসেম্বর ২০২২।
দখলের মহামারি
আপেলের ভেতরে একটি উত্তপ্ত বুলেট।
মুখ-থুবড়ে পড়েছে স্বপ্নের বেলুন।
সঞ্চিত দখিনা হাওয়া পোড়ে ক্রমাগত শরতের কাশবন
অপরিণামদর্শী গ্রীষ্মের দাহে;
বিষবায়ু ছাড়া শহরে খোলা-জানালা নেই আর।
মাছেদের জন্যে নদী-চিহ্ন বিভ্রম-প্রবাহ
জ্যোৎস্নার বিষণ্ণ চাতালে হাঁসফাস, থিকথিকে গ্রিজ;
মৃত পাখিদের দীর্ঘ মিছিল সৈকতে,
পথকুকুরের তারস্বরে বিদীর্ণ ভয়ার্ত রাত্রির প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা।
অদ্ভুত দর্শন একদল প্রাণীর দখলে দেশ,
তাদের বিষাক্ত ডিমে প্রত্যহ তা দেয় সর্বোচ্চ সনদ,
চেতনার পাখনা ছড়িয়ে।
ডিম ফুটে, তপ্ত কড়াইয়ে ভূট্টার খই,
আরো আরো অদ্ভুত চেতনা-শিশু।
দৃষ্টির উত্তাপে ভষ্ম উপমহাদেশ-সম্প্রীতি, ঐক্যের পলিমাটি,
হাওরের জল-কাদা, নিস্ফলা ধুসর, বন্ধ্যা নারী।
চারদিকে শুধু আজ দখলের তীব্র মহামারি।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৬ ডিসেম্বর ২০২২।