spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধবহু জন্ম ঘুরে ঘুরে নাসিম-এ-আলম এই পৃথিবীর মানুষ

লিখেছেন : তৈমুর খান

বহু জন্ম ঘুরে ঘুরে নাসিম-এ-আলম এই পৃথিবীর মানুষ

তৈমুর খান

      এক
       🍁

মাটির একখানা ছোট্ট বাড়ি, টিনের চাল, খেজুর পাতার তালায় পেতে আমরা কয়েকজন কিশোর কবিতাবাসর যাপন করে চলেছি। মাঝে মাঝে বড় গামলায় রাখা মুড়ি ও চানাচুর মুঠো ভরে তুলছি, খেতে খেতেই শুনছি কবিতা। একবার করে চা ঢেলে নিচ্ছি। পরপর কয়েক কাপ সাবাড় হয়ে যাচ্ছে তার কোনো হিসেব নেই। কত রকমের কবিতা তখন মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। সেগুলো আদৌ কবিতা কিনা তা আমরা নিজেরাই বিচার বিশ্লেষণ করছি। আমাদের মধ্যমণি নাসিম-এ-আলম। তাঁর মতামত শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকছি। কিন্তু নাসিমের কবিতা সম্পর্কে কে বলবে? সে দায় তো আমার উপরেই এসে পড়ছে। নাসিমের কবিতায় বরাবরই একটা প্রাচীন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারীকে খুঁজে পেতাম। নাসিম যেন বহু জন্ম ঘুরে ঘুরে এই পৃথিবীর মানুষ। তারপর এক সময় টুপ করে বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের নিকটস্থ নিমড়া গ্রামে আবির্ভূত হলেন ১ জুন ১৯৬৬। মাতামহ এম আব্দুর রহমানের সাহিত্যসাধনা দেখে বড় হলেন। তাই সেই অভিজ্ঞতাকেই তুলে ধরলেন তাঁর নিবন্ধ সংকলন ‘স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবাংলার মুসলমান সমাজ ও সাহিত্য’ গ্রন্থে। এখানে
লিখেছেন: ‘বিস্তৃত ইতিহাসের ঐতিহাসিক এম আব্দুর রহমান’
“মাটির ঘর দোতলার বারান্দায় বসে এক মনে লেখার কাজ চলছে। দুপাশে পুরনো দিনের পত্রপত্রিকা দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ। লেখার বিরতি দিয়ে কখনো কোনো পেপার কাটিং আঠা দিয়ে সেঁটে দিচ্ছেন পাতায়, যে বিষয়ে লেখালেখি তার প্রমাণ বা সহায়ক তথ্য। ঘর জুড়ে শুধু বই। সামনে দ্বিতল পাকা বাড়ি, ওখানে থাকেন না লেখক। তাঁর মন মাটির বাড়িতে, যেখানে লেখকের মা-বাবার স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। পাকাবাড়ির ছোট্ট একটা ঘরে ‘মুসলিম অনুসন্ধান সমিতি’র লাইব্রেরী। যার আলমারি জুড়ে পুরনো দিনের সওগাত, মোহাম্মদী, দৈনিক আজাদ. দৈনিক সেবকের নানা সংখ্যা শোভা পাচ্ছে। আছে ছয় এর দশকের ‘কাফেলা’র নানা সংখ্যা। দিন মাস বছর অতিক্রান্ত হয়ে এভাবেই একে একে চল্লিশটি গ্রন্থ প্রকাশ। অজস্র পত্রিকায় লেখালেখি। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে নিরন্তর লিখে যাওয়া।” নাসিমও তাঁর মাতামহের মতোই মাটির বাড়িতে থাকতে ভালবাসতেন। পাঠ করতেন প্রাচীন সাহিত্য, পত্রপত্রিকা এবং বিদেশি বহু ক্লাসিক সাহিত্য। তাঁর লেখার মধ্যেও সেসব প্রতিফলিত হয়েছে। নিজেকে পরাবাস্তবের প্রান্তরে ছেড়ে দিতেন। তাঁর চেতনা প্রবাহ প্রত্নযুগের কোনো কিংবদন্তির রহস্যে ঠিকানা খুঁজে পেত। বেশিরভাগই একাকিত্ব উপভোগ করতেন কোনো নির্জনে গিয়ে। প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর নীরবে কথোপকথন চলত। তাঁর সমস্ত কাব্যগুলিতেই এক মরমী ভালোবাসার প্রবাহ ফল্গু ধারার মতো বয়ে যেত। রহস্যলোকের চাবি খোঁজার মতোই আমরা আকর্ষণ অনুভব করতাম। ২৪ অক্টোবর ২০২২ রাত্রি নটা সাতাশ মিনিটে সেই নাসিম-এ-আলম নিজেই রহস্যলোকে অন্তর্হিত হলেন।

    দুই 
    🍁

“যাযাবর সেজে আমি জিপসী মেয়ের খোঁজে
চলে আসি গ্রাম থেকে অন্য এক গ্রামে
গ্রাম জানি কতটা সবুজ, স্তব্ধ, চন্দনের গাছ
তুঙ্গাভদ্রা তীরে আজ আগুন না উপবাস
কে ভেঙেছে কে রেখেছে প্রেম বিলাসিনী।”
‘চাঁদ সদাগর ফিরে আসবে’ কাব্যের ‘…এবং ভ্যানগঘ’ কবিতায় নাসিম-এ-আলম লিখেছেন এই লাইন কয়টি। নিজের কবিজীবনকে শিল্পী ভ্যানগঘের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন। শিল্পী নিজের প্রতিকৃতি আঁকতে গিয়ে সার্কাসের ক্লাউনের মতোই স্তব্ধতায় নিঃসঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন। নিঃসঙ্গ প্রেতের মতোই তাঁর নষ্ট দরবেশের গৃহ, তেলরং জলরং-এর আত্মপ্রতিকৃতি। নাসিমও নির্বাসিত শিল্পী জীবনের এই ধারক ও বাহক হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন তাঁর প্রেমপ্রত্যাশী আকাঙ্ক্ষার অনুবর্তী জিপসী মেয়েকে। আর সেখানেই ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসখ্যাত তুঙ্গাভদ্রার নদীতীর জেগে উঠেছে। রামায়ণ খ্যাত তুঙ্গাভদ্রা বা পম্পা নদীতীরেই রামচন্দ্র সীতার খোঁজ করতে গিয়েছিলেন। সেই পুরুষ হৃদয় নিয়েই তিনি চির অন্বেষণের পথিক। তাই এই কবিতার শেষ অংশে লিখলেন:
“শিল্পে রাখি শুকসারি
শিল্প রাখি অসহায় বছর পঁয়ত্রিশ
তেলরঙ, জলরঙ
আমাদের সুখে থাকতে নেই।”
৩৫ বছর বয়সে লেখা এই কাব্যটির মধ্য দিয়েই কবি তাঁর শিল্পীজীবনের অসহায়তা ও শূন্যতাকে, চির অন্বেষার প্রজ্ঞায় প্রতিফলন ঘটালেন। কবি-শিল্পীরা যাবতীয় পার্থিবসুখের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। তাই তাঁদের জীবনে অপূর্ণতা থেকেই যায়।
নাসিমের কবিতা পাঠ করলে একথাই বারবার মনে হতে থাকবে, নাসিম যেন নির্দিষ্ট কোনো সময়ের নয়, নির্দিষ্ট কোনো দেশের নয়, শুধু ‘নাসিম’ নাম ধারণ করেছে বলে তাঁর শেষ পরিচয়ও নাসিম নয়। পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকেই তাঁর জন্ম। আবহমান সময় ধরেই বিভিন্ন জন্মের ভেতর দিয়ে তিনি পৃথিবীতে বিরাজ করছেন। সিন্ধু সভ্যতা অথবা হরপ্পা সভ্যতাতেও তিনি ছিলেন। মিশরীয় অথবা গ্রিক সভ্যতাকেও তিনি নিরীক্ষণ করেছেন। বাইজানটাইন সভ্যতাতেও তিনি বিচরণ করেছেন। ফিনিশীয় সভ্যতার মানুষকেও তিনি চিনতেন। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে তাঁর স্বাক্ষর পাওয়া যাবে। কোনো কোনো পিরামিডে তিনি নিহিত আছেন। চর্যাপদ থেকে ওমর খৈয়াম, বুদ্ধ থেকে স্টিফেন হকিং, জেরুজালেম থেকে আমেদপুর স্টেশন, ধানফুল থেকে হ্যারিপটার, রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ সকলের হৃদয়ের মধ্যেই, সকলের দৃষ্টির মধ্যেই, সকলের উপলব্ধির মধ্যেই, সকল সময়ের মধ্যেই তিনি যেন সঞ্চারিত হয়েছেন। তাই কবিতা লিখতে গিয়ে সে-সবই ফিরে এসেছে। সে-সবেরই পদধ্বনি তাঁর বোধের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে। ‘চাঁদ সদাগর ফিরে আসবে’ কাব্যেই ‘গোলাপ যখন’ কবিতায় লিখেছেন:
“ভেবে দেখি ভুল পথে ঘুরেছি অনেক
অযথা ঘুরেছি আর মধ্যপ্রাচ্য
মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন মেয়েকে বলেছি
জন্মান্তরে কত রাত ছিলাম এখানে
শীতার্ত পাখির উষ্ণ ওম্ ছিল পাতার বলয়ে
কেবা কাদের প্রশ্ন নয়
ধর রাখাল বালক
চামড়া পোশাক সঙ্গে বিশ্বাসী লাঠিটি
সেও কি চেয়েছে পশুর পালের পিছে
আরও পিছে চোরাপথে
গোলাপের রহস্য বুঝে নিতে”
কবির জন্মান্তর অনেক ভুল পথ অতিক্রম করেছে। তবু সেই আদিম সভ্যতায় চামড়ার পোশাক পরা, শীতার্ত পাখির পাতার বলয়ে উষ্ণতা, অথবা পশুপালক হিসেবে জীবিকা নির্বাহের পথ অতিক্রম করা সবই ছিল। সবকিছুর মধ্যেই প্রেমের উত্থান কবির হৃদয়কে স্পন্দিত করেছে। সেই প্রেমই গোলাপ রহস্যে পরিণত হয়েছে আধুনিক সভ্যতায়। ‘জন্মান্তর’ এবং ‘মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন মেয়ে’ কথা দুটির মধ্যেই সেই ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে। আর একটি কবিতায় সাইবেরিয়ার নোনাজলে ডুবে যাওয়া বাড়িটি মনে পড়েছে কবির। আধুনিক কলকাতায় চোখ বন্ধ করে কবি জব চার্নকের ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেয়েছেন। মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্যেও তিনি নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। বয়ে যাওয়া জীবনের স্রোতকে তিনি ভালোবাসার শব্দে নির্মাণ করেছেন কবিতায়। লৌকিক জীবনের নানা রং, ইতিহাসবোধ, কাহিনি ও উপকাহিনির ভিতর আমাদের নিয়ে গেছেন। সভ্যতা ও জীবনকে চিনিয়েছেন। এক মোহময় অলৌকিক ঘোরে আচ্ছন্ন করে দিয়েছেন। সময় ও ভৌগোলিক দূরত্ব মুছে গেছে। আমরা যেন একটা সময়ে, একটা যুগে, একটা বিশ্বজীবনে প্রবেশ করেছি।
প্রথম কাব্য ‘আইরিশ কলোনীতে সন্ধ্যা’ নামকরণের মধ্যেই নাসিমকে আইরিশ কলোনির রাস্তায় আবিষ্কার করা যায়। আবার ‘আবার বেদুইন লিখিত’ কাব্যে মরুচারী নাসিমকে বেদুইন রূপেও দেখা সম্ভব। তাদের জীবনধারা আর প্রাচীন উপকথায় নাসিমও মিশে গেছেন। তাই ক্রিয়াপদকে উত্তম পুরুষে ব্যবহার করেছেন:
“বাগদাদে এলাম রাজনর্তকীর হাত ধরে
গৃহমুখী নৈশ আগুনে রুটি সেঁকে নিতে
তরমুজ খেতে অজস্র তরমুজ সুপক্ক খেজুর
মেহমান আসুক গৃহে আড্ডা হবে
ইউসুফ-জুলেখার প্রেম মেখে আছে পাতার শিশির।

স্যাবিয়ান কিশোর হাতে ইউক্লিড
পেলাম অবগাহন তোমার তিরস্কার
জাগ্রত স্বপ্ন ছিল তাই কাজল এনেছি
এনেছি জরির ওড়না, সিরিয়ার নাকছাবি, বাজুবন্ধ
ভাবি সারাদিন
কীভাবে আলিঙ্গন হবে মোহময়, নিঃশব্দ
কীভাবে গানের আলাপ শুনে ঝরে পড়বে অশ্রু তোমার।”
বাগদাদ আমরা চিনতে পারি, সেখানকার ফসল তরমুজ এবং খেজুরও আমরা জানতে পারি। ইউসুফ-জুলেখার প্রেমের উপাখ্যানও মিথ হিসেবেই উঠে এসেছে। স্যাবিয়ান কিশোরকে ইউক্লিড হাতে দেখা যায়। সিরিয়ার জরির ওড়না, নাকচাছি, বাজুবন্ধ সবই সেই ভূষণ; নিঃশব্দ আলিঙ্গনের জন্য কবিও তৈরি হয়েছেন। আরব্যরজনীও এই কাব্যে বারবার ছায়া ফেলেছে। বাইবেল তৌরাত জেন্দাবেস্তা সবকিছুর মধ্যেই কবির আত্মদর্শনের গভীর নিমগ্ন উপলব্ধির ভাষা খুঁজে পেয়েছি। শিরোনামহীন এই কাব্যের আর একটি অংশে বলেছেন:
“মাটির হাঁড়িতে লাল চাল,সেদ্ধ হচ্ছে পাখির মাংস
তাঁবু পাহারায় উপজাতি কিশোর দু-একজন, সামনে স্তূপিকৃত আগুন
স্বপ্নে দেখি বিলকিসের সিংহাসন উড়ে যাচ্ছে
সাদা সাদা মেঘ, বালির উপর তার ছায়া
এক মাসের পথ নিমেষে পেরিয়ে যাচ্ছে কেউ।”
একটা রূপকথার মধ্যে আমরা প্রবেশ করলেও বাস্তবতাকে কবি অস্বীকার করেননি। তাই যাযাবর আদিম জাতির জীবন জীবিকার দিকও নির্দেশ করেছেন। মাটির হাঁড়িতে লাল চালের ভাত, পাখির মাংসও সেদ্ধ হচ্ছে। এই জীবনের মধ্যে তিনিও শামিল হয়েছেন, কিন্তু সাদা সাদা মেঘ আর ছায়া দেখে তিনিও রোমান্টিকতার দেখা পেয়েছেন।
কবির আত্মঅন্বেষণের যেন শেষ নেই। প্রথমদিকের কাব্য ‘লিটল ম্যাগাজিন ও অন্যান্য কবিতা’তেও ‘তুতেন খামেনের মমি’ সিরিজে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন:
“আবার পথের বাঁকে দেখা হল তুতেনখামেন
নিজস্ব ময়ূরপালকহীন হেমন্তের রাতগুলি শিশিরে খসেছে
সেরা ও গন্ধকের বর্ণে ভিজে ভিজে
আমিও দ্বিতীয় প্রাণ পুনর্জন্ম ভিক্ষা করেছি,
চেয়েছি মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে
দ্রাক্ষাকুঞ্জে, নর্তকি মায়ায়।”
তুতেনখামেনের সময় থেকেই কবি অবিরাম পথ হেঁটে চলেছেন, পুনর্জন্ম ভিক্ষাও করেছেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে সেই প্রেমের কাছেই পৌছাতে চেয়েছেন। তাই ‘দ্রাক্ষাকুঞ্জে’ ও ‘নর্তকীমায়া’ কথা দুটিতেই কবির জাগ্রত মোহময়তা অথবা পার্থিব আসক্তির প্রগাঢ় রূপ ধরা পড়েছে। নিজে কোন্ ধর্মের অনুসারী তা তিনি জানেন না। তাই বলেছেন:
“কী ছিল ধর্ম পরিচয়, ইহুদি ধর্ম নাকি নগরের সম্মুখে
মেয়েটির হাত ধরে নতুন ধর্ম বর্ণ খোঁজা,”
কবি যে মানুষ, মনুষ্যত্বই তাঁর একমাত্র বাহন, ধর্ম সেখানে বাইরে থেকে আরোপিত, ভালোবাসার টানেই তাকে স্বীকার করা এ কথা কবি অকপটেই বলতে পেরেছেন।
‘ধুলোর নির্জনে লেখা’ কাব্যেও কবির গতি কখনোই স্তব্ধ হয়নি। মানুষের ডানা ছিল, যা অদৃশ্য ডানা, যার ফলে মানুষ বহুদূরের পথ অতিক্রম করতে পেরেছে সহজেই। কবি সেই ডানাই খুঁজতে চেয়েছেন:
“হাঁটছি মরুভূমি পেরিয়ে অক্ষরবৃত্ত পেরিয়ে
হাঁটছি জুরাসিক যুগের প্রান্ত ঘেঁষে ঘেঁষে
খুঁজছি কোন যুগে মানুষের ডানা ছিল।”
এই ডানা-অন্বেষণ বাস্তবে আমাদের সভ্যতার রূপদর্শনকেই স্পষ্ট করে। আদি যুগ থেকেই জীবনের উত্থান কত বিচিত্র ও বিস্ময়কর কবি তা জানেন। মানুষের চরিত্রও কত ছলনা ভরা তারও টের পেয়েছেন। বিশেষ করে প্রথমা স্ত্রী শুভশ্রী রায়ের সঙ্গে কবির বিচ্ছেদ কতটা বেদনার ছিল, কতটা শূন্যতার ছিল তা অনুভব করেই ‘ধুলোর নির্জনে’ এসে বলতে পেরেছেন:
“পুরোনো বিচ্ছেদ থেকে গান ভেসে আসে
আমাদের উন্মাদ কবিতা যাপন,নয়েরর দশক।

খোলামকুচিগুলি সযত্নে রেখেছি
তোমার প্রত্যাখ্যান সযত্নে রেখেছি
নতুন উপন্যাস লিখবো আগামী নভেম্বরে।”
কবি তো ভালোবেসে শ্মশান অবধি হেঁটে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। কবি তো যাবতীয় অসুখ স্পর্শ করারও অঙ্গীকার করেছিলেন। কবি তো অপেক্ষা করেছিলেন তার কাছ থেকে শীতে একটা সোয়েটার উপহার পাবেন। কিন্তু সবই অধরা থেকে গেল। এই নভেম্বর আর উপন্যাস লেখার সুযোগ দিলে না। ডাকবাক্স খালিই পড়ে থাকল। দুঃখ বিরহ অভিমান ঘেঁটে বিদায় নিতে হল কবিকে। এই অভিমানের এবং বিরহের স্বরূপটি আরও প্রকট হয়ে উঠেছে জীবিত অবস্থায় প্রকাশিত শেষ কাব্য ‘বাসমতী ধানের অগ্রহায়ণ ও ঝুমকোলতা’য়।

    তিন
     🍁

রোগাক্রান্ত জীবনের ক্ষয় প্রতিমুহূর্তেই উপলব্ধি করেছেন নাসিম। মৃত্যুকে তিল তিল করে যাপন করার মধ্যেই ‘বাসমতী ধানের অগ্রহায়ণ ও ঝুমকোলতা’ কাব্যের কবিতাগুলির বুনন চলেছে। অন্তিম জীবনের হাহাকারের মুহূর্তে কবি প্রেমকেই আশ্রয় করতে চেয়েছেন। তাই ‘ঝুমকোলতা’ আবহমানকালের প্রেমিকাসত্তা,যে প্রেমিকাসত্তা সমস্ত শক্তির উৎস, রূপে অরূপে রূপান্তরে জেগে উঠেছে। বাসমতী ধানের অগ্রহায়ণ কৃষকের ধান তোলার মরসুম। যে কৃষক সারা বছর ধরে পরিচর্যা করে বাসমতী ধান ফলিয়েছে তা ঘরে আনার সময়। তা গোলায় ভরার সময়। এখানে কৃষক তো কবি। কবির প্রেমিকসত্তা। যে বোধের ক্ষেত্র তাঁর বাসমতী-শব্দের প্রতিফলনে পূর্ণ হয়ে উঠেছে, সেই ক্ষেত্রে তো ঝুমকোলতাকে আহ্বান করা কবির কর্তব্য অথবা হৃদয়েরও ডাক বলা যায়। সেই ঝুমকোলতাকে প্রত্নযুগ থেকেই কবি আবির্ভূত হতে দেখলেন। পল ভলেরির তৃষ্ণা নিয়ে কবি জেগে আছেন। উপনিষদের দেশেও ছিলেন। যুদ্ধে দাঙ্গায় মহামারিতে কবি নিঃস্ব হয়েছেন। পোড়া শরীর, ক্ষত শরীর, পোশাকে রক্তের দাগ নিয়ে জেরুজালেমের পবিত্র জলে ধুয়ে নেবার বাসনায় কবি এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি হাতে নিয়ে এখন গান শুনতে চান ঝুমকোলতার কাছে। কবি স্পষ্ট করে বললেন:
“পৃথিবী প্রাচীন হলে অশরীর নিয়ে বেঁচে থাকি
ঘুমের বড়ির মাঝে রাতের অমৃত অনুরাগ, আমার স্নায়ুর পাশে
আমার রক্তপ্রবাহের পাশে তুমি, ঝুমকোলতা কবির আশ্রয়।”
ঝুমকোলতা আরোগ্যের আকাশ, ঝুমকোলতা মৃতসঞ্জীবনী। মধ্যরাতে দোযখের ডাক শুনেন কবি। ফেরেশতারা কাফনগীতি গায়। কিন্তু ঝুমকোলতা যে গান আনে তাতে কাফনের ঘ্রাণ নেই। তাতে শুধু শিশিরের চঞ্চলতা। স্নিগ্ধ প্রাণের উন্মুখ উত্তরণ। ঝুমকোলতার সঙ্গে কবির সংসার হয়। ঝুমকোলতা কাঠকুটো জ্বেলে মাটির উনানে মাটির হাঁড়িতে ভাত রান্না করে। ঝুমকোলতা দেশে ও বিদেশে, ঝুমকোলতা অতীতে ও বর্তমানে সমস্ত স্রষ্টার সৃষ্টিকেই পরিচালনা করে। তাই গুহাজীবন থেকে নাগরিক জীবনের সংঘাতেও তার দেখা পাওয়া যায়। কবি শেলী. রবার্ট ফ্রস্টও তার দেখা পেয়েছিলেন। যে হৃদয় থাকলে, যে উপলব্ধি জন্মালে, যে স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার উচ্ছ্বাস জাগলে, যে কল্পনা সর্বব্যাপী জীবনকে বিস্তৃত করার শক্তি যোগায় তাকে অনুধাবন করতে পারলেই ঝুমকোলতাকে বোঝা সহজ হয়। আমেরিকান বিখ্যাত লেখক ওয়েন ওয়াল্টার ডায়ার (১৯৪০-২০১৫ ) বলেছেন:
“Loving people live in a loving world. Hostile people live in a hostile world. Same world.”
(Wayne W. Dyer (2009). “Staying on the Path: Easyread Super Large 20pt Edition”, p.54,)
অর্থাৎ প্রেমময় মানুষ একটি প্রেমময় পৃথিবীতে বাস করে। প্রতিকূল মানুষ বৈরী পৃথিবীতে বাস করে। একই পৃথিবী।
নাসিম সেই প্রেমময় পৃথিবীরই কবি, তাই ভালোবাসার অস্তিত্বের মধ্যেই জীবনের গভীর অন্বয় খুঁজে পান। প্রেমই তাঁর কৃষি, কবিতাই তাঁর ফসল, হৃদয়ই তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী। যতদিন হৃদয় থাকবে ততদিন কবিতাও থাকবে। ততদিন এই কৃষক সমাজ। জীবনানন্দের ঝুমকোলতা, কীটসের ঝুমকোলতা, মার্কেজের ঝুমকোলতা,মপাসাঁর ঝুমকোলতা, শেক্সপিয়ার-ওয়ার্ডসওয়ার্থের ঝুমকোলতা, ভিঞ্চির তুলিতে ফুটে ওঠাও ঝুমকোলতা সবই প্রেমময় জগতের বিভা হয়ে উঠেছে। অনন্তজীবনের উচ্চারণের মধ্যেই এই ঝুমকোলতার অবস্থান কবি বোঝাতে চেয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় ঝুমকোলতাকে পেয়েছেন। স্তব্ধতায় পেয়েছেন। মুখরতায় পেয়েছেন। রাত্রির অন্ধকারে,জ্যোৎস্নায় তাকে দেখেছেন। বাউলের গানে, সিন্ধুতীরে, জাদুঘরে, বিলুপ্ত নগরীতে, মেসোপটেমিয়ার রানির রূপে, গোলাপের বাগানে, আকাশের নক্ষত্রে তার ব্যাপ্তি। কবি ঝুমকোলতাকে বললেন:
“এবার ঘুমোতে যাও ঝুমকোলতা
কয়েক আলোকবর্ষ মাত্র আমি জেগে থেকে অপেক্ষা করব!”
কবির অপেক্ষা আমাদের প্রত্যেকের অপেক্ষা হয়ে রয়ে গেল।

🌳

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা