আবু তাহের সরফরাজ
পাঠক কবিতা কেন পড়বে? বেশ খটোমটো প্রশ্ন। তবে সম্ভাব্য কয়েকটি জবাব আমি দিতে পারব। ক. ভালো লাগে, তাই পড়বে। খ. নিজের অনুভূতির সাথে কবিতার অন্তর্নিহিত অনুভূতির যখন রসায়ন ঘটবে, তখন পাঠক কবিতা পড়বে। গ. শৈল্পি ও রুচিমান জীবন পদ্ধতির প্রতি যে পাঠকের ঝোঁক সেই পাঠক তার রুচিকে শাণিত করতে কবিতা পড়বে। আপাতত এই তিনটে জবাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে। মোটামুটি হিসেবে দেখা যাচ্ছে, পাঠকের বোধের জগৎকে তাড়িত করবে বলেই পাঠক কবিতা পড়ে। এখন আমি বিনয়ের সাথে জিগেশ করবো, বঙ্গদেশে ক’জনের কবিতা পাঠকের বোধকে বোধির দিকে তাড়িত করে? এমন কবিতার সংখ্যা নেহায়েত কম। কেন কম? কারণ, কবিরা আজকাল শিল্পের তাড়নায় কবিতা লেখেন না। লেখেন কবিখ্যাতি পেতে। আর তাই তো দেখা যায়, প্রলাপের মতো শব্দের পর শব্দ লিখে অনেকেই কবি হয়ে উঠেছেন। অবশ্যি, এর পেছনে রয়েছ রাজনৈতিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার ইন্ধন। গণমাধ্যমের প্রভুত প্রচারণা। এসবের প্রভাব গিয়ে পড়েছে কবিতার পাঠকদের ওপর। ফলে তারা মেনেই নিয়েছে, উনি বিশিষ্ট কবি। না-হলে তাকে নিয়ে এত এত প্রচারণা কেন? আসলে কবি ও ক্ষমতা পিঠ চুলকে দিচ্ছে। ও এর পিঠ চুলকে দিচ্ছে। চুলকা-চুলকির এই দৌরাত্ম্যে পাঠকরুচিতে এখন দগদগে ঘা। কবিতা আর অকবিতার বিবেচনাবোধও পাঠকের এখন তলানিতে। নানা মাধ্যমের প্রচারণায় পাঠক এখন প্রভাবিত। কী রকম প্রভাবিত, তার পষ্ট একটা ছবি পাওয়া যাবে সক্রেটিসের জীবনের একটি ঘটনা থেকে।
প্রাচীন গ্রিসের অ্যাথেন্স শহর। সক্রেটিস বাগানে বসে তার শিষ্যদের সাথে কথা বলছেন। এক শিষ্য জিগেশ করলো, সত্য কিভাবে বুঝবো? সক্রেটিস জবাব না দিয়ে বললেন, বসো সবাই। আমি একটু আসছি। একটু পর তিনি ফিরে এলেন। হাতে একটা আপেল। শিষ্যদের দেখালেন। জিগেশ করলেন, এটা কি? সবাই বলল, আপেল। ফলটি হাতে সক্রেটিস শিষ্যদের চারপাশে একটু ঘুরে জিগেশ করলেন, তোমরা কি কোনো কিছুর গন্ধ পেলে? কেউ কোনো জবাব দিচ্ছে না। সবাই চুপ। দেখতে আপেল মনে হলেও গন্ধ তো তারা পায়নি। একজন দাঁড়িয়ে বলল, আপেলের গন্ধ পেয়েছি। বলেই শিষ্যটি সবার দিকে সমর্থনের আশায় তাকালো। কিন্তু কেউ তার সমর্থনে সাড়া দিল না। সবাই আগের মতোই নিশ্চুপ। সক্রেটিস আবারও আপেলটি নিয়ে ছাত্রদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে আপেলটি নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে জিগেশ করলেন, এবার কি তোমরা কোনো কিছুর গন্ধ পেলে? বেশিরভাগ শিষ্য হাত তুলে বলল, হুম, আমরা আপেলের গন্ধ পেয়েছি এবার। একটু চুপ থেকে সক্রেটিস এবার আপেলটি সবার নাকের কাছে ধরতে লাগলেন আর জানতে চাইলেন, এবার কেমন গন্ধ পেলে? সব শিষ্যই হাত তুলে বলল, আপেলের মিষ্টি গন্ধ। সবাই হাত তুলেই আছে। কিন্তু একজন শিষ্য হাত তোলেনি। বাকিরা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সক্রেটিসও তার দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। লজ্জা পেয়ে সেও আর থাকতে পারল না, হাত তুললো। বাকি শিষ্যেরা সমস্বরে হেসে উঠলো। হাসি শেষ হলে সক্রেটিস ওই শিষ্যকে জিগেশ করলেন, তুমিও কি আপেলের গন্ধ পেয়েছিলে? শিষ্য মাথা নেড়ে জবাব দিল, জি। সক্রেটিস ফলটি নেড়েচেড়ে বললেন, আপেলটি আসলে নকল। এর কোনোই গন্ধ নেই। তোমরা কেউই গন্ধ পাওনি। একজন পেয়েছে বলাতে বিভ্রান্ত হয়ে পরের বার বেশিরভাগই বললে আপেলের গন্ধ পেয়েছো। কিন্তু ঠিকই একজন তখনও নিশ্চিত ছিল, আপেলের গন্ধ সে পায়নি। শেষমেষ সেও আর সবার সিদ্ধান্তের কাছে নিজের সিদ্ধান্ত মিলিয়ে দিলো। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আপেলটি নকল। সত্য বিচারে এভাবেই মানুষ তার নিজের বিচারকে খুব কমই অনুসরণ করে। আরসব মানুষের মিথ্যে বিচারকেই প্রতিদিন বড় সত্য ভেবে অনুসরণ করে। আমাদের বর্তমান কবিতার পাঠকদের বিচারবোধ আসলে এরকমই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কবিতার পাঠক হয়ে উঠতে হলে পাঠকের প্রস্তুতির দরকার আছে। নিজের বিচারবোধ দিয়ে কবিতার শিল্পকে উপলব্ধির দরকার আছে। এই অর্থে আমাদের বেশিরভাগ কবিতার পাঠক আসলে পাঠক নয়, গুজবের অনুসারী।
নব্বইয়ের দশকের কবি সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতা নিয়ে কোথাও তেমন কথাটথা শোনা যায় না। কেন যায় না? তার কবিতায় ঘুরেফিরে ইলসামি নানা অনুষঙ্গ এসেছে বলে? কিংবা তিনি ক্ষমতার ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত নন বলে? সে যাই হোক, সেসব কার্যকারণ আমার কাছে প্রধান নয়। ব্যক্তি সাজ্জাদ বিপ্লবকে আমি চিনি না। কখনো তার সাথে আমার দেখাও হয়নি। কিন্তু চোখের সামনে পড়ে গেলে তার কবিতা আমি পড়েছি। পড়েছি কারণ, তার কবিতায় সারল্য আছে। বোধের জ্যামিতিক বিন্যাস সুশৃঙ্খলভাবে প্রকাশ পায় তার কবিতার শরীরে। ফলে, শব্দের পর শব্দের ইমারত নির্মিত হয়ে জটিল চক্রব্যূহ তৈরি করে না সাজ্জাদের কবিতা। ঠিক যে, সাজ্জাদের কবিতার অট্টালিকায় অসংখ্য প্রকোষ্ঠ থাকে। সেসব প্রকোষ্ঠে প্রবেশের জন্য থাকে ঘোরানো-প্যাঁচানো সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে খুব সহজেই যে কোনো প্রকোষ্ঠে পাঠক পৌঁছতে পারে। কোনো একটি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পাঠককে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয় না। বরং, সাজ্জাদের কবিতারূপ অট্টালিকার প্রকোষ্ঠগুলো পাঠকের খুব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বলে মনে হয়। কেননা, প্রতিদিনের পরিচিত আটপৌরে শব্দ দিয়েই সাজ্জাদ নির্মাণ করেন তার কবিতার অট্টালিকা। নব্বইয়ের দশকের কোনো কোনো কবির কবিতায় দেখা গেছে, নিরীক্ষার নামে কবিতায় খটোমটো শব্দের ব্যবহার। যেন খুঁজে খুঁজে শব্দ ধরে এনে বসিয়ে দিয়েছেন কবিতার শরীরে। এরই ফলে সেসব কবিতা পাঠের সময় শব্দের গূঢ়ার্থ উপলব্ধি করতে হয় চিবিয়ে-চিবিয়ে। যদিও অনেক তাত্ত্বিক বলে থাকেন, কবিতা যুক্তির ধার ধারে না। যা লেখা যায়, যেমনভাবেই লেখা যায়, তা-ই কবিতা। এই প্রচারণায় প্ররোচিত হয়ে অনেকেই কবিতা লিখেছেন, লিখছেন। নব্বই দশকেরও কোনো কোনো কবি লিখেছেন। কিন্তু আমি সহজভাবে বুঝি, কবিতা হয়ে উঠতে গেলে শেষমেষ কবিতাই হয়ে উঠতে হয়। পড়লেই যেন কবিতার আস্বাদ পাওয়া যায়। যে বাক্যবন্ধনি পাঠে কবিতার আস্বাদ পাওয়া যায় না সেই বাক্যবন্ধনিকে আমি কোনোভাবেই কবিতা বলে স্বীকার করবো না। যা মনে আসছে একটু গুছিয়ে তা লিখে দিলেই যদি কবিতা হতো, তাহলে সকলেই কবিতা লিখতে আরম্ভ করে দিত। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, কবিতাই একমাত্র শিল্প-মাধ্যম যা যুগ-যুগ ধরে মানুষ পাঠ করে আসছে। কোনো কবিতা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, আবার কোনো কবিতা হয় না। যেসব কবিতা বহুল পঠিত নয় সেসব কবিতা যে কবিতা নয়, তা কিন্তু নয়। তবে দেখা গেছে, বেশিরভাগ জনপ্রিয় কবিতা সহজ বোধের প্রকাশ কিংবা ছন্দের সৌন্দর্যে দীপ্তিমান।
আজকাল বেশ শোনা যায়, মানুষ এখন কবিতা পড়ে না। এর মানে, কবিতা মানুষকে কবিতার আস্বাদ দিতে পারছে না। বিরক্তি নিয়ে, খটোমটো শব্দের কেরদানি চিবিয়ে সময় নষ্ট করে মানুষ কবিতা কেন পড়বে? কিন্তু সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতা পড়তে গিয়ে কবিতার ভেতর বসানো শব্দগুলো উপলব্ধি করতে চিবোতে হয় না, কী এক জাদুর ঘোরে শব্দগুলো নিজেই দ্যোতনা প্রকাশ করে। নিজে নিজেই শব্দ যখন পাঠকের বোধের সামনে নিজেকে মেলে ধরে, পাঠক তখন সহজেই ওই শব্দের অর্থময়তা ও দৃশ্যকল্প তার অন্তর্গত বোধের রসায়নে জারিত করে তুলতে পারে। যে কোনো ভালো কবিতার প্রসাদগুণ এখানেই। নব্বইয়ের দশকের কবি কামরুজ্জামান কামু ও মাহবুব কবিরের কবিতা পড়তে যেমন আনন্দ আছে, সেই রকম না হলেও ভিন্ন মাত্রার আনন্দ আছে সাজ্জাদের কবিতা পাঠে। তবে তাদের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য সারল্য। প্রতিদিনের পরিচিত আটপৌরে শব্দের ব্যবহার। শব্দ কিন্তু কবিতার প্রধান শক্তি। শব্দের সারল্য না থাকলে কবিতা সৌন্দর্য হারায়। একটি অট্টালিকা যেমন ইট ও সিমেন্টের গাঁথুনি নিয়ে গড়ে ওঠে, একইভাবে কবিতাও শব্দ ও বোধের গাঁথুনি নিয়ে গড়ে ওঠে। এখানে আমি বলতে চাচ্ছি, শব্দ হচ্ছে ইট আর সিমেন্ট হচ্ছে কবির অন্তর্লীন বোধ। যে কোনো শব্দকে বোধের রসায়নে জারিত করেই কবিকে নির্মাণ করতে হয় কবিতার অট্টালিকা। এ প্রসঙ্গে মহাকবি কালিদাসকে স্মরণ করছি। সম্রাট বিক্রমাদিত্য সভাসদদের নিয়ে রাস্তায় হাঁটছেন। সঙ্গে বিদ্যাপতি ও কালিদাসও রয়েছেন। বলে রাখা ভালো, বিদ্যাপতি কালিদাসকে খুব হিংসে করতেন। গোপাল ভাঁড়ের পেছনে যেমন সবসময় মন্ত্র লেগে থাকতো, সেই রকম। যাই হোক, হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সম্রাটের চোখে পড়লো, রাস্তার পাশে শুকনো একটা গাছ পড়ে আছে। সম্রাট বিদ্যাপতিকে জিগেশ করলেন, ওহে বিদ্যাপতি, বলো তো ওই ওখানে ওটা কী পড়ে আছে? নিজের কবিত্ব জাহির করার সুযোগ পেয়ে বিদ্যাপতি বললেন, শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠতি অগ্রে। মানে, একটি শুকনো কাঠ সামনে পড়ে আছে। সম্রাট এবার একই প্রশ্ন কালিদাসকে জিগেশ করলেন। কালিদাস জবাব দিলেন, নীরস তরুবর পূরত ভাগে। মানে, একটি রসহীন (শুকনো) গাছ সামনে পড়ে আছে। সম্রাট সভাসদদের প্রত্যেককে জিগেশ করলেন, কার জবাব বেশি শ্রুতিমধুর। সকলেই কালিদাসের পক্ষে রায় দিলেন।
এই গল্প বলার উদ্দেশ্য, একই কথা নানাজনে নানা রকমভাবে বলতে পারে। কিন্তু কবি যখন বলেন তখন তা যেন কানে মধু ঢেলে দেয়। শব্দের জাদু এখানেই। কিন্তু দেখা গেছে, আমাদের বেশিরভাগ কবিদের কবিতায় বলার কথা খুব বেশি থাকে না। থাকে কেবল একটির সাথে আরেকটির সম্পর্করহিত কতগুলো শব্দগুচ্ছ। সেসব শব্দে কবির বোধের জগৎ তেমনভাবে প্রকাশিত হয় না। কেবল খটখট মটমট আওয়াজ আমাদের কানে বিরক্তি ধরিয়ে দেয়। কী পরিহাস, এরাই কবি হিসেবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের কবিতা পাড়ায়। কেউ কেউ বলতেই পারেন, এসব গদ্যছন্দ, তুমি বুঝবে না হে মাথামোটা। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথের ‘ক্যামেলিয়া’ কি গদ্যছন্দে নয়? তাহলে সেই কবিতা এখনো আমরা বারবার পড়ি কেন? কারণ আর কিছুই নয়, শব্দের জাদু। একইসঙ্গে বোধের রসায়ন।
সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতা পড়তে গেলে খুব বেশি আয়োজন লাগে না। খুব ভারিক্কি ভঙ্গি নিয়েও তার কবিতা পড়তে হয় না। মনেই হয় না যে, কবিতা পড়ছি। কিন্তু পড়া শেষ করার পর বোঝা যায়, এতক্ষণ কবিতা পড়ছিলাম। ‘ছুটে চলা’ কবিতায় সাজ্জাদ লিখছেন:
প্রভু দেখো, তোমার সংকেত আসার পূর্বেই
সবাই কেমন ছুটছে!
পবিত্র, সোজা, স্বচ্ছ এবং খোলা গ্রন্থে তোমার বর্ণিত কেয়ামত দিবসে যেমন ছুটে চলার কথা, তেমন
যেন ইস্রাফিলের শিঙায় ফুঁ দেয়ার আর তর সইছে না
আমার তো কোনো তাড়া নেই।
মানুষ ছুটছে। জীবিকার তাড়নায় নাভিশ্বাস তুলে মানুষ ছুটছে, সকাল থেকে সন্ধে অবধি। জীবিকার অন্বেষণে ছুটতে ছুটতে মানুষ আজ ভুলেই গেছে কেবল ছুটে চলার নামই জীবন নয়। জীবনে স্থিরতা জরুরি। জীবনে স্থিরতা এলে তবেই তৈরি হয় জীবনবোধ। কিন্তু মানুষ এখন স্থির নয়, ছুটছে। সাজ্জাদ বিপ্লবের কাছে এই ছুটে চলাকে মনে হচ্ছে, কেয়ামতের ময়দানে ছুটে চলা। কেয়ামত দিবসে মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকবে। সেই বর্ণনা আমরা পেয়েছি প্রভুর অবতীর্ণ কোরআন থেকে। এই কোরআন পবিত্র। কোরআনে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা সোজা, স্বচ্ছ এবং সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত। কোরআনে কোনো জটিলতা নেই। কোরআনের বিষয়বস্তু একেবারে পানির মতো টলটলে স্বচ্ছ। আমরা জানি, ফেরেস্তা ইস্রাফিল শিঙায় ফুঁ দিলেই শুরু হবে কিয়ামতের ধ্বংসযজ্ঞ। সাজ্জাদ বলছেন, মানুষ এমনভাবে ছুটছে যে, ইস্রাফিলের শিঙায় ফুঁ দেয়ার তর তাদের কারো আর সইছে না। পৃথিবী ধ্বংসের মুহূর্তে মানুষের ভীত-বিহ্বল ছুটে চলার সাথে সাজ্জাদ মেলাতে চেয়েছেন জীবিকার তাড়নায় ছুটে চলার দৃশ্যকে। পাঠক হিসেবে আমরা ধরে নিতেই পারি, কেয়ামতের আগেই মানুষ কেয়ামতের দিন যাপন করছে। এর কারণ কি? কারণ, ভোগবাদিতা। আরও চাই, আরও চাই, এই তীব্র আকাঙ্খা। জীবনের মহত্তম উপলব্ধি এখানে অনুপস্থিত। সাজ্জাদ বলছেন, তার কোনো তাড়া নেই। এক অর্থে তিনি মিথ্যে বলছেন। কারণ, পৃথিবীর বুকে জীবিকার তাড়নায় তাকেও ছুটতে হয়। কর্মস্থল থেকে আবার ছুটতে ছুটতে ফিরতে হয় ডেরায়। ফলে, কেয়ামতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তারও কমবেশি হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয়, তাড়া না-থাকার যে কথা তিনি কবিতায় বলছেন সেটা তার মানসিক অস্থিরতা না-থাকা অর্থে। জীবিকার তাড়নায় সকলকেই ছুটতে হচ্ছে। কিন্তু সকলেই যে যথেচ্ছ ভোগবাদী, তা কিন্তু নয়। কেউ অল্পে তুষ্ট, কারো পাহাড়সম সম্পদেও আকাঙ্খা তৃপ্ত হয় না। ‘ছুটে চলা’ কবিতার উল্লেখিত পঙক্তিগুলোতে দেখা যাচ্ছে, খুবই সহজ শব্দের বিন্যাসে যাপিতজীবনের চিরচেনা চিত্র। তবে একটি শব্দে চোখ ঠোকর খায়। সাজ্জাদ লিখছেন, তোমার সংকেত আসার পূর্বেই। এখানে পূর্বের বদলে আগে শব্দটি বসালে আরসব শব্দের সাথে বিন্যাস চমৎকার হতো। শব্দগুলোর স্বাভাবিক গতি থাকতো। কিন্তু পূর্বে শব্দের ব্যবহারে সেই গতি হোঁচট খায়।
সাজ্জাদ বিপ্লবের বেশিরভাগ কবিতার বৈশিষ্ট্য আসলে সহজ শব্দে জীবনযাপনের নানা ঘটনাকে ছবির মতো এঁকে দেয়া। সেই ছবি প্রত্যেক মানুষেরই নিজ নিজ জীবনের ছবি। ফলে, তার কবিতা বাঙালি পাঠকের গেরস্থালি কবিতা। গেরস্থালি কবিতা লিখতে গিয়ে আবিদ আজাদকে মনে পড়ছে। আবিদের কবিতা তো অসাধারণ। কী বিষয়ে, কী নির্মাণে, আর কী বোধের ব্যাপ্তিতে। আবিদের কবিতায় আছে মধ্যবিত্তের দীর্ঘশ্বাস, জীবনের পাওয়া না-পাওয়ার টুকরো টুকরো গেরস্থালি বোধ। এসব কবিতা পাঠে পাঠকের বুকের ভেতর কোথায় যেন জন্ম নেয় হাহাকার। তবে সেই হাহাকার শিল্পের রাংতায় মোড়ানো। সেই অর্থে সাজ্জাদের কবিতা হাহাকার তৈরি করে না। শিরশির কাঁপুনি ধরিয়ে দেয় না বুকের ভেতর। নাহ, ভুল বললাম। কাঁপুনি তো ধরিয়ে দেয়, তবে সেই কাঁপুনি আবিদ আজাদের কবিতা পাঠের মতো নয়। হয়তো এই কাঁপুনি সাজ্জাদের কবিতার মতোই। মানে আমি বলতে চাইছি, দুজনের কবিতার ফর্ম মোটামুটি পাশাপাশি রাখার মতো হলেও নির্মাণশৈলী ও বিষয়প্রকরণ আলাদা আলাদা। ‘এক সকালের গল্প’ কবিতাটি এই সুযোগে পড়ে ফেলা যাক:
দেখো, কী সুন্দর সকাল!
একটি সুন্দর সকাল মানেই
সকল সম্ভাবনার শুরু
ভালোবাসার বীজ বপন, স্বপ্নযাত্রা
কোথাও না কোথাও, কিছু না কিছু ছড়িয়ে পড়া
এই যে আমি যেমন ছড়িয়ে পড়ছি
সমগ্র বিশ্বে, ব্রহ্মাণ্ডে
ছুঁয়ে যাচ্ছি আটলান্টা, শিকাগো, নিউইয়র্ক…
আমার সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে আমার আশা, ভরসা ও ভালোবাসা…
সমগ্র বিশ্বজুড়ে
তুমি, আমি, আমরা একত্রে সকলে আছি বলেই
পৃথিবী এত সুন্দর! সকাল এত মনোরম। কষ্ট ও দুঃখগুলো এত হালকা…
প্রথমেই বলবো যে, একত্রে শব্দটি পড়ার সময় চোখ হোঁচট খায়। একসাথে লিখলে পড়ার গতি সাবলীল হতো। যাই হোক, সাজ্জাদের এই কবিতাতেও দেখা যাচ্ছে, গেরস্থজীবনের ফুরফুরে সুখানুভূতি আমাদের খুবই পরিচিত শব্দ দিয়ে বুনন করা হয়েছে। পাঠককে শব্দগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে মানে উদ্ধার করতে নামতে হচ্ছে না। যে যাই বলুক, আমি বলবো যে, যে কোনো ভালো কবিতার বিশেষ গুণ এটাই। জীবনঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা ও বোধের উপস্থিতি কবিতাকে পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। যেসব কবিতা চিবিয়ে চিবিয়ে বুঝতে হয় সেসব কবিতা পাঠক থেকে সূদূরে নির্বাসিত। এ ধরনের কোনো কোনো কবিতাও অবশ্যি পাঠকের গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে যদি তাতে থাকে শিল্পসৌন্দর্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নব্বইয়ের মেধাবী কবি মজনু শাহের কবিতা। মজনুর কবিতা কিন্তু পাঠকঘনিষ্ট নয়। শব্দের বিন্যাসও বেশ জটিল ও ঘোরানো। এরপরও তার কবিতা বহুল পঠিত। এখানে মনে রাখতে হবে, মজনুর পাঠক কিন্তু প্রভাবিত নয়। তার পাঠক নিজের মুখেই ঝাল খান। পাঠকঘনিষ্ট না হয়েও মজনুর কবিতার জনপ্রিয়তার কারণ, শিল্পের অদৃশ্য একটি জগৎকে মজনু নির্মাণ করেন যে জগৎ যাপিতজীবনের প্যারালাল।
সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতায় ইসলামি অনুষজ্ঞ নানাভাবেই এসেছে, কথা ঠিক। আবার এও ঠিক, অনেক বিচিত্র বিষয়ও উঠে এসেছে তার কবিতায়। প্রেম, যৌনতা, প্রকৃতি, স্বদেশসহ বিষয়বৈচিত্র্যে সাজ্জাদের কবিতা নব্বইয়ের আরসব কবিদের মতোই বিস্তৃত পরিসর দখল করে রেখেছে। তবে তার কবিতা নব্বইয়ের দশকের অনেক কবির কবিতার মতো দুর্বোধ্য নয়, সহজেই তার কবিতার ভেতর পাঠক ডুব দিয়ে কিছু সময় ঘুরে আসতে পারেন। যাপিতজীবনের গ্লানি প্রত্যেক মানুষই বহন করে চলেছে। কিন্তু তা প্রকাশের শৈল্পিক উপায় তাদের জানা নেই। কারণ, তারা কবি নয়। সকলেই কবি হতে পারেও না। সাজ্জাদ বিপ্লব যেহেতু কবি, সেহেতু সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে কবিতার ভেতর দিয়ে তিনি প্রকাশ করেন যাপিতজীবনের গ্লানিচিত্র। ‘বেঁচে আছি’ কবিতাটি পড়া যাক:
আমার কোনো অতীত নেই
বর্তমান আছে কিনা, তাও জানি না
আর ভবিষ্যৎ? ঠেলে দেওয়া দূর…
আমি তবে কোন কালের?
এ কালে কেউ কেউ হয়তো দেখে থাকতে পারেন সামান্য ঝলকানি। পেছনে ফেলে আসা কোনো ছায়া নেই। সামনে ছুটে চলা দুরন্ত গতি আমার সাথি। স্বজন। দু’পাশ দিয়ে শা’ শা’ করে করে কিম্বা ধীর গতিতে কেউ হেঁটে গেলে আমি টের পাই…
আমি জানি না, আমি কোন কালের
শুধু বেঁচে আছি বা ছিলাম, এটুকুই…
অতীত নেই। বর্তমান আছে কিনা, তাও অজানা। আবার, ভবিষ্যৎ বলতেও কোনো সময়ের উপস্থিতি সাজ্জাদের উপলব্ধিতে ধরা পড়ে না। নিজের ভেতর তাই প্রশ্ন ওঠে, তবে কি তার কোনো কাল নেই! এই প্রশ্ন কিংবা বলা যেতে পারে সংশয় আসলে সব মানুষেরই। যাপিতজীবনের মর্মযাতনার স্বগতোক্তি। দিনশেষে সকলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শোনায়, বেঁচে আছি, এই-ই তো যথেষ্ট! অতো ভাবাভাবির কী আছে! কবিতার শেষ শব্দটি ‘এটুকুই’ কী গাঢ় তাৎপর্যে উদ্ভাসিত হয় পাঠকের বোধের জগতে! পাঠকও ওই শব্দটির সাথে নিজের দীর্ঘশ্বাসকে মিলিয়ে দিয়ে যেন আরাম পান। আর নচিকেতার সেই গানের কথাগুলো বিড়বিড় করতে থাকেন, অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন/শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন।
সত্যি যে, জীবনের পথ কোথায় গিয়ে যে শেষ হয়েছে সেই সত্য আমরা কেউই ঠিকঠাক জানি না। কেবল আশার ছলনে বেঁচে থাকি। আর কবিদের কবিতা রচনার কাজটি তো আসলে আশার ছলনা থেকে কিছু সময়ের জন্য শৈল্পিক আশ্রয়। আর এ কারণেই যে কোনো কবির কবিতা বিষয়ে আলোচনা করতে যাওয়া এক ধরনের ছেলেমানুষি। অনেকটা সিন্ধুকে বিন্দুর মধ্যে ধারণ করার মতো পাগলামি। একজন কবি সারা জীবন কবিতা লিখছেন। তার ওই গোটা জীবনের প্রতিফলন তার কবিতা। সেই কবিতাকে ধরতে গেলে একশো-দুশো পৃষ্ঠার বইও পূর্ণাঙ্গ নয়। এরপরও কবিতার আলোচনার নামে লোকজন প্রবন্ধ লেখে। সেসব গণমাধ্যমে ছাপাও হয়। আলোচনা লেখার কাজটি যিনি করেন তিনি খুব মেধাবী না-হলে আলোচনা আসলে দাঁড়ায় না। আরও সমস্যা হচ্ছে, মাঝে মাঝে দু’চারটে পঙক্তি তুলে দিয়ে ওই পঙক্তিগুলোর ওপর কলম চালানো। এখানেও চাতুরি আছে। কবির সারা জীবনের কবিতার মধ্য থেকে মাত্র দু’চারটি পঙক্তি কোনোভাবেই ওই কবির প্রকৃত কবিসত্তাকে প্রকাশ করে না। এসব সীমাবদ্ধতা মাথায় নিয়েই সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতার ওপর খুবই ছোট্ট করে একটু আলো ফেললাম। এই আলোয় সাজ্জাদের সারা জীবনের কবিতার পরিসর খুবই অল্প জায়গা নিয়ে পাঠকের চোখে আলোকিত হয়েছে। সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতার মূলধারা, বৈশিষ্ট্য ও শিল্পোৎকর্ষতা যতটা সম্ভব তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি এখানে। জানি যে, পুরোপুরি সফল হইনি। অতৃপ্তি থেকেই যাচ্ছে। তবে তৃপ্তি এখানেই যে, আমার আলোচনা পড়ে হয়তো কবিতার প্রকৃত কোনো পাঠক সাজ্জাদের কবিতার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবেন। পাঠ করবেন তার কবিতাগুলোকে। আর আবিষ্কার করতে থাকবেন সারল্যের সৌন্দর্যে দীপ্তিমান সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতা।
A nice portrayal of Kobi bondhu Sajjad Biplob, I would like to thank the writer Abu Taher Sarfaraz for such an articulated views in writing.
ভালো লাগলো। সরফরাজকে দিয়ে আরো গদ্য লেখাও। তুলনামূলক কবিতা নিয়ে গদ্য।
আলোচনাটি খুবই ভালো হয়েছে, এই মানের কাব্যালোচনা আজকাল নেই বললেই চলে। পুরো লেখাটা এক নিঃশ্বাসে পড়লাম৷ শিখলামও অনেক কিছু। লেখককে ধন্যবাদ। কবি সাজ্জাদ বিপ্লবকে অভিনন্দন।
বাহ্! চমৎকার আলোচনা। বিপ্লব ভাইয়ের কবিতা আগেও পড়েছি, বরাবরই ভালো লাগে খুব সাবলিল বক্তব্য তাঁর কবিতায়। আলোচনায় আরো স্পষ্টভাবে তুলে এনেছেন আলোচক। ধন্যবাদ তাঁকে সেই সাথে বিপ্লব ভাইকে অভিনন্দন, কবিতা চলুক তার আপন গতিতে, শুভকামনা নিরন্তর।
আলোচনাটি বেশ ঝরঝরে।
কবি সাজ্জাদ বিপ্লবকে সহজেই
সনাক্ত করা যায়
এই স্বল্পায়তনের নিবন্ধটি পড়ে।
কবি ও আলোচককে অসংখ্য ধন্যবাদ।
্
খুব ভেতর থেকে একটি অনুসন্ধানী মন ও চোখ নিয়ে সাজ্জাদের কবিতার বিচার বিশ্লেষণ হলো। বিষয়টা কঠিন কিন্তু আবু তাহের সরফরাজ তার শক্তিশালী লেখনি দিয়ে বিষয়টি কত সহজ করে দিলেন। দুজনকেই জানাই অভিনন্দন।