spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েশূন্যতার কাঁটাতারে শুয়ে আছেন মাহবুব হাসান

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

শূন্যতার কাঁটাতারে শুয়ে আছেন মাহবুব হাসান

কাজী জহিরুল ইসলাম 

“শূন্যতার কাঁটাতারে শুয়ে আছি” মাহবুব হাসানের প্রকাশিত কবিতার বই। বের করেছে কোলকাতার আবিস্কার প্রকাশনী। বইটি নিয়ে লিখব লিখব করে কেটে গেছে অনেক দিন। এরই মধ্যে আমি গ্রন্থখানা বেশ কবার উল্টে-পাল্টে পড়ে ফেলেছি। লিখছিলাম না, এর পেছনে হয়ত খানিকটা দ্বিধা কাজ করছিল, কারণ বইটি কবি মাহবুব হাসান উৎসর্গ করেছেন যৌথভাবে আমাকে এবং আমার স্ত্রী মুক্তি জহিরকে। মাহবুব ভাই অবশ্য এসব দ্বিধার তোয়াক্কা করেন না। তোয়াক্কা না করার জন্য প্রচন্ড রকমের আত্মবিশ্বাসী হতে হয়। আমি নিশ্চিত নই আমার সেই পর্যায়ের আত্মবিশ্বাস আছে কিনা। 

শেষ পর্যন্ত যখন বসে গেছি, শূন্যতার কাঁটাতারে শুয়ে শুয়ে কবি মাহবুব হাসান কি করছেন তা পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করি। মানুষ যখন নিজেকে শূন্যে ভাসান, তখন তিনি হয় প্রচন্ড হতাশায় নিমজ্জিত অথবা ঘোরের ভেতরে ডুবে আছেন। কবি মাহবুব হাসানের মধ্যে দুটোই আছে। ঘোর এবং হতাশা। হতাশা থেকে উৎসারিত উচ্চারণ, “আমাদের কোনো নদী নেই, জল নেই, পানির পিপাসাও নেই?/ কেবল আছে নোংরা বুড়িগঙ্গা আর আবর্জনার শীতলক্ষ্যা আমাদের/ আর আছে নদীগ্রাস,/ হাঁসফাঁস করা বালুমহালের টেক্কা-রহিতন-হরতনের অবারিত খেলা!/ সারাবেলা! (আমাদের কোনো নদী নেই)”।  শুধু হতাশাই বা বলছি কেন? এটিই কী আজকের বাস্তব চিত্র নয়? এটিই হয়ত কাব্যসাংবাদিকতা? ভূমিদস্যুদের বালু দখল, জল দখলের মহড়া কী প্রতিনিয়ত আমরা দেখতে পাচ্ছি না বাংলাদেশের প্রধান শহর ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরগুলিতে? এই দৃশ্যই তুলে এনেছেন কবি। আবার ঘোরের উচ্চারণ শুনি অন্য জায়গায়, “কোনো শব্দ হয় না আমাদের সেই পদচারণায়,/ নিঃশব্দে ডাহুক-ডাহুকি হেঁটে যায় অনন্তের পথে! (স্বপ্নের ভেতর)”।  অনন্তের পথ থেকে তিনি তুলে আনেন এক অনিন্দ্য সুন্দরী রমণীকে। যার নাম ইয়ানা। ইয়ানার সাথে তার স্বপ্নের ভেতর বিয়ে হয়ে যায়। তিনি স্বর্গের সুখ লাভ করেন। স্বর্গের ঝর্ণাজলে অজু করে অপেক্ষা করেন ফজরের আজানের জন্য। এই চিত্রকল্প থেকে কবির চিন্তার জগতকে আমরা আবিস্কার করতে পারি। তিনি ধর্মভিরু একজন মানুষ। এই ভিন দেশের এক অনিন্দ্য সুন্দরীকে তিনি উপভোগ করেন বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতরে এবং খোদার কাছে শুকরিয়া জানাতে অপেক্ষা করেন আজানধ্বনির। আজানের ধ্বনি শোনার জন্য তিনি কান পেতে আছেন বটে কিন্তু তার ঠোঁট তখনো সেই রূপসীর উষ্ণ ঠোঁটে। আস্তিক্যবাদ কবিতাকে দূর্বল করে ফেলে যারা বলেন আমি তাদের সাথে একমত নই। কবিতার শরীরে এক স্বর্গীয় মায়া থাকা দরকার। কবিতা মানুষের হৃদয়ে স্বর্গীয় অনুভব তৈরী করে। বিশেষ করে কবির হৃদয়ে। আস্তিক্যবাদের মধ্যে থেকে কবি যদি সেই স্বর্গীয় অনুভব পেয়ে যান এবং তৈরী করেন কিছু সুন্দর পঙক্তি যা মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করে, ক্ষতি কি? যখন মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি ৮০০ বছর পরেও আমেরিকার বেস্ট সেলার কবি, তখন কি করে বলি আস্তিক্যবাদ কবিতাকে দূর্বল করে ফেলে। বরং ঈশ্বরের অপার রহস্য অনুসন্ধ্যান কবিতাকে অন্য এক গভীরতার কাছে নিয়ে যায় যা কবিতাকে করে তোলে চিরকালের। 

নামকরণের ক্ষেত্রেও কবি বেশ চমৎকারিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। যেমন গ্রন্থটির নামকরণে তেমনি এর বেশ কিছু কবিতার নামকরণেও। কয়েকটি কবিতার নাম এখানে উল্লেখ করি “রোদের মুখ”, “ঘুমকে আমার পাহারায় রেখে”, “সময় ফুঁড়তে ফুঁড়তে”, “বৃষ্টির আয়াত”, “এক স্বপ্নদ্রষ্টা পাখি”, “তুমি খেলছ চন্দনা যেমন খেলে আকাশ”, “পাখিদের কোনো বন্দুক নেই”, “মুহূর্ত ভেঙে” ইত্যাদি।

কবির ব্যক্তিগত আর্থিক-সামাজিক অবস্থান, রুচি-অভ্যাস জানা থাকলে তার কবিতা বাখ্যা করা কিছুটা সহজ হয়। মাহবুব হাসানের সাথে আমার নিবিড় সখ্য তার প্রতিটি কবিতার অর্থ আমার কাছে স্পষ্ট করে তোলে। বইটি পড়তে পড়তে আমি খুঁজে পাই প্রতিদিনের দেখা মাহবুব হাসানকে। একজন মানুষ তার জামার পকেটে আকাশ নিয়ে ছুটছেন ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টক্লেয়ার সিটি, পমোনো থেকে আড়াআড়ি তিন হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নিউ ইয়র্কের কুইন্সে। সেই আকাশে যেমন শূন্যতার কাঁটাতার আছে তেমনি আছে আদিগন্ত বিস্তৃত স্বপ্ন। এই স্বপ্ন এবং শূন্যতায় ঝুলে আছেন কবি মাহবুব হাসান গত চার/পাঁচ বছর ধরে। তিনি প্রতিদিন দেখেন স্বপ্নের ফুল অঙ্কুরিত হচ্ছে ম্যানহাটনে, জ্যামাইকায়, জ্যাক্সন হাইটসে। আবার এই শহরে রাত নামে, তুষারপাত হয়। স্বপ্নেরা অন্ধকারে ঢেকে যায়। তখন তিনি অন্য চোখ মেলেন। দেখেন, “ঝাপ্পুরি খেলছে কিশোর কিশোরি/ এক বহমান মেঘের জলে! সেখানে কোনো স্রোত নেই কিন্তু আকার তার স্রোতস্বিনীর।/ আমি এইসব দেখতে দেখতে তর্কের বারান্দায় গিয়ে উঠি,/ আর সঙ্গে সঙ্গে হাস্নাহেনা ফুলের বাশনা পাই, দেখি/ বিরিয়ানির ম ম ঘ্রাণ উঠে আসছে কোনো এক গহন রহস্য থেকে।/ আমার পেট ক্ষুধায় পাক দিয়ে ওঠে” (নিরাকার আঁধার ভেদ করে)”। 

ধর্ম সম্পর্কে মার্ক্স বলেছেন, অসহায় মানুষের ভরসা। অর্থাৎ যখন সে সব হারিয়ে ফেলে তখন ধর্মের কাছে আশ্রয় নেয়, এতে তার কষ্ট লাঘব হয়। কবি যখন স্বপ্ন হারিয়ে ফেলে তখন সে কার কাছে হাত পাতে? আমরা দেখি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর যখন কবিকে কিছুই দেয় না, দিনের শেষে হতাশায় নিমজ্জিত না হয়ে তিনি ফিরে যান তার ঝাপ্পুরি খেলার দিনগুলোতে। এই স্মৃতির জানালা তার অন্ধকার ঘরে আলো জ্বেলে দেয়, সেই আলোতে তিনি দেখতে পান বহুদূরের আনন্দময়  উজ্জ্বল কৈশোরদিন। এতে তিনি উজ্জিবিত হন এবং নতুন স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেন। তিনি বলেন, “আমি সবুজ ভালোবাসতে বাসতে আকার পেতে থাকি।/ আমি আরেকজন মানুষ হয়ে উঠি”। 

মাহবুব হাসান সত্তরের দশকের কবি, একজন মুক্তিযোদ্ধা, স্বভাবতই তার কবিতা উচ্চকিত হবার কথা, প্রতিবাদী হবার কথা। প্রতিবাদ তার কবিতায় আছে বটে কিন্তু এই গ্রন্থে তা এসেছে বেহাগের সুরের মতো, শ্লোগানের বা রাইফেলের গর্জনের মতো নয়। মাহবুব হাসানের মত পরিণত কবিদের দিকে তরুণ কবিরা তাকিয়ে থাকেন নতুন কোনো দিক নির্দেশনার জন্য। কেমন হওয়া উচিৎ আগামি দিনের কবিতা, এই ইঙ্গিত মাহবুব হাসানরা না দিলে কে দেবেন? এই গ্রন্থে আমরা তার কিছু ইঙ্গিত পেয়েছি কবিতার নামকরণে, কিছু  ইঙ্গিত পেয়েছি শব্দচয়নে অপ্রমিত এবং সাহিত্যে অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহারে। তিনি আমাদের এই ইঙ্গিত দিচ্ছেন, কোনো শব্দই কবিতার জন্য অনুপযুক্ত নয়, যদি কবি এর সঠিক প্রয়োগ করতে পারেন।

২০১৮

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা