নয়ন আহমেদ
তখন বাড়িতে বসে পড়ি। স্কুলে ভর্তি হইনি। আদর্শ লিপি পড়ি। আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। পড়তির দিকে। নদীর কাছে বাড়ি। জমিজমা ভেঙে যাচ্ছে। প্রতিদিন একটু সময় করে ভাঙন দেখি। আমি আর আমার ভাই। আমাদের মতো বাচ্চারা অনেকেই আসে।
খুব মজা করে। হৈচৈ করে। কাদা ছোড়াছুড়ি করে। ডাংগুলি খেলে। আমরাও ওদের সাথে খেলি। নদীর পার থেকে অনেকটা দূরে থাকি। গায়ে-গতরে কাদা মাখি। তারপর দুপুরের অনেক পরে বাড়ি যাই। নদীর তীরে, এখানে -সেখানে ঘোরাঘুরি করে কাটে আমাদের শৈশব।
টের পাই , হঠাৎ রোজার মাস শুরু হয়। শেষ রাতে আমরা ভাত খাই। মা-বাবা ডেকে উঠান। পুরো দিন রোজা রাখতে পারি না। মাস শেষে হয়তো ৫/৭ টা রোজা রাখতে পারি। প্রথম ও শেষের রোজাটা অবশ্যই রাখতাম। আমরা অপেক্ষা করতাম ঈদের দিনটার জন্য।
ইতোমধ্যে আমাদের নতুন জামা-কাপড় বানানো হয়েগেছে। আব্বা বললেন, জিনিস-পত্রের দাম হুহু করে বাড়ছে।একটা জামা,৫ টাকা দামের একটা লুঙ্গি। আমার ভাইয়েরও একই দামের কাপড় আর জামা। থাকতো একজোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল। ২টাকা দাম।
চাঁদ দেখতে বাড়ির পাশে খোলা মাঠে যেতাম। বাড়ির কাছে বাজার। বড়ো রাস্তা। অল্প একটু হাঁটতে হত। সন্ধ্যায় ঈদের বাজার করতে আব্বার সাথে হেঁটে যেতাম। সেমাই কেনা হতো। গুড়,চিনি কেনা হতো। আব্বা জিলাপি কিনে দিতেন। দোকানে বসে খাওয়াতেন। বাড়ির জন্যও নিয়ে আসতেন। কসকো সাবান কিনলেন দেড় টাকা দিয়ে। সুন্দর ঘ্রাণ। পোলাউর চাল জমিতে হয়। কেনার দরকার নেই।
মা রাত পোহানোর আগেই উঠতেন। শিরনি রাঁধতে বসে যেতেন। মাকে সাহায্য করার কেউ ছিলো না।
আমরা দাদিকে দেখিনি। বড় হয়ে জেনেছি, আব্বা যখন ১৭/১৮ বছরের, তখন দাদি মারা যান।
মা একা সব কাজ করতেন। দাদার কাছে বসে সেই শিরনি খেতাম। আমার অন্য ভাই দাদার কাছে বিরক্তির ছিলো।
সে দাদাকে গালিগালাজ করতো। খেপাতো। বেশি দুষ্টু ছিলো সে।
ঈদে আরেকটা খাবার সবাই খেতাম আমরা। এটাকে বলে মলিদা। এ জন্য চাল ভিজিয়ে রাখতে হতো।
খুব সকালে সেই চাল পাটা-পুতায় বেটে মিহিন করা হতো।
আদা দিতে হতো। পানির সাথে চিনি বা গুড় মেশাতে হতো। তারপর গ্লাসে করে পরিবেশন করতে হতো।
এটাকে খুব উপাদেয় মনে হয় এখনও।
ঈদের নামাজে সুন্দর সুন্দর কথা বলতেন ইমাম সাহেব। উপদেশ দিতেন।এদিন সাধ্যমতো দান করতেন অনেকে। আমরা ছোটোরা নামাজের মধ্যেও দুষ্টুমি করতাম। আমাদের বয়সী ছেলেদের চিমটি দিতাম। হাসাহাসি করতাম।
নামাজ শেষে বাজারের দিকে যেতাম।
দেখতাম গরুর গোশত ভাগ দিয়ে বেচা হচ্ছে। একভাগ ৪ টাকা। কেউ কেউ নগদ অর্থে কিনছে। কেউ আবার বাকিতে। এককাঠি ধানের বিনিময়ে ( ৩২ সের= এককাঠি)।
দুপুরে মা ভালো খাবারের আয়োজন করতেন। একজন ফুপু আসতেন বেড়াতে। মা মুরগি রান্না করতেন। মায়ের পোষা মুরগি।
বিকেলে ঘোড়দৌড় হতো। আমাদের মাঠ থেকে দূরে। পাশের গ্রামে। কাউকে না জানিয়ে গিয়েছি।। দাদার হাতে ধরা খেয়েছি সেসময়। অনেক খুঁজে খুঁজে হয়রান তিনি। আমার কান ধরে টানলেন। গালি দিলেন। ” হারামি, একটা আস্তা শয়তান।তোর মায়েরে কইয়া আওনাই ক্যা?
হে দেহি খুইজ্জা মরে।”
হিশেবে করে দেখেছি, এ ঈদের স্মৃতি ১৯৭৬ সালের।
কবি নয়ন আহমেদের লেখা মানেই বিশেষ স্বাদ, ধন্যবাদ দুই কবিকে; লেখক ও সম্পাদক
অসাধারণ স্মৃতিচারণ
ধন্যবাদ কবি নয়ন আহমেদ, অসাধারণ গল্পের জন্য শৈশবের স্মৃতি শুধু কল্পনায় বাসা বাঁধে মনে, সেই দিন কি আর ফিরে পাব কখনও?চোখে জল এসে যায় শুধু সেই স্মৃতিতে।