রফি হক
.
আমার জীবনে প্রথম যে বড়ো কবিকে চাক্ষুস দেখি তিনি–আসাদ চৌধুরী। সেটা ছিল ১৯৮০ সাল। আমি তখন কুষ্টিয়ার কোর্টপাড়ার “কুষ্টিয়া কোর্ট” রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন রাজু আহমেদ স্মৃতি সংসদের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে কুষ্টিয়া স্থানীয় প্রতিশ্রতিশীল কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীত শিল্পী, নাট্যকার, সংস্কৃতিজনদের আড্ডা বসতো প্রতি সন্ধ্যায়। প্রাণবন্ত আড্ডায় মাঝে মধ্যেই অতিথি হয়ে আসতেন কেউ কেউ। তেমনি এক সন্ধ্যায় কবি আসাদ চৌধুরী এসেছিলেন। তিনি তখনই ভীষণ জনপ্রিয় কবি, আবৃত্তিকার এবং উপস্থাপক। টেলিভিশনে “প্রচ্ছদ” নামে একটি অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করতেন। অনুষ্ঠানটি তাঁর উপস্থাপনার গুণে অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল–বিশেষ করে আমাদের মতো কবিযশ প্রত্যাশী নবীন তরুণদের কাছে অনুষ্ঠানটি ছিল অসামান্য। আসাদ চৌধুরীর কণ্ঠের জাদুতে আমরা মুগ্ধ হতাম, আচ্ছন্ন হতাম।
.
আমাদের আড্ডার মাঝখানে “পড়ুক” “পড়ুক” বলে পনেরো কুড়ি জন একসঙ্গে স্মৃতি সংসদ থেকে বেরিয়ে পড়তাম। কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশনের প্রান্তের রেল লাইন পার হয়ে হাতের বামে রেজিস্টার জেনারেলের অফিসের বিশাল পুকুরের কিনারা ঘেঁষে সারি সারি হোটেলের যে-কোনো একটিতে গিয়ে বসতাম। সেখানে শুরু হতো আমাদের আড্ডার সেকেন্ড স্পেল ! সমস্বরে “পড়ুক” “পড়ুক” ধ্বনির অর্থ হলো, “সময় হয়েছে, চা খেতে চলো”। যেমন কেউ এক টাকা, কেউ দুই টাকা, কেউবা পাঁচ টাকাও টেবিলে প্রদান করত, চার আনা, আট আনাও পড়ত টেবিলে। তখনো আমাদের নিত্যকার জীবনে থেকে চার আনা, আট আনার দিন শেষ হয়নি। হোটেলে চায়ের টেবিলের ওপর যা পড়তো সকলের পকেট থেকে সেটাই হলো “পড়ুক” “পড়ুক” খেলা। হ্যাঁ, অনেকটা খেলার মতো। টেবিলের সংগৃহীত অর্থ দিয়ে আমরা নিমকী, সিঙ্গারা, লেড়ুয়া বিস্কুট আর বুন্দিয়া খেতাম। তবে বুন্দিয়া, সিঙ্গারা আমাদের জন্য বিলাসিতা ছিল। সেটা কালে-ভদ্রে খেতাম। বেশিরভাগ দিন দুধ-চায়ের সঙ্গে নিমকী অথবা লেড়ুয়া বিস্কুটেই খুশি থাকতাম। তখনও লাল চা খাওয়ার যুগ আসেনি। হয়ত আমরা আড্ডায় পনেরো জন আছি, চা নেয়া হতো দশ কাপ। দশ কাপকে পনেরো কাপ বানানো হতো। মানে, টেন ইজ-টু ফিফটিন। আড্ডা শেষে আমাদের জামার গায়ে, চাদরে, মাফলারে লেগে থাকত লেড়ুয়া বিস্কুটের গুঁড়া।
.
সেদিন আড্ডা শেষে আমরা আবার স্মৃতি সংসদে ফিরে আসছি থার্ড স্পেলের আড্ডার জন্যে, রেল-লাইন পার হয়ে স্টেশনের যে প্রান্তে কাঠগোলাপের গাছটি ছিল গাছটির নিচেই আমরা পেলাম কবি আসাদ চৌধুরীকে। কবির কাঁধে ক্যাম্বিসের ব্যাগ, মুখে পান। লালিম ভাই তাঁকে নিয়ে এলেন স্মৃতি সংসদে। লালিম ভাইয়ের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক তাঁর। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি তাঁদের কথোপকথন।…. তখন বা তার আগেই বেরিয়েছে তাঁর “তবক দেয়া পান” কাব্য গ্রন্থটি। তিনি পান খেতে খেতে “তবক দেয়া পান” কাব্য গ্রন্থটির কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। এবং সবার শেষে তিনি আবৃত্তি করলেন বিখ্যাত “কোথায় পালালো সত্য” কবিতাটি। ঘর ভর্তি মানুষ মুগ্ধ হয়ে শুনছি তাঁর জাদুকরী ভরাট কণ্ঠে–
.
“…কোথায় পালালো সত্য?
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো
….. গুড়ের কলসি, বিষের কৌটো,
চিনির বয়াম, বাজারের ব্যাগ,
সিগারেট কেস, পানের ডিব্বা,
জর্দার শিশি, লক্ষ্মীর সরা,
নকশী পাতিল, চৌকির তলা,
সবি খুঁজলাম, খুঁজে দেখলাম নেই তো”! …
.
তাঁর মৃত্যুর বছরখানেক আগে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে কবি আমিনুর রহমান ভাইয়ের একটি কবিতা পাঠ অনুষ্ঠানে কবির সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল। সেখানে কবির স্ত্রী ছিলেন, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক কবি নূরুল হুদা ছিলেন, ভূটান-নেপাল থেকে আগত কবিরা এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত কবিরাও ছিলেন। কবিকে সেদিন হাসি-খুশি দেখাচ্ছিল ভীষণ। কথা বললাম কাছে গিয়ে। আমি আমার দুটি কবিতা আবৃত্তিও করেছিলাম। একটি কবিতায় জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছিলাম ১৯৮২ সালে। সে পুরস্কার বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত– পুরস্কারের নাম : “একুশে সাহিত্য পুরস্কার”। বাংলাদেশের সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এ প্রতিযোগিতাটি ছিল। বেশ ‘একুশে পদক’-ভাবের নাম ! হা হা । “অমর একুশে”র অনুভব নিয়ে কবিতাটি লিখেছিলাম । জাতীয় পর্যায়ে বিচারকমন্ডলীতে ছিলেন : আবু রুশদ্, সৈয়দ শামসুল হক, মহাদেব সাহ ও আসাদ চৌধুরী। সেদিন আমি চল্লিশ বছর পর সেই কবিতাটি পাঠ করেছিলাম, এবং কবি আসাদ চৌধুরীকে আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম।….এখানে উল্লেখ করা ভালো যে, “একুশে সাহিত্য পুরস্কার” গল্পে সেরা পুরস্কার পেয়েছিল টাঙ্গাইলের মোফাজ্জল হোসেন নীলু, নীলু এখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। নাটকে টাঙ্গাইলের মেহেদী ইকবাল। মেহেদী সম্প্রতি সাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে অবসর নিয়েছে। কবির ছবিটি পেয়ে ভালোই হলো, তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে কিছু লিখতে পারলাম। কুষ্টিয়াতে ১৯৮০ সালে তাঁর সঙ্গে একটি গ্রুপ ছবি তুলেছিলাম।
সেটি পেলে ভালো হতো খুব !
.
শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৩
২৩ অগ্রহায়ণ ২০২৩
রফি হক শিল্পী, ছাপচিত্রী, শিল্পলেখক, সম্পাদক। ভিজিটিং আর্টিস্ট এণ্ড লেকচারার, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো।
…….
[কবি আসাদ চৌধুরীর এই ছবিটি আমি হঠাৎই পেলাম আমার একটি ফাইল থেকে। সেখানে লেখা আছে ছবিটি তোলার দিন ক্ষণ : ৩১ জানুয়ারি ২০১৫, জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে। সম্ভবত সেখানে বিশেষ একটি বইমেলা চলছিল। সে উপলক্ষেই দেখা হয়েছিল কবির সঙ্গে।
সবটাই স্মৃতি থেকে লিখেছি। স্মৃতি প্রতারণা করেনি বলেই মনে করি। যদি করে ভুল সংশোধনে এগিয়ে আসবেন নিঃসংকোচে।]