১. আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোন টি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?
প্রথম একটি গল্পের বই বের করি, “যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে“। এটি বেরিয়েছিল ১৯৯৪ সালে। সেই বছরই রহিমা আখতার কল্পনা এবং আরো কয়েকজনের সঙ্গে একটি যৌথ কবিতার বই ” জলের মিছিল” বের হয়। আমার অংশটির নাম ছিল “রাধিকা“। পূর্ণাঙ্গ কবিতার বই ” পুরুষ পৃথিবী” বের হয় ১৯৯৮ সালে। প্রথম বই প্রকাশের অনেক বিড়ম্বনা ছিল, যন্ত্রণা ছিল, কষ্ট ছিল এবং যারপর নাই আনন্দও ছিল।
২. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
আমার পূর্ববর্তী সকল গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি লেখকেরই উত্তরাধিকার বহন করি। বড়ু চণ্ডীদাস, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীম উদদীন, জীবনানন্দ দাশ, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, কাকে বাদ দিব আমি? আমার মধ্যে সকলেই আছেন, তবে তারা আমার শেকড়, সেই শেকড়সমূহে ভর দিয়ে যে কাণ্ড দাঁড়িয়ে আছে, যাকে পাঠক দেখছেন, তিনি কাজী জহিরুল ইসলাম, এক স্বতন্ত্র কবি।
৩. এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন–কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
মোট প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৯০ টির কিছু বেশি। এর মধ্যে কবিতার বই ৪০টি। কবিতার প্রতিই আমার পক্ষপাত বেশি, তবে আমার ভ্রমণ রচনা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে সেগুলোকেও আমি গুরুত্বপূর্ণই মনে করি। গদ্যের বইগুলোর মধ্যে ৭ ভাষাশহিদকে নিয়ে লেখা ৭টি গল্পের সংকলন “উত্থানপর্বের গল্প” উল্লেখযোগ্য একটি বই। এই গ্রন্থে ৭ ভাষাশহিদের জীবন এবং ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর ইতিহাস উঠে এসেছে। কবিতার বইগুলোর মধ্যে “ক্রিয়াপদহীন কবিতা” বাংলা কবিতার ভূবনে এক নতুন সংযোজন বলে আমি এটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। এ-ছাড়া শুধু স্বরবৃত্ত ছন্দের ১০০ কবিতার সংকলন “শেষ বিকেলের গান” এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত ১০০ কবিতার সংকলন “ভোরের হাওয়া” কবিতাপ্রেমীদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত। বিষয়বস্তুর দিক থেকে “ওঁ থেকে উচ্চারিত” একটি উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ। প্রবন্ধ বা মুক্তগদ্যের বইগুলোর মধ্যে “নন্দনতত্ত্বের ডার্করুম” এর একটি ভিন্ন আবেদন আছে। এই গ্রন্থে আমি বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের অন্ধকার দিকটি উন্মোচন করার চেষ্টা করেছি। “নির্বাচিত ১০০ কবিতা” নামে একটি সংকলন বেরিয়েছে কয়েক বছর আগে। এই গ্রন্থটির প্রতিও পাঠকের বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
৪. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
এ-সপ্তাহেই বেরিয়েছে “ভোরের হাওয়া“। এই গ্রন্থে শুদ্ধ মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত ১০০ টি কবিতা আছে। মাত্রাবৃত্তের সকল পর্বের কবিতাই আছে এখানে। ৪ এবং ৮ মাত্রার বিরল কবিতাও আছে বেশ অনেকগুলো। এ-ছাড়া ২৬ পৃষ্ঠার একটি ভূমিকা-প্রবন্ধ লিখেছি যেখানে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেছি। আশা করছি তরুণ লেখকদের এটা খুব কাজে লাগবে।
৫. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি–লেখক বলেন? কেন?
আশির দশকে আমার লেখা ঢাকার দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হতে শুরু করে। সেই হিসেবে আমি আশির দশকের কবি। তবে দশক শুধু কবির উত্থানের সময়কাল নিরুপনের একটি উপায়মাত্র, আর কিছু নয়। আমি মনে করি আমি সর্বকালের কবি, আমার পঙক্তিগুলো যদি মহাকালের ক্যানভাসে কোনো দাগ তুলতে ব্যর্থ হয় তাহলে আমার কবিজীবন ব্যর্থ। কোনো দশকের কবি হিসেবে আমি চিহ্নিত হতে চাই না।
৬. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।
আমার সমকাল বড়ো বেশি অস্থির। এর একটি কারণ সোশ্যাল মিডিয়া। সম্পাদকহীন প্রকাশের সুযোগ। সকল মানদণ্ড ভেঙে পড়েছে। মানদণ্ড ভেঙে পড়ার বড়ো কারণ হচ্ছে অনৈতিক রাজনীতি। এই অনৈতিকতা সমাজের সর্বক্ষেত্রের মতো সাহিত্যেও ছড়িয়ে পড়েছে, যা মিডিওকারদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। ফলে প্রকৃত লেখক/কবি যারা আছেন, যারা নৈতিকতার চর্চা করেন, অকপটে সত্য বলেন তারা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে বাংলা সাহিত্যে আবার একটি অন্ধকার যুগ আসবে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি/সম্মাননা বিবেচনা করতে হবে মেধার ভিত্তিতে, বড়ো কাগজগুলোকে ভালো লেখার পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে, ভালো এবং সত্যভাষী সমালোচকগোষ্ঠী তৈরি করতে হবে, সত্য সমালোচনার প্রশংসা করতে শিখতে হবে, তা নিজের বিরুদ্ধে গেলেও।
৭. সাম্প্রতিক কালে কারা ভালো লিখছে বলে মনে করেন?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই না।
৮. কত দিন আপনার প্রবাস জীবন? কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
উত্তরঃ ২০০০ সাল থেকে দেশের বাইরে। এখন নিউইয়র্কে আছি। জাতিসংঘ সদর দফতরে কাজ করছি, আয়কর বিভাগের প্রধান হিসেবে। আব্বা কাজী মঙ্গল মিয়া এবং আম্মা সোফিয়া মঙ্গল ঢাকায় বসবাস করেন। আমি ছাড়া আমার আরো দুই ভাই, দুই বোন আছেন, তারা সবাই আমার ছোটো, সবাই ঢাকায় থাকেন। সকলেই বিবাহিত এবং তাদের নিজেদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে সকলেরই সুখের সংসার। আমার স্ত্রী মুক্তি জহির জাতিসংঘ সদর দফতরের হিউম্যান রিসোর্সেস স্পেশ্যালিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। পুত্র কাজী আবরার জহির একটি মার্কিন কোম্পানির সিইও, কন্যা কাজী সারাফ জল একজন অটিস্টিক শিশু।
৯. প্রবাস জীবনে সাহিত্যচর্চায় প্রতিবন্ধকতা বা সুবিধা কি–কি? কোথায়?
বাংলা বইপত্র হাতের কাছে নেই, এটি একটি বড়ো প্রতিবন্ধকতা তবে এখন অনলাইনে অনেক কিছুই পাওয়া যায় বলে এটা অনেক কমে এসেছে। আর একটি প্রতিবন্ধকতা হলো, দূরে আছি বলে দেশের মিডিয়া/সাহিত্যের মোড়লেরা আমাদের দূরেই সরিয়ে রাখে।
১০. আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
“কাজীর কাগজ” নামের একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছি। তবে এটির অকালমৃত্যু হয়েছে। “চিত্রকল্প” নামের আরো ছোটো কাগজের আমি উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। এটির সম্পাদক আতাহার খান।
১১. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
লিটল ম্যাগ হচ্ছে অনিয়মিত সাহিত্যের ম্যাগাজিন যেখানে যা খুশি তাই লেখা যায়। মূলত প্রথাবিরোধী, প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখা, যেগুলো বড়ো কাগজগুলো ছাপে না সেগুলো লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করে। এই কারণেই লিটল ম্যাগাজিন থেকে নতুন ধারণা উঠে আসে। সাহিত্যের দিগন্ত প্রসারিত করার ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিনই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব, অক্টোবর ০১, ২০২৩