পাভেল কুবলয়
……
এই বিশাল দুনিয়া বড়ই আজব যায়গা! কত কিছু ঘটে যাচ্ছে, অজান্তে। কত কে, কত কী যে সৃষ্টি করে যাচ্ছে! তার কয়টি’র খোঁজ রাখি আমরা? বিশেষ করে, আমি? কত আর সম্ভব?
ইন্টারনেট দুনিয়া তো আরো বেশী আজব ও অদ্ভুত। তবু, আমার কাছে বেশ মজার। আমি এর পজিটিভ দিক-ই বেশী দেখি। খুঁজি। পেয়েও যাই হঠাৎ-হঠাৎ অনেক কিছু।
এতো অদ্ভুত ভালো কবিতা লিখছে, কবি পাভেল কুবলয়!
জানা ছিলো না!! আগে কেন দেখিনি তার কবিতা? এটি কি তার ছদ্ম নাম? হতে পারে। নাও পারে। তাতে কিছু আসে, যায় না।
ভালো কিছু, বিশেষত ভালো কবিতা (আমার দৃষ্টিতে) পেলে আমি আবেগী হয়ে যাই। আর সেই আবেগ ও ভালোলাগা, কবিতার প্রতি ভালোবাসা, ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করি, চাই, অন্যদের মাঝে।
এক নতুন স্বর ও সুরের কবি পাভেল কুবলয়-এর বাংলা কবিতা :
……
তোমার মদে খরগোশ চুবিয়ে খাই, বিকেল ভাজ
হয়ে সন্ধ্যার টেবিলঘড়ি মাপে। পাশের রুমের
দম্পতির কামশব্দে আরেকটি চিত্র অংকনে ব্যস্ত
হয়ে পড়ি, জানালার কাঁচে ঘাসপোড়া ধোঁয়ার
রশ্মি। তুমি শরীর থেকে নামিয়ে রাখো ব্রা প্যান্টি
আর অভিযোগের ঘাম, সুগন্ধি বেরিয়ে পড়ে
মাদকরসের গরম স্যুপে। নিশ্বাসে শীৎকার
ভাসিয়ে দাও আমি তা এঁকে নিই, এঁকে নিই দেহের
ঝাঁকুনি–কোমরে পিয়ানোর সুর–আর খরগোশ
খাওয়ার অভিজাত তবলাবাজনা, আর জরায়ুর
কম্পন ।
সব এঁকে নিই প্রাচীন এই মগ্নতার দেয়ালে। পরখ
করে দেখি তৃপ্তির সরোদ কীভাবে কামরঙ হয়ে
উঠে। গ্যালাতিয়া, শৈল্পিক সঙ্গম আমরাই
শিখিয়েছি প্রাণীরাজ্যে।
শৈল্পিক সঙ্গম
১৯।১১।২০১৬
২.
যতবার তুমি গির্জা থেকে বেরিয়েছ, গির্জা খালি
করে আঁচলে ঘুমিয়ে পড়েছে সমস্ত উন্মাদ
বন্দেগানে।
গঙ্গা থেকে ভেজা কোমরে উঠে আসার সময়,
স্নানার্থী সকল হিন্দু ধার্মিক গেঁথে গিয়েছে শাড়ির
জলে।
ফজরের আযানের ভেতর তুমি ছড়িয়ে পড়ো বাসি
ঘরে,পৃথিবীর স্বামীরা তোমার মিলাদে মগ্ন হয়।
ঘুমে লাশ হওয়া নির্বোধের কাঁধেচাপা প্রচণ্ড ঈগল
আমি। বেহেস্তি বাতাস হয়ে তুমি আসো
গ্যালাতিয়া, আমার পাখনায় ভর করো, প্রেমেন্দ্র,
মৈথুনে।
১৯।১১।২০১৬
প্রচণ্ড ঈগল।
৩.
কেমন এক বারুদঘর মনে হয় তোমায় গ্যালাতিয়া
তপ্ত প্লানেট প্লেটের মত লাগে গ্যালাতিয়া
নিজেকে মোমের মত লাগে তোমার আগুনে গ্যালাতিয়া
বকের চঞ্চুতে আমি লেজ নাড়ানো পুটি-
হিংস্র ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে পড়ি–
ধ্বসে পড়া পাহাড়ী গাছে পাখির ছানা–
প্রচণ্ড ঝড়ে মুষড়ে যাওয়া বাদামধারী নৌকার জেলে–
রাস্তার বালি হয়ে উড়ে যাই তোমার দীর্ঘ ফুঁ’তে
তোমাকে ক্ষিপ্র চিল মনে হয়, আমি হাঁসের বাচ্চা
তোমাকে ধারালো কুঠার মনে হয়,আমি চন্দন গাছ
তোমাকে ছুরিকাঁচি মনে হয়, আমি ওটি’তে শোয়া রোগী
কেমন এক যুদ্ধবিমান মনে হয় তোমায় গ্যালাতিয়া
সেনাঅভ্যুত্থানের প্রধান মনে হয় তোমায় গ্যালাতিয়া
আমার আত্মহত্যার বিষ মনে হয় তোমায় গ্যালাতিয়া
তোমাকে এসবের কিছুতেই মানায় না গ্যালাতিয়া
তুমি আমার প্রতিকৃতি হয়েই থাকো গ্যালাতিয়া
আত্মহত্যার বিষ
১৯।১১।২০১৬
…..
অভিনন্দন, হে কবিতা পরিব্রাজক। বাংলা কবিতার নতুন পাদ্রী।
……
সাজ্জাদ বিপ্লব
…….
এ সময়ের কবিদের মধ্যে যেহেতু আমি ( সাজ্জাদ বিপ্লব) নিজেও একজন লিখছি, সেহেতু আমার কবিতাও এ আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বলে মনে হয়।
নিজের কবিতা নিয়ে নিজে বলাটা একদিকে মনে হচ্ছে দুরূহ এবং বিপদজনক। আবার আরেকদিক দিয়ে ভাবি, বেঠিক বা অন্যায় নয়। কারণ, কবি’র নিজের কবিতা কবি নিজে যতটা বুঝবে বা ব্যাখ্যা করতে পারবে, অন্যে তা পারবে বলে বা পারে বলে আমার মনে হয় না।
আমার উপলব্ধির কথা বললাম। অনুমানের কথা বললাম। এটি ঠিক-কি না, সে তর্কে আপাতত যাবো না।
কেউ খেয়াল করেছেন, কি-না, জানি না, আমার সাম্প্রতিক কবিতায় একটি সচেতন মাত্রা যুক্ত হয়েছে অর্থাৎ সচেতনভাবে আমি একটি মাত্রা যুক্ত করার চেষ্টা করছি। ছন্দে ফেরার চেষ্টা। আমি দেখলাম, অক্ষরবৃত্তে ধীরে-ধীরে আমি স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পাচ্ছি। লেখার চেষ্টা করছি।
এর জন্য সর্বতোভাবে আমি ঋণী কবি ও ছান্দসিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিশেষ করে, তার, কবিতার ক্লাস, গ্রন্থটি’র কাছে আমার অপরিশোধ্য ঋণ। এটি আমার, এ পর্যন্ত, ছন্দ শেখার একমাত্র পাঠ। প্রাথমিক প্রচেষ্টা।
এরপর যার উৎসাহ ও উপদেশ আমাকে চির ঋণী করে রাখলো, যে ঋণ, আমি ইচ্ছে করলেও আর কোন দিন শোধ করার সুযোগ পাবো না, তিনি, আমার সাম্প্রতিক গুরু, সদ্য লোকান্তরিত কবি শহীদ কাদরী।
অমর কবি শহীদ কাদরী’র কণ্ঠ আমার কানে এখনো বাজে। তিনি ছন্দে কবিতা লেখার প্রেরণা দিতেন। বলতেন, কবিদের বিভিন্ন ছন্দে লিখে প্রমাণ করতে হয় যে, আমি ছন্দে লিখতে পারি বা ছন্দ জানি।
এ ছাড়া ছন্দবদ্ধ কবিতা মানুষের মনে থাকে এবং পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে যায়। অর্থাৎ ছন্দে লেখা কবিতা দীর্ঘস্থায়ী হয়।
সেই থেকে আমি সচেতনভাবে, ছন্দ শেখা এবং ছন্দ বুঝে কবিতা লেখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
ইদানীং আমার কবিতায় আমি, কাউকে উপলক্ষ করে যেন আমার জীবনের কথা, সুখ-দু:খের কথা বলি। অনেকটা আত্মকথন যেন। প্রতিনিয়ত। কিন্তু, এবং শেষত, নিজের সাথে। এর মধ্য দিয়েই আমি গড়ে যাচ্ছি, এগিয়ে নিচ্ছি, আমার কবিতা।
আমার গুরু কবি আল মাহমুদ প্রায় দুই দশক আগে ( ১১.০১.১৯৯৭) আমার প্রথম কবিতার বই “পৃথিবী তোমার নয়” এর পাণ্ডুলিপি পড়ে যে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, তার খানিকটা তুলে দিলে মন্দ হয় না। পুরো লেখাটি শোভা পাচ্ছে আমার বইতে।
কবি আল মাহমুদ বলেন : “সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতার পাণ্ডুলিপিটি তাৎক্ষণিক দৃষ্টিপাতে যতটুকু পড়েছি এবং কবির সাথে আলোচনায় যতটুকু বুঝেছি এরাই সমকালীন বাংলাদেশের আশার প্রদীপ। সাজ্জাদের লেখার মধ্যে এতটুকু তীর্যকতা আছে যা চিত্রকল্প তৈরী করে এবং পাঠককে অনাবিল পুলক দান করে। এ যুগের কবিদের কবিত্ব শক্তি কবিতা পাঠের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা তাদের রচনায় পরিদৃশ্যমান হচ্ছে এটা এক নতুন বৈশিষ্ট্য। কবি সাজ্জাদ বিপ্লবের মধ্যেও এ জিনিসটা আছে। প্রেমই এ যুগের কবিদের প্রধান বিষয়। সাজ্জাদ মূলত প্রেমের কবি হলেও তার মধ্যে বিবেক এবং বিশ্বাস যুগপৎ মিলেমিশে আছে। শেষ পর্যন্ত এ ধরনের কবিরাই সার্থকতায় পৌঁছয়।”
সাজ্জাদ বিপ্লব এর সাম্প্রতিক কবিতা:
বিরহগাঁথা
আমার এখন নিরোগ, ফুটফুটে থাকার কথা
হাসিখুশি ও আনন্দেও থাকার কথা
সকালে উঠেই তোমার মিষ্টি মুখ দেখার কথা
সানন্দে তোমাকে ও বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দেয়ার কথা
চিনি ছাড়া ঘন দুধে চা পান করতে-করতে
লিখে ফেলার কথা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম প্রেমের কবিতা
অথচ আমি লিখছি বিরহগাঁথা
আমার দু:খ কথা
১১.০১.১৬
আটলান্টা, জর্জিয়া
খোঁজ
দেখো, আমি কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছি!
রেখে যাচ্ছি যত চাওয়া-পাওয়া, আবদার
আমার সুখ, আহ্লাদ, প্রশান্তি, সান্ত্বনা
আমার অধিকার, আদায়, স্বচ্ছলতা, স্বাচ্ছন্দ্য
আমার মুখ, মুখোশ, প্রচ্ছদপট
জীবনের পাণ্ডুলিপি, প্রুফ, কাটাকাটি
প্রেসের কালি, গুগুল প্লাস, ফেসবুক, বন্ধুবান্ধব, আড্ডা
আমার উঠে আসা, বিকাশ, কবিতা, প্রেম, লিটলম্যাগাজিন
ছোট-ছোট ঘটনা। বড়-বড় প্রশান্তি।
ছুটির দিন। ছুটে চলা। স্মৃতি-বিস্মৃতি। বিভেদ
বিচ্ছেদ।
গতি। দুর্গতি। ছায়া। মায়া। আলো-আঁধারী।
সর্বোপরি আমার জীবন ও যৌবন।
প্রকৃতি ও প্রেমের কাছে। মনের কাছে।
একজন প্রকৃত হৃদয় মানুষীর খোঁজে
আমার এই অনন্ত যাত্রা…
১১.২৬.১৬
আটলান্টা, জর্জিয়া।
শাস্তি
দেখো, আমি পেরিয়ে যাচ্ছি, মৃত্যু গহ্বর
তোমার বানানো খানাখন্দ, খাদ, ফাঁদ, ফাঁস
আমার গলায় জয়মাল্য, তুমি ঠেকাবে কী করে?
সত্য ও সুন্দরের দীর্ঘ মিছিল
আমাকে অনুসরণ করে এগিয়েও যাচ্ছে
মাঝেমধ্যে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, আমাকে
আমার খ্যাতি, প্রতিপত্তি, সুনাম আমাকে উপহাস করছে
হিংসে করছে তোমার বক্রতা, তোমার ক্রুরতা, হীনবুদ্ধি
বৃদ্ধি পাচ্ছে চক্রবৃদ্ধি হারে
হার মানাচ্ছে, জিউশদের বর্বরতা
মহামতি হিটলার, এমনকি মাহামান্য ট্রাম্প মহাশয়
তোমার হিংস্রতার সামনে, পৈশাচিকতার কাছে
সামান্য শিশু মাত্র
আমি না জেনেই এতোটা বছর তোমার
এই পচা দুর্গন্ধযুক্ত লাশ নিজ দায়িত্বে ঘাড়ে বহন করেছি
এখন আমার প্রাপ্য কি-কি শাস্তি দেবে দাও!
১১.২৫.১৬
আটলান্টা, জর্জিয়া।
….
ওমর শামস
…..
বাংলাদেশের প্রথম সারির যে ক’জন কবি প্রবাসী, তাদের মধ্যে, সদ্য লোকান্তরিত কবি শহীদ কাদরী বাদে সর্বাগ্রে যার নাম উচ্চারণ করা যায়, তিনি : কবি ওমর শামস।
তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ বসবাস করছেন, মার্কিন মুল্লুকে। কিন্তু দেশের এবং দেশের কবিতার নাড়ীর সঙ্গে তার সংযোগ তিনি কখনো বিচ্ছিন্ন করেননি। এটি তার প্রকাশিত গ্রন্থাবলী ও কার্যক্রম পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়।
প্রবাস যাপনের কারণে, তিনি কবিতা বা সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন না থাকলেও, আমার মতো নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই ছিলেন, প্রায় আচ্ছাদিত। হতে পারে এটি তার গ্রন্থের অসহজলভ্যতা অথবা আমাদের অনুসন্ধানের উণতা।
যাই হোক। তিনি বিজ্ঞানের মানুষ। অন্যান্য অনেক বিষয় ও অনুষঙ্গের পাশাপাশি তার কবিতায় বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ এসেছে স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বাভাবিকভাবে। সাবলীল ভাবে। তার সমগ্র কবিতা পাঠে কেউ-কেউ তাকে কবি মাসুদ খান এর পূর্বসূরি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন। কিন্তু দুই প্রজন্মের এই দুই কবি’র কবিতা, তবু, দু’রকমের সুন্দর। এবং আলাদা। দু’জনেই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রবাস জীবন মানুষকে মূল ধারা থেকে অনেকটা আড়ালে রাখে, একথা, একদা সঠিকভাবে খাটলেও, এ মূহুর্তে তা বলা যাচ্ছে না, মূলত প্রযুক্তির কারণে ও কল্যাণে।
এই প্রযুক্তি তথা ফেসবুকের সুবাদেই কবি ওমর শামস এর সঙ্গে আমার পরিচয় ও যোগাযোগ। তার কবিতা ও অন্যান্য গদ্য লেখা গুলিও আমার মতো পাঠকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, প্রযুক্তি আছে এবং তিনি সদা সচল ও সৃষ্টিশীল আছেন বলেই।
এবার আসুন, পড়ে দেখি তার কিছু সাম্প্রতিক কবিতা।
কবি ওমর শামস এর কবিতা :
দুঃখ সূত্র
উৎসর্গ : আহমেদ শিপলু
মানুষের দুঃখ আছে, বিষাদ আছে।
বাঘের হিংস্রতা আছে। ষাঁড়ের রাগ আছে।
এমন কি ছাগলেরও জেদ আছে।
মাছের ডিম পাতে নিয়ে ভাবি মাছেদের কোন বিষাদ নেই, দুঃখও নেই।
মাছের পাশে পুইঁশাক। সে শুয়েই থাকে, তার চোখ নেই, কান নেই।
বৃক্ষের দুঃখ আছে ? কতোটুকু ?
পাতাঝরা শুনেছি। ডালের উপর বরফকুচির শীত ছুঁয়েছি।
হাওয়ার কি দুঃখ আছে ? যদিও ঝড়, সাঁই-সাঁই, মৃদু-মন্দ বুঝেছি।
ঘাসের কি দুঃখ আছে? সে তো ইট-চাপা দিলেও গজায়।
পাথরের ? পাথরের কি দুঃখ আছে ?
পাথরকে ভাঙতে ভাঙতে বালি।
বালিকে ভাঙতে ভাঙতে পরমাণু, অণু।
অণুর কি দুঃখ আছে।
আমি একটি পাঁচ বছরের বালিকার দুঃখ জানলাম।
জানতে চাই, আমি জানতে চাই – দুঃখের সূত্র কি ?
দুঃখের গ্রহণ কি ? চন্দ্র কি ?
আদি বিস্ফোরণের কোথায়, কোথায় কোন স্তরে দুঃখ ছিলো ?
১০/২৫/২০১৬
২.
আমি কিছুই বলবো না আজ
আমি কিছুই বলবো না আজ !
ভুসুকু কাকে বিয়ে ক’রে বংগালি হয়েছিলো,
চৌষট্টি পাখুড়িতে কে কবে কতো নেচেছিলো,
ওগ্গর ভত্তা
রম্ভও পত্তা
গাইকো ঘিত্তা
দুগ্ধ সজুত্তা
কে কারা খেয়েছিলো –
বলবো না, বলবো না,
আমি কিছুই বলবো না আজ !
রামপালের দিঘীর প্রশান্ত নিথরতা
সতেরো অশ্বারোহীর নগর-প্রবেশ
আম-বাগানের নিস্তব্ধ কামান
আর ভেজা বারুদের কথা কি
তোমরা জানো না ?
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তধারী রায়-চৌধুরীদের
গম্গমে উঠোন – ক্রমে কালো শ্যাওলাপড়া
বিবর্ণ ইঁটে রূপান্তর,
বগি-বগি বাক্স, সিঁদুর, টুপি, ট্রেনভরতি মুখি-বেমুখি
মানুষ, ট-ঠ-ণ বর্ণগুলির বিবর্ণীকরণ এবং
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম! – তোমরা তো জানো।
আমি কিছুই বলবো না আজ !
আমার যে সংগ্রাম বাঁচবার সংগ্রাম! – তোমরা তা জানো না।
শুনেছো, “গই ভবিত্তি কিল্ কা হমারি ?”
আমার ভিখারি স্বামী অহর্নিশ বিষ খায়,
কি উপায় হবে আমার?
………
০৮/৩০/২০১৬
৩.
[ আরেকটু পরিশ্রমে সনেট বানানো গেল। এবং কবিতার ব্যঞ্জনা অন্য মাত্রা নিলো। ভালো লাগছে। এটাকে বৌদ্ধ কবিতা বলতে পারি ]
মৃগতৃষ্ণা
জানিস কি তুই হরিণ-রে এই তৃণের মাঝে বিষ
ঘাসের ভিতর ফুটে আছে সফেদ রঙের শীষ
ত্বকের বরণ দ্যায় কি চেনা বীজের গড়ন রূপ
পরমাণুর মধ্যে যে তার মরণ অহর্নিশ ।
ভুসুকু, তাই বলছি তোরে ছেড়ে যা-রে বন
সাগর ঢেউয়ে নদীর ভাটায় পলিত মাটির ক্ষণ
সেই চরে যা এখনো যা পায় নি পায়ের ছাপ
শিং অদেখা তড়িৎ গতির এম্নিতে ত্বরণ ।
তরুণ মুখের সুখের মতোন নব্য-গড়া চর
অসুখ যে হায়! জ’ন্মে আছে মৃত্তিকা ভিতর
আসক্তি ও তৃষ্ণা যে তোর ডিএনএ-তেই গাঁথা
হাড়ের মাঝে গুমরে ওঠে হা-হা-কা মর্মর।
হায়রে মানুষ তুই রে হরিণ দেখিস নে তোর ফোটা
তাই তো জগত অনন্তকাল মৃগের পিছেই ছোটা।
১১/০২/২০১৬
…..
তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :
১. বোধিবৃক্ষতলে (১৯৮৪)
২. খোয়াবনামা (১৯৮৬)
৩. সত্তুরের মিছিল (১৯৮৯)
৪. রিলকের আসা যাওয়া (১৯৯২)
৫. কবি-প্রতিকৃতি ও অন্যান্য কবিতা ((১৯৯৮)
৬. বাবরের পদ্ম অশোকের চাকা (২০১০)
৭. ইন্টারনেট গায়ত্রী (২০১০)
৮. অনন্তর পান্না (২০১১) ইত্যাদি।
…..
ফরহাদ মজহার
…..
কাজী নজরুল ইসলাম কেন আমাদের জাতীয় কবি?
এ প্রশ্নের উত্তর, আমার কাছে সোজা কথায় এরকম যে, তার কবিতায় আমরা বাংলাদেশের প্রাণস্পন্দন খুঁজে পাই। আমাদের জীবনের সুখ-দুখের গভীর উচ্চারণ মিলেমিশে আছে, তার কবিতায়।
এরপর যদি আলোচনার খাতিরে আমাকে বেছে নিতে বলা হয় অন্য কারো নাম, যার কবিতা একালের খাঁটি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে ; আমি নির্দ্বিধায় গ্রহণ করবো : আল মাহমুদ।
হ্যাঁ। আমি একবাক্যে দ্বিধাহীন চিত্তে সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব তুলে দিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারি, কেবলমাত্র আল মাহমুদ-এ।
তারপর যদি সাম্প্রতিক বাংলাদেশে প্রধান ও প্রতিনিধিত্বশীল কবি’র নাম উচ্চারণ করতে বলা হয়, যার কবিতা, কেবলমাত্র তার কবিতাই, নিঃশঙ্কচিত্তে সঠিক বাংলাদেশকে উপস্থাপন করছে, বাংলাদেশের হয়ে কথা বলছে, তিনি হলেন, কবি ফরহাদ মজহার।
অন্যেরা যখন মেকী কবিতা লেখায় ব্যস্ত, তখন তিনি লিখে চলেন, সদরুদ্দীন, তথা বাংলাদেশের-ই ভাগ্যলিপি। নিশুতি রাতে এহতেকাফে বসে মোরাকাবায় মত্ত হন, প্রিয়তমা মাহবুবা’র আদলে, প্রেয়সী বাংলাদাশের। এবং ধীরে-ধীরে পৌঁছে যান করুণাময়ের পরম প্রেমের সান্নিধ্যে।
….
প্রাণ ভরে পড়ুন, ফরহাদ মজহার এর কবিতা :
….
সদরুদ্দীন
…..
ছোট হয়ে আসছে বাংলাদেশ। এই শেষ উপত্যকা, এরপর গহীন গভীর গহ্বর। লাফ দাও, সদরুদ্দিন, গুম হয়ে যাবার পর লুকিয়ে রাখা লাশগুলোর পাহাড় ডিঙ্গিয়ে যাবার সময় এখন। স্থান পরিবর্তন করতে হবে তোমাকে। যেন বিজয়ীর বেশে আবার ফিরতে পারো। এখানেই। মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব খুব বেশী নয়। যুদ্ধ সবে শুরু হোল ।
মানচিত্র ফেলে দাও, তোমাকে আমি ব্রহ্মাণ্ড দান করেছি। সীমানা গুলো মুছে ফেলো, ইহকাল কি পরকাল পুরা পৃথিবীটাই তোমার, সে জন্যই তোমাকে আমি জান্নাতবাসী শহিদের সাদা পোষাক পরিয়েছি।
চলো ইহকালে আমরা পরকাল বুনতে শিখি। নিহত সৈনিকেরা উঠে দাঁড়াবে এখন। কুচকাওয়াজের শব্দে মাটির পৃথিবী কেঁপে উঠবে। তাদের তকবিরে সাড়া দিয়ে নতুন বোনা প্রতিটি শস্য দানার মধ্যে মাথা তুলবে অবিনাশী অংকুর।
যে ভূখণ্ড তুমি জয় করেও হারিয়ে ফেলেছ, সেই মানচিত্র তোমার নয়। আমার পাশে এসে দাঁড়াও, তোমার বাদশাহী মানুষের হৃদয়ের মধ্যে যেখানে কাঁটাতারের বেড়া নাই। ফেলানির ঝুলন্ত শরীর তুলে নিয়ে গিয়েছেন ফেরেশতারা। আজ তার শুভবিবাহ।
ছোট হয়ে আসছে বাংলাদেশ। আষাঢ়ের মেঘ গর্জন করতে করতে ছূটে আসছে ভূমিতে। কোথাও বুঝি বাজ পড়ল, সদরুদ্দিন, বিদ্যুতে ঝলসে উঠছে আকাশ। এসো আমরা আগুন আর বারুদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ি। দেখো, কতো দ্রুত লাল আর হলুদ ফুলে যুদ্ধক্ষেত্রগুলো ঢাকা পড়ছে। কোন আত্মত্যাগই বৃথা যায় না । অতীতের স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়েই ফুলগুলো পাপড়ি মেলে ধরেছে। আজ প্রজাপতিদের জনসভায় তুমিই প্রধান অতিথি।
ছোট হয়ে আসছে বাংলাদেশ। এই শেষ উপত্যকা। চলো, সব দ্বন্দ্বের অবসানের জন্য ইহকালেই আমরা পরকাল বুনতে শিখি।
যেখানেই যাই, ফিরতে হবে এখানেই।
২.
এহতেকাফ
আমি তোমার শরীর স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম, অথচ আমি কাদা ছুঁয়ে ফেলেছি। আর জল আর কাদার মধ্যেই আমি অস্থিমাংস সমেত নিজেকে বুনে দিলাম। এখন যে পদ্মফুল ফুটল তার লিঙ্গ নির্ধারণ করতে পারে এমন বিজ্ঞানমনস্কতা মানুষ আজও অর্জন করে নি। প্রেমের মৌসুম আবার এসে গিয়েছে মেহবুবা। চলো আমরা আবার সরোবরে ভেসে উঠি।
লিঙ্গবানদের সভ্যতা আবাবীল পাখি পাথর ছুঁড়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। যারা কামুক — বিপরীত কিম্বা সমকামী – তারা তাদের নশ্বর শরীর নিয়ে গত হয়েছে বহু আগে। এমন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক নাই যে তাদের ধ্বংসাবশেষ ফের আবিষ্কার করতে পারে। এই তো সময়, চলো আমরা জলের তলদেশ স্পর্শ করি।
অতঃপর তোমার হিজাব নামাও, মেহবুবা, পর্দার যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। বেহেশতে নহবত বাজছে বিবাহের; ফিরে এসেছে আলিঙ্গনের দিন। যাদের একই শরীরে বিলীন হবার কথা তাদের সালাতের সময় ঘোষণা করছে মোয়াজ্জিন। নিদ্রার চেয়ে ভালবাসাই উত্তম। সৃষ্টির রহস্য কার কাছেই বা এখন আর অজানা? আমাদের প্রেমের মধ্যে জন্ম এবং মৃত্যুর ভেদ লুপ্ত হয়ে যাক।
অপূর্ব এহতেকাফের রাত! হজরত রাবেয়া বসরির আশেকানির আলো একদা হারামজাদা চাঁদ চুরি করে পালিয়েছিল। আজ জ্যোৎস্না তাঁর মলমলের ওড়না হয়ে কাঁপছে। আমি চাঁদকে চুরির দায় থেকে সর্বান্তকরণে ক্ষমা করে দিলাম। শাস্তি এতোটুকুই যে তাকে সারা রাত জেগে থাকতে হবে। তাছাড়া কে আমাদের এখন এই মিলনের মূহূর্তে পাহারা দেবে?
মেঘের ফাঁক থেকে কৌতুক, আগ্রহ ও বিস্ময় নিয়ে উঁকি দিচ্ছে সাড়ে ষোল কোটি নক্ষত্র। অতো দূর থেকেও তাদের আলো শিশুর মুখের মতো উজ্জ্বল। দুধের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। এই সেই নক্ষত্র যারা যুগে যুগে পৃথিবীতে মায়ের কোলে বসে চাঁদ দেখতে চাওয়া প্রতিটি শিশুর আনন্দিত মুখের সাক্ষী। প্রত্যেকের হাসি তাদের মনে আছে। তাদের মুখও শিশুদের মতো হয়ে গিয়েছে। মিট মিট করছে স্মৃতির ভারে।
ভয় নাই আমি তোমাকে আড়াল করে রেখেছি। আমাদের সন্তানেরা এখন জানে কিভাবে কোথায় কোন প্রবেশ পথে তারা এই দুনিয়ায় এসেছে। কোথাও কোন রহস্য আর অবশিষ্ট নাই। যিনি নিত্য আছেন তিনি নিজেকে প্রকাশ করে দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, তাঁকে ব্যাখ্যা করবার জন্য দ্বিতীয় কারো তাফসির আমাদের কিনতে হবে না। দোকানিদের বাজার আমরা ভেঙ্গে দিয়েছি।
মিথ্যা ব্যাখ্যার ভারে আল্লার কালাম আর চাপা পড়তে দিও না। চলো আমরা মানুষের রচিত তাফসিরগুলো পুড়িয়ে ফেলি, যেন অলৌকিকের ভাষা আমরা আবার বুঝতে পারি। নামের জিকিরের মধ্যে নিজেদের আমরা বিলীন করে দিয়েছি। খামাখা ছাপাখানার অভিধান আর অর্থের বোঝা বহন করে আমাদের আর কী লাভ!
যেদিকে তাকাই সেইদিকেই প্রেম, স্নেহ আর বাৎসল্যের বৃষ্টি। পৃথিবী ভিজে যাচ্ছে। আমাদের অনন্ত আলিঙ্গনের মধ্যে মানুষের উদয় ঘটছে আবার। সত্যিকারের ইতিহাস বুঝি শুরু হোল! এই সেই অনন্ত শৈশবকাল যখন মায়ের স্তনের গন্ধ চিরকালই মানুষের ঠোঁটে লেগে থাকবে।
অপূর্ব এহতেকাফের রজনী! ! তোমার হিজাব উড়ছে রাতের হাওয়ায়, মেঘ হয়ে ফিরে যাচ্ছে তাঁর কাছেই যিনি পর্দানশীনদের জন্য নিজেই জ্যোৎস্না সেলাই করে পাঠান । অথচ যিনি নিজেই এখন নেকাব তুলে নিচ্ছেন, তাহলে কার কাছ থেকে তুমি নিজেকে আড়াল করছো মেহবুবা?
আহ্। কী মধুর আমার এবাদতের মুহূর্ত! নিত্য আর অনিত্য, হৃদয় আর শরীর, অবস্তু আর বস্তুর মাঝখানের সকল পর্দা খসে যাচ্ছে। খসে যাচ্ছে রহস্য। মসজিদের বাইরে যারা আজও রয়ে গেল তারা কোনভাবেই আর আমাদের দেখতে পারবে না। আফসোস, তারা দৃষ্টির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
এসো, এই তো সুযোগ, আমরা আদম আর হাওয়ার মতো নগ্ন হয়ে যাই।
৩.
পহেলা জুলাই ২০১৬
সব সত্য আমাদের জানা, সব সত্য আমাদের করতলে, সব সত্য আমাদের মুখস্থ — আছে সেই সকল বেয়াকুব যাদের ঠোঁটে সদাই সত্যের আইসক্রিম লেগে থাকে যা তারা লম্বা জিহ্বা দিয়ে চেটে খায়।
সেই প্রকার মূর্খ আর অজ্ঞদের কর্কশ হল্লা আর বাজখাঁই চিৎকারের মধ্য দিয়ে সত্যের লাশ নিয়ে শহর ত্যাগ করছে কর্তব্যপরায়ন মুর্দাফরাস । ঘরে ঘরে টেলিভিশান বাক্সে খবর পড়ছে বাকরুদ্ধ সাংবাদিক। যে মেয়েটি নিত্য নিত্য সন্ধ্যার খবরে মিথ্যা সংবাদ পড়ে তার চোখে কখনই পলক পড়ে না। আশ্চর্য সেও আজ সংবাদকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে।
আদিগন্ত বিস্তৃত মিথ্যাবাদীদের রজনী। কী ঘটছে কিছুই বোঝার উপায় নাই। তথাপি নীল ফ্লুরিসেন্ট আমোদে ঘর ভরে যাচ্ছে তাজা খবরে। খবরের গায়ে কর্পূর আর লোবানের গন্ধ। মেঘে ভেজা আষাড়স্য দিবসে আমাদের ঘর মৌ মৌ করতে থাকে ।
আজ শহরে সকলেই গুলশান বেড়াতে গিয়েছিল। তারা ইফতার করেছে স্পানিশ রেঁস্তোরায়। ফিরে এসে সবাই দল বেঁধে লাশ গুনতে বসে পড়েছে। ঈদ তো এসেই গিয়েছে!
পত্রিকার শিরোনামগুলো পড়ছি। চলো লাশগুলোকে কোরবানির মাংসের টুকরার মতো ভাগ করি আমরা। এই হোল জঙ্গী, ঐ হোল বিদেশী, ওরা বাঙালি। মুচকি মুচকি হাসে শয়তানের শ্যালক।
কে কাকে বোঝাবে লাশের ভাগাভাগীতে কী লাভ? পাপীতাপী সকলেরই রাস্তা শেষ হয় গোরস্থানে। আফসোস, জীবিত বা মৃত, মাটির গর্ত ছাড়া কোন মানুষেরই আর দ্বিতীয় কোন গন্তব্য নাই।
বলতে পারো তুমি এখন যে আমার সন্তান মাদ্রাসায় পড়ে, স্কলাস্টিকাতে না, ঘোষণা করতে পারো আমার সন্তান মাদ্রাসায় পড়ে, নর্থ সাউথে পড়ে না। মাদ্রাসা মাদ্রাসা মাদ্রাসা, আমরা কওমি মাদ্রাসার তালেবে এলেম। তোমরাই তো আমাদের হত্যা করেছিলে। তাই না? আমরা আমাদের লাশগুলো বহন করে ফিরে গিয়েছিলাম গ্রামে। যেন তাদের আমরা শহিদের মর্যাদায় কবর দিতে পারি।
হায়! পরস্পরের ভাষা বোঝে এমন কেউই আজ আর জীবিত নাই। সাঁজোয়া যানে সেনাবাহিনীর অপারেশান থান্ডার বোল্ট শেষ হোল। সফল অভিযানে সকলেই নিহত। তবু আমাদের আঙুলগুলো এখনও স্পর্শকাতর। আমাদের চোখ দেখছে সবই, কানে শুনছে যা কিছু শোনার, কিন্তু এই সেই সময় যখন ইন্দ্রিয়োপলব্ধির অনুবাদে আমরা ব্যর্থ। নিজেদের প্রকাশ করবার বিদ্যা আমরা ভুলে গিয়েছি। কেউ আর কারো ভাষা বোঝে না।
হে আমার একাকী ও নিঃসঙ্গ দিনপঞ্জি, আমি তাই সব কয়টি রক্তাক্ত লাশ আমার দুই কাঁধে তুলে নিয়েছি। আমরা যদি কাঁদি যেন সবার জন্যই কাঁদতে পারি। রোজ হাশর অবধি হাঁটতে হবে আমাকে।
কারন আমরা তাঁর জন্যই এবং একমাত্রই তাঁর কাছেই আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যাবর্তন করি।
…..
তার সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ : “তুমি ছাড়া কোন শালারে কেয়ার করি?”
কাউরে কেয়ার করেন না বলেই, আপনি ফরহাদ মজহার। আমাদের আদরের কবি।
.…..
শেষ কথার আগের কথা
…….
কবিতাবিষয়ক আলোচনা প্রায় শেষ পর্যায়ে। আপাতত। আসলে, এ ধরনের আলোচনা কখনো সমাপ্তিতে পৌঁছে না। পরিতৃপ্তিতেও নয়। কেননা, পরিসমাপ্তি বা পরিতৃপ্ততা মানে থেমে যাওয়া। এক ধরনের মৃত্যু। কেবলমাত্র জীবনাবসানেই যার যতি হতে পারে।
কারণ, যতদিন বেঁচে আছি বা থাকবো কিম্বা শিল্প-সাহিত্য ভালো লাগবে, কবিতা ভালো লাগবে, কবিতা লিখবো, কবিতা পড়বো। ততোদিন ভালো কবিতা খুঁজে যাবো, পড়ে যাবো।
সম্ভব ও সুযোগ হলে, নিজের খেয়ে বনের পাখিদের এইসব স্বরলিপি চেষ্টা করবো মনের পাখিদের দরবারে পৌঁছে দিতে।
এটি আশাবাদ ও প্রত্যয়।
আমি মূলত আরামপ্রিয়। পরিশ্রমসাধ্য লেখার চেয়ে আরাম করে অন্যের লেখা পড়তেই আমার বেশী ভালোলাগে। কিন্তু সেই আমিই প্রায় দেড় মাস ধরে একটু-একটু করে, পথ চলতে-চলতে, ট্রেনের কামরায় কর্মক্ষেত্রে যেতে-যেতে বা কাজ থেকে ফেরার পথে কিম্বা কখনো -কখনো কোন এক স্টেশনে বসে, নিভৃতে নীরবে আপনমনে সংক্ষেপে লিখে গেছি এইসব আলোচনা পর্ব।
আসলে, এ সব লেখাকে আলোচনা না বলে, কবি ও কবিতা পরিচিতি বা ভূমিকাও বলা যেতে পারে। তাতেও অসুবিধা নাই।
মাঝে-মাঝে ব্যক্তিগত প্রচণ্ড সমস্যা, ক্লান্তি, অবসাদ ও এক ঘেয়েমিতেও আক্রান্ত হয়েছি। সংশয় এসে ঘিরে ধরেছে। মনে হয়েছে, কী লাভ হচ্ছে এ সব লিখে?
ভেবেছি, আলাদা করে মতামত শোনা দরকার, পাঠক-বন্ধুদের। কিন্তু পরক্ষণেই অভিজ্ঞতা তথা সিক্সথ সেন্স বলেছে, সব কাজ অন্যের মতামত নিয়ে করতে হয় না।
একগুঁয়েমি, জেদ ও দৃঢ়চেতা না হলে, যেমন লিটলিম্যাগাজিন সম্পাদনা করা যায় না। তেমন কোন আলোচনাও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়, হাজারো মতের তোয়াক্কা করে। এ ক্ষেত্রে নিজের রুচি ও পছন্দের উপর একমাত্র ভরসা ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই। দেখিনি। তাই চালিয়ে যেতে পেরেছি আলোচনা, এতোটা পর্ব।
কে বা কী, উপকার হলো এ সব আলোচনায়, এখনো জানি না। তবে, প্রকৃত কবি ও কবিতাপ্রেমীদের ব্যাপক সাড়া ও অংশগ্রহণ, আমাকে আশান্বিত করেছে। আন্দোলিত করেছে। যার ঢেউয়ে আমি এতোটা পর্ব লিখতে সক্ষম হয়েছি।
ফেসবুক এর এই প্রচারণা বা নিজেকে/নিজেদের তুলে ধরার চমৎকার সুযোগ পজেটিভ অর্থে কাজে লাগানো দরকার বলে আমি মনে করি। আমি সে চেষ্টাটিই করেছি।
এরপর অন্যেরা এগিয়ে এলে, আমরা সমন্বিত ধারায় এগিয়ে যেতে পারবো বলে মনে হয়। অবশ্য যার লক্ষণ ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে। অগ্রজ-অনুজ, অনেকে একে অন্যেকে নিয়ে আলোচনা করছে, তুলে ধরছে। আশাকরি তাদের এ উদ্যোগ ও উদ্যম অব্যাহত থাকবে।
আমি, এ সব আলোচনার ফাঁকে-ফাঁকে অভ্যাসবশত নিজের লেখা ও সাহিত্যের পড়াশুনা সমানে চালিয়ে গেছি। যাচ্ছি।
আলোচনা যে কত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ তা উপলব্ধি করছি, সাম্প্রতিক, বুদ্ধদেব বসু, পড়তে-পড়তে।
আমাদের এই আত্মমগ্ন কালে একজন বুদ্ধদেব বসু যে, কত বড় পথ প্রদর্শক হতে পারেন, তা ভাবলে শ্রদ্ধাবণত হতে হয়।
কিন্তু আমরা যেন ভুলে না যাই, একজন বুদ্ধদেব বসু যেমন ছিলেন রবীন্দ্র পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতার এ যাবতকালের একজন সেরা ও শ্রেষ্ঠ আলোচক-সম্পাদক, তেমনি আধুনিক বাংলা কবিতার একজন প্রধান ও সেরা কবিও, তিনি।
এটি বললাম, আমার সামান্য পঠন-পাঠন ও উপলব্ধি থেকে। কেননা, আমরা অনেকেই ভুলে যাই, আলোচকও তার কালের সেরা ও প্রধান কবি হতে পারেন বা হন।
১২.০৫.১৬
আটলান্টা, জর্জিয়া।