ড. ফজলুল হক তুহিন
কবিতা আর গদ্য পরস্পর ভাই ভাই, হাত ধরাধরি করে চলে দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো। গদ্য ও কাব্যের এই বন্ধুত্বপূর্ণ পথচলা আধুনিক সাহিত্যে আজ প্রতিষ্ঠিত। তারা কেউ কারো শত্রু নয়। বিশেষভাবে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ এবং তিরিশোত্তর লেখকরা গদ্য ও কাব্যের বেড়া বা সীমানার মোটা দাগ মুছে দিয়েছেন। একটা ভালো কবিতা উৎকৃষ্ট গদ্যের মতো অথবা একটা সুলিখিত গদ্য সফল কবিতার মতো হতে পারে। কবিতায় গদ্যের উপভোগ আর গদ্যে কবিতার স্বাদ পাওয়া মানে বাড়তি কিছু পাওয়া। কবিতা যে ভাষায় রচিত হয় এবং গদ্য যে ভাষায় নির্মিত হয় তার উৎসভূমি আমাদের সমাজের বিশাল অঙ্গন। একই উৎস থেকে উত্থিত ভাষা দুই মাধ্যমে দুই ধারায় বহমান। তবে আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধা থাকে সব সময়। সাহিত্যিক ও মনীষী হুমায়ুন কবীরের ‘নদী ও নারী’ উপন্যাসের ভাষ্যরূপ:
সাঁঝের আলোতে পদ্মার সে কী ভৈরবী রূপ। একেও নদী বলে? নজুমিয়ার বাড়ীর ধারেও তো সে নদী দেখেছে, –শান্ত, ঘরোয়া জলের ধারা গ্রামের কিনারা দিয়ে ধীরে ধীরে বয়ে যায়। তার সঙ্গে পদ্মার মিল কোথায়? এ যে এলোকেশী উন্মাদিনীর মতন ছুটে চলেছে, জলের স্রোত ফুলে ফুলে উঠছে, চারিদিকে চাপা ক্রন্দনের সঙ্গে যেন গর্জনের রোল। আর থেকে থেকে বিরাট শব্দে মাটির চাপ ভেঙ্গে পড়ছে। নদীর সীমানাই বা কই? যতদূর দেখা যায় জল শুধু জল। দূরে আবছায়া পাড় চোখে পড়ে তো পড়ে না, সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে জলের স্রোত এক অপাথির্ব দীপ্তি। ভয়ে ভয়ে নজুমিয়া জিজ্ঞাসা করেছিল– একি সমুন্দরে পৌঁছলাম? দলের লোক হেসে উঠল, বলল না রে না–এ হ’ল পদ্মা নদী। এখানে জমি মিলবে– এখানেই আমরা ভিটে বাঁধব।
এইসব পঙক্তি কবিতা হিসেবেও পাঠ করা যেতে পারে। উপমা-রূপক-চিত্রকল্পের সমবায়ে নির্মিত গদ্যের পরতে পরতে কবিতার স্পন্দন অনুভব করা যায়। জীবনের বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণে একটা সুখপাঠ্য গদ্য লিখেছেন কথাশিল্পী– যেখানে কবিতার স্বাদ ও উপলব্ধি উভয়ই মেলে। অন্য দিকে শামসুর রাহমানের ‘হোমারের স্বপ্নময় হাত’-এর দৃষ্টান্ত পাঠ করা যাক:
এখন আমার আশে-পাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। এখন যদি
খাতা খুলে লিখতে শুরু করি, কেউ ঢুকে পড়বে না আমার
ঘরে, কিংবা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে দেখবে না কি আমি
লিখছি। কোনো উঁকি ঝুঁকি মারবে না কেউ। চারপাশে এখন
নিভাঁজ নিঃসঙ্গতা। আমার একাকীত্ব জলচর প্রাণীর মতো
আলো পোহাচ্ছে। একটু আগে আমার বিচ্ছেদ ঘটেছে
স্বপ্নের সঙ্গে, হয় তো এজন্যেই একটা শূন্যতাবোধ
আপাতত দখল করে দিয়েছে আমাকে।
কবিতাটির ঢঙ সম্পূর্ণ গদ্যময়। কোনো ছোটগল্পের সূচনা হিসেবেও পাঠ করা যায়। আবেগ-কল্পনা-ছন্দের সৃজনী প্রাধান্যও অনুপস্থিত। বরং একটা সাবলীল কথাসাহিত্যের রূপকল্প বলা যায় অনায়াসে। জ্যাক দেরিদার মতে, ভাষার অস্তিত্বের সবচেয়ে প্রধান শর্ত হলো সমষ্টি নির্ভরতা। সমাজবদ্ধ সকল ব্যষ্টির চেতন ও অবচেতন মননে সি ত যাবতীয় ধ্বনি প্রতিমার সমষ্টি একটি সামাজিক গ্রন্থি তৈরি করে যার নাম ভাষা, যা মানব মস্তিষ্কের জটিল গঠনের কোনো এক স্তরে বিরাজ করে। লেখকের এই চিন্তন ও সৃজনস্রোত সৃষ্টি করে কাব্যভাষা আর গদ্যভাষা। আলাদা ভাষাকাঠামো, পৃথক ভাষাসত্তা নির্মিত হয় একই শব্দপুঞ্জ ও একই ভাষাউৎস থেকে। তাহলে কোন্ যাদুবলে স্বকীয়তা পায় দুই সত্তা? ‘পুনশ্চ’, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ বা ‘সোনালি কাবিন’ কোন্ রহস্যে অন্য হয়ে যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ বা ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ থেকে? জীবন-সমাজ-সংস্কৃতি-শব্দপুঞ্জ তো একই; কিন্তু ভিন্ন ও বিচিত্র তার প্রকাশ– যেমন মৃত্তিকার প্রাণরস শুষে হাজার রকম প্রাকৃতিক রঙরেখারূপ।
তবে কি প্রাকৃতিক কোনো কারণ আছে কবিতা আর গদ্যের স্বতন্ত্র সত্তা নির্মাণে? অতিন্দ্রিয় কোনো অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে বা স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে কবি কাব্যচর্চা করেন? আর গদ্যশিল্পী বাস্তবের রূঢ়-কঠিনের তাড়নায় গদ্যচর্চায় নিয়োজিত হন? কবিতা তাই অন্য হয়ে যায় গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধ থেকে? প্রকৃতপক্ষে, কোনো যাদু-রহস্য-কারণই নেই যা গদ্য ও কাব্যকে পৃথক সত্তায় চিহ্নিত করে। এখন স্বভাব কবি বা স্বপ্নাবিষ্ট কবির যুগ আর নেই, এইযুগ স্বাভাবিক বা স্বতঃস্ফূর্ত কবির এবং অবাধ গদ্যশৈলীর অধিকারী কথাশিল্পীর। তবে কবির মতো গদ্যকারেরও সুযোগ নেই আবেগতাড়িত অনিয়ন্ত্রিত গালগল্পের ফুলঝুরি ছড়ানোর। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই প্রথম কবিতা আর গদ্যের বন্ধুত্বকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং পরীক্ষা ও চর্চা করেছেন। তাঁর মতে, ‘গদ্যের চালটা পথে চলার চাল, পদ্যের চাল নাচের।’ ‘অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব এই আমার বিশ্বাস।’ ‘গদ্যে প্রধানত অর্থবান শব্দকে ব্যুহবদ্ধ করে কাজে লাগাই, পদ্যে প্রধানত ধ্বনিযান শব্দকে ব্যুহবদ্ধ করে সাজিয়ে তোলা হয়।’ অর্থাৎ তাঁর কাছে গদ্য ও কাব্য একান্ত নিকট আত্মীয়– একে অপরের মনেপ্রাণেমননে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ এজন্যে গদ্যকবিতাকে ‘পক্ষিরাজ ঘোড়া’র সঙ্গে তুলনা করেছেন, যে উড়তেও পারে, দৌড়াতেও পারে।
তাহলে কি বলা যাবে কবিতা আর গদ্য একই– ‘রক্ত করবী’, ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ অভিন্ন সাহিত্য সৃষ্টি? অবশ্যই না। আমার বলার উদ্দেশ্যও তা নয়। আসলে গদ্যবৃক্ষের কাব্যডানার স্বপ্ন ও কল্পনার বিস্তার অনির্বচনীয়, কিন্তু শেকড় বাস্তবের মাটিতে ব্যাপ্ত। অন্যদিকে কাব্যডানার গন্তব্য প্রতিদিনের বাঁচা-মরার জীবনের উত্তরণে– যার পালকগুলো গঠিত রোজকার অভিজ্ঞতা ও আবহমান ঐতিহ্য থেকে অর্জিত উপাদানে। অর্থাৎ বাস্তব ও কল্পনা, জীবন ও স্বপ্ন, আবেগ ও রূঢ়তা দুই বন্ধুর মতো স্বচ্ছন্দে গন্তব্যে এগিয়ে যায়; কিন্তু মিল-মহব্বত হলেও এক দেহে লীন হয় না, বরং স্বতন্ত্র সত্তা হয়ে দীপ্ত হয়ে থাকে। একে শেকড়ের ডানা এবং ডানার শেকড় হয়ে ওঠার কথকতা বলা যায়।
আসলে কবিতার সজীব শরীর নির্মিত হয় গদ্যের হাড়-মাংসে এবং গদ্যের দেহে যে মাংশপেশী তার কোষে কোষে কবিতার প্রাণ ঢেউ খেলে যায় অনবরত। অবশ্য শিল্পগুণ সম্পন্ন লেখার ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র একথা প্রযোজ্য। সহজ কথায়, কাব্যের বস্তুভিত্তি নির্মিত হয় গদ্যের সাহায্যে, কবি সেখানে প্রাণ প্রতিষ্ঠার কাজটি করেন। অন্যদিকে গদ্যের দেহ নির্মাণের সঙ্গে গদ্যশিল্পী রক্ত প্রবাহের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন কাব্যের মাধ্যমে। ফলে পাঠক ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ পড়ে কবিতার স্বাদ পায় এবং ‘লিপিকা’ বা ‘উচ্চারণ’ পড়ে গদ্যের আমেজ অনুভব করে। আর এভাবেই ভাষা সীমানা ছাড়িয়ে সম্ভাবনার দিগন্ত স্পর্শ করে। জীবন যেমন বাস্তব ও কল্পনার দ্বন্দ্ব দোলায়মান; তেমনি সাহিত্যও কাব্য আর গদ্যে পরস্পর পরিপূরক– হৃদয়ের দুই অলিন্দের মতো। পাঠক হিসেবে আমরা গদ্যের ভুবনে কাব্যের আনন্দ এবং কাব্যের জগতে গদ্যের অনুভব পেতে আগ্রহী।