তুমিই সেই আলবাট্রস
তার আগমনবার্তাই জানিয়ে দেয়– তুমি নেই। হাবভাব দেখে মনে হয় রাজাদেরও রাজা তিনি। কে না জানে যে এ কালের স্বনির্বাচিত রাজাদের যাত্রাপথে বাতাসকেও থমকে দাঁড়াতে হয়। তার দাপট আরও বেশি। আকাশে আকাশ থাকে না। বৃক্ষরাও মুহূর্তে মৃত্তিকাবিমুখ। কোনো এক গূঢ় রহস্যের টানে স্বর্ণ-তৃষ্ণা ভুলে শকুন্তলার মতো মাতম করে কর্দমাক্ত পৃথিবীর প্রাণ।
তুমি থাকলেই কি সব আর্তনাদ থেমে যেত? মাটির শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেত রুদ্ধশ্বাস বৃক্ষদের প্রাণ? বিপন্ন পৃথিবী ফিরে পেত তার লুপ্ত ডানার সুঘ্রাণ? আসলেই কি ডানা ছিল তার? মাটি যদি শৃঙ্খলই হবে শেকড় তাকে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়াবেই-বা কেন? জটিল এই সমীকরণ। দূর সমুদ্রের আলবাট্রস তাকে শিখিয়েছে এইসব। বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছে লবণাক্ত দীর্ঘশ্বাস। হতে পারে তুমিই সেই আলবাট্রস।
তুমি ছিলে। হয়তো-বা আজও তুমি আছো কারো বাহুর বন্ধনে। তবু নাই নাই রব উটের মতো মাথা গুঁজে থাকে কুরুক্ষেত্রের তীব্র ধূলিঝড়ে। একমাত্র ব্যতিক্রম তিনি। তার রাজকীয় পদশব্দে সরে যায় সমস্ত আড়াল। কী যে হয়– সন্ন্যাসী সংসার খোঁজে, সংসারী সন্ন্যাস!
এ জন্মে হলো না
একটিই কবিতা লিখছি আদিকাল থেকে;
গুহার দেওয়ালে যে-আঁকিবুঁকি দেখো সে
আমারই বেদনা; মেঘের পোড়া বুকে যে
বিদ্যুতের বাণী– আমি তাকে চলেছি এঁকে।
এই যে বসে আছি খা খা গোরস্থানেখ–
কত দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার আসে
ডানাহীন মানব নিত্য মহাকাশে ভাসে।
সতত যাকে খুঁজি– কেবল নাহি তার দেখা।
যদি বলি, তোমাকে– তোমাকেই কবিতা করি–
বাধে হট্টগোল; ছুটে আসে আষাঢ়– তার
কী যে আড়ম্বর– যেন-বা পৃথিবীর ভার
কাঁধে ছুটিতেছেন দিবারাত্রি পড়িমরি!
দুদণ্ড দাঁড়াবো তোমার সমাধির পাশে–
ফুরসত কোথায়– কত যে হাঙ্গামা তাতে;
কেউ বিষ্ঠা ছোড়ে– কেউ-বা ছাই বাড়া ভাতে!
এ জন্মে হলো না– তাতে কী– থাকো কালিদাসে।
পঙ্গু পরিত্রাণ
কাঁটা তারে ঝুলন্ত যে ঝলমলে কিশোরীকে দেখছো সে আমি
এই মাত্র যার বক্ষ এফোঁড়ওফোঁড় হলো ঘাতকের অদৃশ্য বুলেটে–
রুদ্ধবাক শীতলক্ষ্যা শোকে– কাকেরা উৎসব করে যার ফুলে উঠা পেটে–
সেও অন্য কেউ নয়– আমারই হাঁড়-মাংসে তৃপ্ত হয় লোভের সুনামি।
এই যে ভবন ধসে পড়ে, লঞ্চ ডোবে, অগ্নিযজ্ঞে বলি হয় কতো স্বপ্নসাধ
অংকবিশারদ তুমি– সংখ্যা বোঝো– তার চেয়ে ভালো বোঝো বিত্ত– অর্থবিল
কংক্রীটের নীচে চাপা পড়ে থাকা– জলে ভাসা– আগুনে পোড়া যে-আর্তনাদ
হিম হয়ে আছে হিমালয়ে– মেরুতে মেরুতে– আমি সেই জীবন্ত ফসিল।
স্তেপের স্তব্ধতা ফুঁড়ে এই যে সুদীর্ঘ উটের কাফেলা নিয়ত চলেছে ছুটে চীন
কান্দাহার-ব্যাবিলন-বসরা অবধি– তুমি যাকে ভালোবেসে সিল্করুট বলে ডাকো
সে তো আমারই রক্তরেখা– বর্শার ফলায় বিদ্ধ যে-করোটি দিয়ে মানচিত্র আঁকো
সেও আমি; আমিই জোগান দেই স্বর্ণমুদ্রা, সিল্ক আর হেরেমের অন্ধকারে দিন।
চেঙ্গিজ খাঁদের অজেয় অশ্বের পদাঘাতে উড়ে যায় যত উলুখাগড়ার প্রাণ–
আমি সেই শবাধার; অদূরে নিভৃতে খুব পাথরে মস্তক ঠোকে পঙ্গু পরিত্রাণ!
কতো রঙ চাহ কবি
সারাক্ষণ ডেকে যাই–
আয় আয়
কত কী যে আসে
কাটা মুণ্ড ভাসে
যাকে ডাকি সেই তো আসে না
কাকে ডাকি– ছবিও ভাসে না।
তবু কে যেন আল্পনা আঁকে
বসন্তে-বৈশাখে
আর হাঁকে– ‘রঙ চাই রঙ
বড় ক্ষিধা– কোথায় আড়ং?’
সমুদ্র সরবে খুব খুলে দেয় বুক
বৃক্ষেরা বাড়ায় বাহু– ফুলেরা চিবুক:
‘কতো রঙ চাহ কবি– দ্যাখো তবে রঙের ঝলক;’
অশান্ত কাঠবিড়ালি– দেখে শুধু সমাধিফলক।
কার হাতে চাবি
যত যুক্ত হতে চাই
শুনি– নাই নাই নাই;
শূন্যের মাজারে পেতেছি সংসার তাই।
তবু নিয়ত হোঁচট খাই
কাটা মুণ্ডু; ভাবি
কার হাতে চাবি?
এত মুণ্ডু কোথা থেকে আসে?
কবির মূর্খতা দেখে শীতলক্ষ্যা হাসে।
হাসে তৈমুর লঙের নাতি:
মুণ্ড দিয়ে দ্যাখেন না কী সুন্দর মালা গাঁথি!
কবি, আপনে ল্যাখেন গান
তাই দিয়ে দুই বেলা খান।
মুণ্ডু যদি না পাই বলেন– কী নিয়ে আমরা বাঁচি?
সাতপুরুষের এই কারবার– এ কি কানামাছি…?
কবন্ধরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে:
যাক বাবা, সকলেই বেঁচেবর্তে আছে!
লকলকে জিহ্বার গর্জন
তুমি যখন তোমার মখমল বাহু দুটি ভাসিয়ে দিয়েছিলে চৈত্রের উদ্দাম হাওয়ায়– ঠিক তখনই গর্জন করে উঠেছিল তার লকলকে জিহ্বা। আবহমান কালের রক্ত-হিম-করা সেই গর্জন চোয়ালবন্দি থাকলেও তার তীক্ষ্ণ দুটি চোখ ঠিকই সেঁটে থাকে আমাদের হৃৎপিণ্ডের নধর মাংসে। কিন্তু কেই-বা তা গ্রাহ্য করে! আর উদীয়মান যে-সূর্য তার গল্প তো একেবারেই আলাদা।
তুমি সেই আলবাট্রস– জন্মলগ্নেই ভেঙে দেওয়া হয়েছিল যার ডানা। নুলো ভিখিরির মতো জনবহুল রাস্তায় তুমি গড়াগড়ি খাবে। যক্ষারোগীর শ্লেষা আর কুকুরের বিষ্ঠায় ঢাকা পড়ে যাবে তোমার দেহের বিদ্যুৎ। তার পরও তুমি হাসবে। বাড়িয়ে দেবে করুণার্দ্র, বিবর্ণ, এবড়ো-খেবড়ো এনামেলের থালা– যেখানে প্রতিবিম্বিত হবে তোমার প্রতিকৃতি।
কিন্তু ইকারুসের বংশধর তা গ্রাহ্য করবে কেন? কত রূপেই না ফিরে ফিরে আসবে জিহ্বার গর্জন। সমুদ্র শাসাবে। গ্রাম্য মোড়লের মতো হামলে পড়বে বৃদ্ধ সূর্যের ক্রোধ। যদিও যথেষ্ট বিনম্র তুমি, তবু কেই-বা সহ্য করে উদীয়মান সূর্যের স্পর্ধা? আর স্বনির্মিত ডানার যে-দ্যুতি– সে তো আরও শাশ্বত, আরও মহৎ।
তাকে আসতেই হয়
সে তো আসবেই। যদি না আসতো কুষ্ঠরোগীর মতো কি খসে পড়তো না অরণ্যের অনাঘ্রাত স্তনের মাদকতা? কামার্ত বালিয়াড়ির অষ্টবাহুর তাণ্ডবে কি দম বন্ধ হয়ে আসতো না জলপরিদের? বাংলামতি ধানের শীষে ভৌতিক বাদুড়ের মতো কি ঝুলে থাকতো না অগণিত অদম্য কৃষকের খুলি?
অবশ্য যারা বলে তোমার দেহনির্গত বর্জ্যে পৃথিবীর প্রাণ ওষ্ঠাগত– তাদের হিসাব আলাদা। পিঁপড়ার মুখের চিনির দানাটিও তাদের চকচকে চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। অথচ ইঁটভাটার মতো কর্কশ হৃদয় থেকে নিরন্তর যারা ঘৃণার আলকাতরা উদ্গীরণ করে চলেছে– সে বিষয়ে তারা শিশুর মতো সরল।
বস্তত তারা পাথর সঞ্চয় করে। প্রাসাদ বানায়। রূপসীর ত্বকের মতো স্বচ্ছ আর গ্রীবার মতো উদ্যত। তার আয়নায় নিয়ত নিজের চর্বিবহুল গর্বিত অবয়ব দ্যাখে। আর পরিযায়ী পাখির ডানায় চেপে যে-গান পৃথিবী পরিভ্রমণ করে; মেরু-ভল্লুকের তুষারাবৃত আলস্য এনে ভাসিয়ে দেয় হাকালুকি হাওড়ের উষ্ণ জলে–তাকে তারা পাথরচাপা দিয়ে রাখতে চায়।
তখনই মত্ত হাতির মতো সব লণ্ডভণ্ড করে সে আসে। তাকে আসতেই হয়।
আহা কতোদিন পর
তোমাকে নিয়ে ঘরে ফিরছি। আহা কতোদিন পর! হূলস্থূল লেগে যায় অন্তঃপুরে। সবাই তোমাকে চায়। প্রতি রক্তকণা। প্রতি বিন্দু ঘাম। মস্তিষ্ক পাগল প্রায়। বিশাল সমস্যা তার। শুধু এক মায়াময় এক শব্দের ডাকিনী ফতুর করেছে তাকে। ঘুরিয়েছে পথে ও বিপথে। তাই বড়োই বেচইন তিনি।
তোমাকে নিয়ে না তোমার সখ– কী আসে যায় তাতে! যেভাবেই লিখি না কেন তুমি আছো। আহা কতোদিন পর মনে হয়– আমি আছি।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ পৃথিবী তাই সুবোধ বালকের মতো ঠিকঠিক মেনে চলে দিনরাত্রির হিসাব। তাই প্রাচ্যের তপ্ত লৌহশলাকার মতো পুরুষালী দিন– অভিষিক্ত হলো মুহূর্তে নিরাবরণ মেরুবালিকার বিমুগ্ধ আলিঙ্গনে। তাই বর্জ্যরে ভাগাড় জুড়ে ম ম করছে আরব্যরজনীর আশ্চর্য রমণীয় ঘ্রাণ। আমার চির ক্লান্ত দুটি পা– কী সাবলীল ভেসে যাচ্ছে পরিযায়ী পাখিদের দলে। আহা কতদিন পর!
ভুলিনি ডানার স্পর্ধা, হে আলবাট্রস
তোমার বিশাল স্তনে মুখ গুঁজে বেঁচেবর্তে আছি–
দলছুট বিপন্ন মৌমাছি;
চেঙ্গিজ খানের তীক্ষ্ণ তরবারি মাথার ওপরে
অবিশ্রাম করে নাচানাচি।
দীর্ঘ পথের দুপাশে মন্ত্রপূত ধান-দুর্বা-ধূপ নয়– শুধু
ভেড়া-ভাঁড় আর পঙ্গপালের খামার
দেখিয়েছে পাছা তার; ছড়িয়েছে বিষ্ঠা–দুর্গন্ধ অপার এবং
তুলেছে হুঙ্কার শুধু: ‘আমার আমার’।
উজাড় করেছে স্বপ্ন- রঙ-হৃদয়ের ভাষা– তবু তাহাদের অনির্বাণ
ক্ষুধার আগুন দেখে দিব্যি তুমি হাসো
অথচ আবক্ষ তৃষ্ণা সুতীক্ষ্ণ চঞ্চুতে তার ছিড়ে খায় যখন আমাকে–
তুমি রাজহাঁস– নির্লিপ্তির জলে ভাসো।
দিয়েছো দেয়াল শুধু– এ কালের প্রতিবন্ধী ছুঁচোগন্ধী যত
সাহিত্য কীটের মতো উদ্যত কর্কশ!
নিয়েছি মস্তক পেতে সব– যদিও হৃদয় শরবিদ্ধ– শৃঙ্খলিত ডানা;
ভুলিনি ডানার স্পর্ধা, হে আলবাট্রস।
যখন ঘুমিয়ে যাবো
যখন ঘুমিয়ে যাবো, জানি, শুধুই থাকবে জেগে দীর্ঘশ্বাস।
বাজারের থলে হাতে ত্রস্ত ছুটে যাবে ছায়াসঙ্গিনী আমার।
ছেলের পরীক্ষা ছিল; হই-হট্টগোলে হয়নি খাওয়া তার
দীর্ঘ দুটি দিন। মুখ ফুটে বলবে না কিছু। যে গেছে সে গেছে–
ঢের বেশি জীবনের খাঁই! অন্ধকার– তবু তো উৎপাত নাই
অন্তহীন ক্ষুধা ও তৃষ্ণার।
মেয়েটি বিরক্ত খুব নিজের ওপর।
বাবাকে যে কত্তো ভালোবাসে– অথচ হয়নি বলা।
এটা কি সময় হলো ডানা গুটাবার!
জরুরি মিটিং আছে ইউএন সদরদপ্তরে।
মিরপুর থেকে ম্যানহ্যাটান– এত যে দৌড়ঝাঁপ–
সব বৃথা যাবে? এমন সুযোগ কি বারবার আসে–
বলো– বিশ্বসভায় নিজেকে প্রমাণের?
‘ভালো থেকো মা আমার।– নিদ্রার কৃষ্ণবিবর ফুঁড়ে
তখনো উঠবে বলে ব্যাকুল হৃদয়।
শুধু দীর্ঘশ্বাস?
শিশিরের আলিঙ্গনে বেজে চলে যে-নিভৃত ঘাসের সংগীত
ঝরা বকুলের ঘ্রাণে যে-গান ঝংকার তোলে বাতাসের প্রাণে
যে-সংগীত মূর্ত হয়ে আছে ঝরনার জলমগ্ন তিন জোড়া নগ্ন পায়ে
কুমারীর কম্পমান ঠোঁটে ফুটে ওঠে যে-আশ্চর্য গানের গোলাপ– তার
শেকড়ে শেকড়ে– নুড়ি ও পাথরে–পাতায়-পল্লবে
সতত উড্ডীন জেনো আমার পতাকা।
মৃত্যুই এ জীবনের শেষ কথা নয়।
কবিতা-ভাবনা
কবিতার পেছনে ছুটছি সেই শৈশব থেকে। কবুল করতে দ্বিধা নেই যে তার সম্পূর্ণ অবয়বটিও আমার কাছে স্পষ্ট নয় অদ্যাবধি। কখনো তাকে মনে হয়েছে জন্ম-জন্মান্তরের চেনা পরম আরাধ্য প্রেমিকা, কখনো-বা সুদূরতমা এক দেবী। কখন কী কারণে কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম, জানি না। এ কি প্রেম, না তার চেয়ে গভীর গভীরতর কিছু–তা নিয়েও নিঃসংশয় নই আমি। কিশোর বয়সে পরীক্ষার খাতায় প্রথম কবিতাটি যখন লিখে ফেলি, তখন কে কী উদ্দেশ্যে আমাকে দিয়ে এ অদ্ভুত কাজটি করিয়ে নিয়েছিল– তা আজও আমার কাছে দুর্জ্ঞেয় এক রহস্যই রয়ে গেছে। এটা যে কবিতা– তাও জানতাম না। অবধারিতভাবে জীবনে প্রথমবারের মতো পরীক্ষায় খাতায় শূন্য পেয়েছিলাম। দাঁড়াতে হয়েছিল শিক্ষক ও অভিভাবকের যৌথ কাঠগড়ায়। তবে কাজটি করে যে অনির্বচনীয় এক আনন্দ পেয়েছিলাম– তা আজও স্পষ্ট মনে আছে। কবিতাকে কেন্দ্র করে যুগপৎ বেদনা ও আনন্দের সেই দ্বৈরথ এখনো আমার পিছু ছাড়েনি। এক অর্থে সেটা ছিল একটা প্রতীক– যা কাব্যযাত্রার সূচনালগ্নেই আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল যে তোমার কবিতার খাতা যত পূর্ণ হবে, জীবনের প্রাপ্তির খাতা ততই শূন্যতায় ভরে যাবে।
কবিতা লিখে কী হয়– এ প্রশ্ন আমি নিজেও নিজেকে করেছি বহুবার। চার দশকের দীর্ঘ কাব্যযাত্রার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কোনো প্রকার বৈষয়িক তরক্কি যে হয় না, এটা নিশ্চিত। বরং পদে পদে রক্তাক্ত হতে হয় নির্মম উপেক্ষা আর ব্যর্থতার চাবুকে। কবির বিরুদ্ধে কোথায় যেন একটা গোপন সংহতি রয়েছে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় লৌকিক ও অলৌকিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে। কবিকে সর্বতোভাবে ব্যর্থ দেখতেই যেন সবাই উন্মুখ। অস্বীকার করবো না যে নিরঙ্কুশভাবে বিত্তশাসিত সময়ের রুদ্ধশ্বাস এই ইঁদুরদৌড়ের মধ্যেও অকস্মাৎ কোনো একটি কবিতার প্রসঙ্গ তুলে কখনো কেউ যখন বলেন, ‘কবিতাটি কি আপনি লিখেছেন কিংবা এ পঙ্ক্তিটি কি আপনার’– তখন নিজের ভেতরে অজাগতিক আনন্দের একটা শিহরণ অনুভব করি। তবে বেদনাও কিছু কম পাইনি। কবি তো এক ধরনের সন্ত। কিন্তু সেই কবির আলখেল্লার ভেতর আজকাল নখ-দন্ত ও উদরসর্বস্ব যে-সব মানুষসদৃশ অতি ধূর্ত প্রাণীকে দেখি– তাতে অত্যন্ত পীড়িত বোধ করি।
কোন্টি কবিতা আর কোন্টি কবিতা নয়– তা নিয়ে আমি কখনোই গলদঘর্ম হইনি কিংবা হওয়ার তাগিদও অনুভব করিনি নিজের ভেতরে। মহাজনরা এ নিয়ে বিস্তর কথা বলেছেন। সেগুলো পড়ে অভিভ‚ত হই। মনে হয়, এইবার ঠিক ধরে ফেলেছি সেই অধরা রহস্যের স্বরূপ ও ঠিকুজি। কিন্তু সেই ঘোর কেটে যেতে সময় লাগে না। কবিতা তো আর কম লিখিনি। কিন্তু এখনো লিখতে বসে সেই প্রথম কবিতা লেখার মতো কম্পন অনুভব করি নিজের ভেতরে। ঘর্মাক্ত সাধনার পর শব্দের তুলিতে যে-ছবিটি ফুটে ওঠে, অবাক হয়ে আবিষ্কার করি, আমি যা লিখতে চেয়েছি এ তো তা নয়। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘নির্বাচিত কবিতা’র পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে গিয়েও একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে। মনে হয়েছে, আমি নই– অন্য কেউ লিখেছে বা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে এসব কবিতা– যদি তা আদৌ কবিতাপদবাচ্য হয়ে থাকে। আগেই আভাস দিয়েছি যে, কোনো প্রকার পরিকল্পনা বা প্রত্যাশা নিয়ে কবিতা লেখা শুরু করিনি। তার চেয়ে বড় কথা হলো, এটি আমার ইচ্ছাধীন কোনো কর্ম নয়। নিজের মধ্যে নিরন্তর ফলাকাক্সক্ষাশূন্য দুনির্বার এক তাড়না অনুভব করি। আমার নামে মুদ্রিত বা প্রকাশিত কবিতাগুলো তারই ফসল মাত্র। ফলে কে তাকে সাদরে গ্রহণ করলো বা ছুড়ে ফেললো তাচ্ছিল্যভরে– তা আমাকে কখনোই খুব একটা স্পর্শ করেনি।
হয়তো তিনি অন্যরকম এক দেবীই। নয়তো তাঁর পদতলে শত শত বছর ধরে কেন অর্ঘ্য দেবেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা কিসিমের শত শত কবি? শুধু কি হৃদয়নিংড়ানো কবিতাকুসুম? –এমন কবির সংখ্যাও একেবারে কম নয় যারা নিজের মহার্ঘ জীবনটাও সমর্পণ করে গেছেন তাঁর পায়ে। দেবীর মতিগতি বোঝা কঠিন। কারো কারো অর্ঘ্য প্রায় সবটাই তিনি গ্রহণ করেছেন। আবার কারো প্রদত্ত অর্ঘ্যরে দিকে ফিরেও তাকাননি। কেউ অযাচিতভাবে পেয়ে গেছেন তাঁর বরমাল্য, আবার কেউ-বা দেবীর পাষাণ পদতলে আমৃত্যু মাথা ঠুকেও তাঁর করুণার পরশটুকুও পাননি। আমি তাঁর সামান্য এক সেবক মাত্র। আমার এ অকিঞ্চিৎকর জীবনের যা কিছু সঞ্চয় সবই সমর্পণ করেছি তাঁর বেদিমূলে। দেবীর পদতলে নিবেদিত কবিতার্ঘ্য দিয়ে মহাকাল নিরন্তর যে-মালা তৈরি করে চলেছে, তাতে আমার একটি-দুটি পঙ্ক্তিরও যদি ঠাঁই হয়– তাতেই নিজেকে ধন্য মনে করবো। না হলেও ক্ষতি নেই। আমি তো নিমিত্ত মাত্র।
মিনার মনসুর: সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
মিনার মনসুর মূলত কবি। তবে গদ্যেও সমান দ্যুতিময় তাঁর কলম। লেখালেখির শুরু সত্তরের দ্বিতীয়ার্ধে। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ (১৯৮৩) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। প্রাবন্ধিক ও গবেষক হিসেবেও সুপরিচিতি রয়েছে তাঁর। বেশকিছু কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও বাংলা একাডেমি থেকে দুটি গবেষণা গ্রন্থ এবং আগামী প্রকাশনী ও নান্দনিক থেকে দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক সংবাদে ‘অনির্বাণ বাতিঘর’ শিরোনামে এবং দৈনিক ইত্তেফাকে ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ শিরোনামে কলাম লিখেছেন দীর্ঘদিন। জাতীয় কবিতা পরিষদ ও বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য এবং জাতীয় প্রেসক্লাব ও এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে সহকারী সম্পাদক হিসেবে দৈনিক ‘ইত্তেফাক’-এ কর্মরত আছেন।
জন্ম ২০ জুলাই ১৯৬০ সালে– তাঁর পৈতৃকবাস চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বরলিয়া গ্রামে। বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রাম শহরে। লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ (চট্টগ্রাম) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাস করেছেন যথাক্রমে ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে। উভয় পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তির জন্যে শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ স্বর্ণপদকে (১৯৮১-৮২ শিক্ষাবর্ষ) ভূষিত হন। কবিতার জন্যে বোধন আবৃত্তি পরিষদ সম্মাননা পান ১৯৯৮ সালে।
ছাত্র রাজনীতি ও লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সক্রিয়ভাবে। লিটল ম্যাগাজিন ও প্রকাশনা সংস্থা ‘এপিটাফ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত চাকসু’র অমর একুশের প্রকাশনা ‘অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করে। সাপ্তাহিক ‘দেশবন্ধু’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবনের শুরু। মাসিক ‘প্রজন্ম’, মাসিক ‘অধুনা’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন দেশিবিদেশি বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে। দৈনিক ‘সংবাদ’-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন।
পেশাগত কারণে আমেরিকা, ব্রিটেন, ভারত, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও নেপাল ভ্রমণ করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে এক কন্যা (আলোকিতা তাহমিন মনসুর) এবং এক পুত্র (অদম্য স্বাপ্নিক মনসুর) সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রী তাহমিন আরা একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত আছেন।
যোগাযোগ: ফোন: ০১৯১৪ ৯০০৭৮১/০১৮৪২ ৯০০৭৮১
২. প্রকাশিত গ্রন্থ
কবিতা: ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ (১৯৮৩); ‘অনন্তের দিনরাত্রি’ (১৯৮৬); ‘অবিনশ্বর মানুষ’ (১৯৮৯); ‘আমার আকাশ’ (১৯৯১); ‘জলের অতিথি’ (১৯৯৪); ‘কবিতাসংগ্রহ’ (২০০১); ‘মা এখন থেমে যাওয়া নদী’ (২০১১); ‘মিনার মনসুরের দ্রোহের কবিতা’ (২০১৪) এবং ‘মিনার মনসুরের প্রেমের কবিতা’ (২০১৪)। ‘পা পা করে তোমার দিকেই যাচ্ছি’ (কলকাতা, ২০১৬); ‘নির্বাচিত কবিতা’ (২০১৬)। ছড়া: ‘হেলাফেলার ছড়া’ (১৯৮৯)। গবেষণা: ‘হাসান হাফিজুর রহমান: বিমুখ প্রান্তরে অনির্বাণ বাতিঘর’, (বাংলা একাডেমি, ১৯৯৯); ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত: জীবন ও কর্ম’ (বাংলা একাডেমি, ২০১২)। প্রবন্ধ: ‘শোষণমুক্তির লড়াইয়ে মধ্যবিত্তের ভ‚মিকা’ (১৯৮৭); ‘কবি ও কবিতার সংগ্রাম’ (২০১৩) এবং ‘আমার পিতা নয় পিতার অধিক’ (২০১৬)। জীবনী: ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’, (বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭)।
৩. সম্পাদিত গ্রন্থ/পত্রপত্রিকা
এপিটাফ (১৯৭৮-৯১); চাকসু বার্ষিকী (১৯৮১); ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৯; দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ: ২০০০; তৃতীয় সংস্করণ: ২০১০)। ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ’ (১৯৯৪)। ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা’ (১৯৯৫)। ‘মুক্তিযুদ্ধের উপেক্ষিত বীর যোদ্ধারা’ (২০০৮)। ‘বাংলাদেশের সমাজ রাজনীতি ও উন্নয়ন: বিশিষ্ট জনের ভাবনা’ (২০১০); সিকদার আমিনুল হক রচনাসমগ্র (দুই খণ্ড: ২০১৫)।