১. জীবন কি? আপনার বর্তমান জীবন, অবস্থান– যা হতে চেয়েছিলেন বা যা হয়েছেন– এসব নিয়ে কোন আক্ষেপ, অনুশোচনা বা গর্ব হয়?
মজিদ মাহমুদ: জীবন সময়ের শরীর থেকে উত্থিত তরঙ্গ ও ফেনার নাম, মহাসমুদ্র ও পর্বতগাত্র থেকে খসে পড়া একবিন্দু মরুবালুকার নাম, এক অজানা অদৃশ্য জগত থেকে আবির্ভূত হয়ে এক অজানা রহস্য লোকে হারিয়ে যাওয়ার নাম। আমরা জীবন বলে যা মনে করি, পরিপালন করি, তা সম্বন্ধে আমরা প্রায় কিছুই জানতে পারি না, আমরা যাকে আমাদের শরীর ভাবি– তা এক জীবন-পর্বে অনেকবার পরিবর্তন ঘটে, এমনকি যে জীবন আমরা প্রাপ্ত হই– সে জীবনও অনেক জীবনের সমন্বয়, যার কিছুটা আমাদের সঙ্গে থাকে, কিছুটা বাইরে থাকে, কিছুটা মহাসমুদ্রে থাকে, কিছুটা ছায়াপথ মিল্কিওয়ে কৃষ্ণগহ্বরে মিশে থাকে। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন অদৃশ্য অনুজীবীরা আমাদের সারাক্ষণ ঘিরে রাখে, তারা নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলে আমরা বাঁচতে পারি না, আমাদের শরীর আমাদের নিজের বলে বিবেচিত হলেও এর টিকে থাকা ও আনন্দের উপাদান থাকে অন্যের শরীরে। বাতাস পানি আলো ও অন্ধকার সবই আমাদের জীবনের অংশ।
ফলে, এ জীবন নিয়ে আক্ষেপের কিছু নেই, তবু মানব জীবন এক আপেক্ষপের নাম, অপূরণীয় স্বপ্নের নাম, যে জীবন দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যায়, সেই জীবনটুকু পার করাও অনেকের জন্য দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আমার জন্যও তা স্বাভাবিক, কিন্তু আমি তা হতে দিতে চাইনি, আমি জীবনকে একটি গর্দভের মতো ব্যবহার করতে চেয়েছি, যে প্রতিমুহুর্তে আমাকে তার পিঠ থেকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে, তার জিন ও লাগাম নিয়ন্ত্রণে রাখা অতো সহজ নয়, কিন্তু আমিও তার সাথে সমান তালে এগিয়ে চলতে চাই, সে যতটা বন্য আমিও ততোটাই দক্ষ সোয়ারি, একদিন নিশ্চিত সে আমায় তার পিঠ থেকে ফেলে দেবে, সুতরাং আমার সময়ের দানটুকু আমি খেলতে চাই। তাই না পাওয়ার আক্ষেপ ও অনুশোচনাকে আমি সম্ভাবনা কর্ম ও ফলাফলে রূপান্তর করতে চেয়েছি।
২. আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে? কীভাবে কেটেছে? কোন অব্যক্ত কথা বা স্মৃতি কি মনে পরে? তাড়িত করে?
মজিদ মাহমুদ: আমার শৈশব কেটেছে অতি গ্রামে, পদ্মার পলি থেকে গড়ে ওঠা একটি চরে, আমরা ছিলাম অনেক ভাই বোন, আমাদের পরিবারটি ছিল বর্ধিষ্ণু, বাড়িটি ছিল নানা রকম ফলদবৃক্ষ পরিপূর্ণ, আমাদের বাড়ির তালগাছ দশ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যেতো, পাবনা শহর থেকে ফেরার পথে রিকশা থেকে হেমায়েতপুর নেমে তালগাছটি লক্ষ্য করে আমরা গ্রামের দিকে এগুতে থাকতাম। আমি ছিলাম দশ ভাইবোনের নবম জন, আমার পরে এক বোন, ভাইরা ছিল আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, আমার জন্মেরও আগে আমার বড় ভাই বি.এ পাস করেন, ওই গ্রামে প্রথম বিয়ে পাস, কবিতা লিখতেন, উপন্যাস লিখতেন, সে সব লিখে লিখে তার একটি টিনের বাক্সের মধ্যে জমা করে রাখতেন, সে-সবই উঁইয়ের গর্ভে গিয়েছিল, অনেক পরে এসে আমাদের অনুরোধে ‘মালা’ নামে একটি কবিতার বই ছেপেছিলেন তিনি, পরে ধর্মকর্মের কারণে কবিতা লেখা ভালো কাজ মনে করতেন না, আমি যখন কবি হয়ে উঠছিলাম তখন তার দ্বারা যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম, তিনি মনে করতেন কবির জন্য কোনো ভালো ভবিষ্যৎ নেই। মেজভাই আব্দুল খালেক বিশ্বাস তিনি খুব শৈশবে এলাকায় কবি বলে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সেই সময় সেই ১৯৭০/৭১ সাল স্বাধীনতা যুদ্ধ ও আন্দোলনের মহাতরঙ্গের সময় তিনি চারণ কবি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তার কবিতা ‘সোনার বাংলা স্বাধীন হলো’ ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’– এসব গ্রামের হাটে ঘাটে মাঠে কবিয়ালরা গেয়ে বেড়াতেন, বিক্রি করতেন। তারপর চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধে তিনি সরাসরি যোগদান করেন, সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য ভারত গমন করেন, বড় ভাইও যোগ দিয়েছিলেন, আমাদের বাড়িটি ছিল স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প, পাকবাহিনি বাড়িটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল, পুরো গ্রামটিই জ্বালিয়ে দিয়েছিল, আমরা অনেক দিন শরনার্থী ছিলাম, তখন আমার বয়স ৫/৬ বছরের কোঠায়। আমার মনে হয়, আমার মানস গঠনে এই উত্তাল সময়টি অনেক ভূমিকা রেখেছিল। আমার কোনো সচেতন স্মৃতি এই সময়ের বাইরে যেতে পারে না, কারণ মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর প্রতিদিনের টানটান উত্তেজনা, অস্থিরতা, খাদ্য সংকট সে-সবও আমার স্মৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। জাতির পিতার সপরিবারে হত্যাকাণ্ড, জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড, এরশাদের ক্ষমতা দখল– সে-সবই ঘটেছিল আমার স্কুল জীবনে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ট্রমা আমার মধ্যে এখনো কাজ করে, যে কারণে কোনো সরল সিদ্ধান্তে আমি উপনিত হতে পারি না, পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা আমার জটিল মানসিকতার অংশ হয়ে দাঁড়ায়। তাই জীবন নামক বন্যপ্রাণিটি ছাড়া আমার কোনো স্থির বিশ্বাস নেই। কেবল সেটিকে পোষ মানাতে চাই, তার সঙ্গেই খেলা করি। দোলাচলে ভূগী, কিন্তু একটি সামগ্রিক কল্যাণ চেতনা কখনো আমায় ছেড়ে যায় না।
৩. সাহিত্যে এলেন কেন? কীভাবে এলেন? অর্থাৎ শুরুটা কীভাবে? কোথায়?
মজিদ মাহমুদ: হয়তো আমি সাহিত্যিক হিসাবেই জন্মগ্রহণ করেছিলাম, কবি হিসাবেই জন্মগ্রহণ করেছিলাম। লেখালেখি কখন কিভাবে আমি শুরু করেছিলাম তার দিনক্ষণ সঠিক মনে নেই। স্কুলে যাওয়ার আগেই আমি জানতাম– আমি একজন কবি, ভবিষ্যতে খুব নামডাকওয়ালা কবি হবো, কবি হলে কি হয় তা জানতাম না, ধানের ক্ষেতে নির্জনে বসে থাকতাম, নদীর ধারে সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখতাম, সব সময় কিছু একটা বলতাম, মনে মনে কিংবা শব্দ করে, হয়তো বাড়ির আবহাওয়া এটার জন্য অনুকূল ছিল। কারণ বড় ভাই কবি, মেজভাই একজন চারণ কবি, বাড়িতে এসব চলতেই থাকতো, আমাদের বাইরের বৈঠকখানা, যেটাকে আমরা খানকা ঘর বলতাম, সেখানে কবিতা পড়তে আসতো কবিয়ালরা। বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই পুঁথি পাঠ চলতো, এলাকার সব বয়সী সব লিঙ্গের মানুষ– এ সব পুঁথি শুনতে আসতো, মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো একটা যুদ্ধের উপন্যাস, বিষাদসিদ্ধুর হৃদয়বিদারক ঘটনা, অজর পরিবারের আত্মত্যাগ, আমাদের উঠানে বসে কেউ একজন পাঠ করতেন– আর সবাই মিলে শুনতেন– হয়তো এর মধ্যেই আমার লেখক জীবন সম্পন্ন হয়েছিল। তবে দুটি বইয়ের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি– যেটি আমার চতুর্থ পঞ্চম শ্রেণির মধ্যে বেশ কয়েকবার পড়া হয়েগিয়েছে। তার একটি ‘আরব্য উপন্যাস’, অন্যটি ম্যাক্সিম গোর্কির ‘আমার ছেলেবেলা’– বই দুটি আমাদের বাড়িতে ছিল, নিজেকে ম্যাক্সিমগোর্কির লেক্সেইয়ের মতো মনে করতে শুরু করি, দিদিমার নেওটা হয়ে ঘুরে বেড়ায়, কাঠকুড়াতে যাই, ভিক্ষা করতে যাই, ভলগার তীরে তীরে, আর পেশকভের মতো কাজান বিশ্ববিদ্যালয় গমনের স্বপ্ন ছিল চোখে, কিন্তু পূরণ করা তার মতোই কঠিন হয়ে পড়ে; কারণ গ্রামে আমাদের অবস্থা ভালো হলেও বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ সহজ ছিল না, যথেষ্ট সংগ্রাম লড়াই বঞ্চনা আর্থিক সংকট আমাকে গড়ে তুলেছে, আমার লেখক জীবনে রসদ জুগিয়েছে। তাছাড়া বাবার দৃঢ়চেতা মানসিকতা, সাহস, সত্যবাদিতা, ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান এবং মায়ের সবার প্রতি ভালোবাসা ও অভিযোগহীন জীবন আমার শৈশব বর্তমানের মতো গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল।
৪. বাংলা ভাষার তথা বাংলাদেশের প্রধান কবিবৃন্দ যেমন : আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ– তাদের সাহিত্যকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন? কার-কার সঙ্গে আপনার সখ্য বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিলো বা আছে? তাদের সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা বা তাদের সাহিত্য নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
মজিদ মাহমুদ: এঁরা সবাই ছিলেন কবি, আমার গুরুজন, বাংলা ভাষার বড় কবি, কবিতাই তাদের জীবন ছিল, কবিতার সুখ দুঃখ নিয়ে তাঁরা বাস করতেন, কবিতায় জীবন যাপন করতেন। যাঁদের নাম বললেন, তাদের প্রায় সবার সঙ্গেই আমার কমবেশি পরিচয় ছিল, জানাশোনা ছিল, ঘনিষ্ঠতা ছিল, প্রায় সবাইকে কাছ থেকে দেখেছি, কেবল আহসান হাবীবকে কম দেখেছি। তবে ব্যক্তিগত সম্পর্কটি সবচেয়ে বেশি ছিল কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে, তাঁর বাসায় বহুবার গেছি, তাঁর চোখে ড্রপ দিয়ে দিয়েছি, তাঁর পুত্রবধূ টিয়ার হাতে কাঁচের কাপে অনেক চা খেয়েছি। ১৯৯৪ সালে তাঁর সম্পাদিত কোলকাতা মডেল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত কবিতা সংকলনেও কনিষ্ঠ হিসাবে আমার কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি যখন জীবনের শেষ পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গেছি, একজন নার্স গলার ছিদ্র পথে সারাক্ষণ একটি তুলার কাঠি দিয়ে তাঁর শ্লেষ্মা বের করছেন, খুব কষ্ট পেয়েছি, ভেবেছি– জীবন কি এমন নির্মম! একদিন কি কবি হিসাবে, এই পরিণতির মধ্য দিয়ে আমাকেও যেতে হবে। আমি তাঁর কবিতা খুব বেশি পড়েছি, শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রতিটি পৃষ্ঠার কবিতা, কোন বইয়ের কবিতা– সব প্রায় মুখস্থ ছিল, তার মতো একজন বড় কবি, ভালো কবি-মানুষ, বিনয়ী কবিব্যক্তি– আমি খুব কম দেখেছি। আমার মনে হয় তাঁর পরবর্তী বাংলা কবিতার ভালো-মন্দ তাঁর সৃষ্টির ওপর অনেকটা নির্ভর ছিল। ঢাকার কবিতাকে তিনি সাবালকত্ব দিয়েছিলেন, আধুনিকতার অনুষঙ্গ করেছিলেন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মিথের সফল ব্যবহার করেছিলেন। এমনকি তার ইসলামী মিথের ব্যবহার ছিল যথেষ্ট প্রাঞ্জল, দ্রষ্টব্য– ‘এক রাতে হযরত ওসমান’ কাব্যগ্রন্থ ‘অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই’। তিনি তাঁর কালে রাজনীতিক কবিতা এমনভাবে প্রকীর্ণ করেছিলেন– কাজী নজরুল ইসলাম পরবর্তীকালে তিনি অন্যতম প্রধান রূপাকার।
আল মাহমুদের কবিতাও আমি অনেক পড়েছি, অনিন্দ্য সুন্দর, তাঁর চেয়ে এত গুছিয়ে কবিতাকে এত প্রয়োজনীয়ভাবে আর কে-ই বা উপস্থাপন করতে পেয়েছেন– জীবনানন্দ-উত্তর, আধুনিক বাংলা কবিতার দশ আঙ্গুলের মধ্যে তিনি ধরা থাকবেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি কেন যেন তাঁর কাছ ঘেঁষতে চাইতাম না, বরং পারলে কিছুটা নিন্দামন্দ করতাম। কিন্তু দুএকজন এসে বলতো– ‘তিনি তো আপনাকে খুব পছন্দ করেন, তরুণদের মধ্যে পছন্দের কবির তালিকায় আমাকে এগিয়ে রাখেন।’ আমি ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ম্যাগসাইসাই পুরষ্কারের জুড়ি ছিলাম, একবার ভাবলাম তাকে মনোনয়ন দিবো, বাংলা সাহিত্যের এত বড় কবিপ্রতিভা তিনি– এখনো জীবিত। ফোন করলাম, এসব না বলেই, তিনি খুব আপ্লুত হলেন, প্রায় সারাদিন আমাকে সময় দিলেন। আমি বললাম, ‘মাহমুদ ভাই আপনার সবচেয়ে নিকৃষ্ট বই কোনটি?’ তিনি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন, বললেন, ‘তুমি কি পুরুষ সুন্দরের কথা বলছ?’ আমি বললাম, ‘ওটা তো একটা ফালতু বই– কেন যে এসব ছাইপাশ আপনি লেখেন!’ বললেন, ‘তুমি কোনটা বলছ?’ আমি বললাম ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’। তিনি আশ্চর্য হলেন, বললেন, ‘এটি শিবনারায়ণ রায় পছন্দ করেছেন, শক্তি চট্টোপাধ্যায় পছন্দ করেছেন।’ আমি বললাম– ‘আমার বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হলে, সেখানে মুসলমান সংখ্যালঘু হলে আমিও পছন্দ করতাম। কবির পরিপ্রেক্ষিত হিসাবে এই বইটি একপেশে, প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক।’ আমার যুক্তির এক পর্যায়ে তিনি মনে নিলেন, বললেন, ‘এমন করে তো ভাবিনি!’ এ নিয়ে আমার একটি লেখা আছে, ‘আল মাহমুদ ও বখতিয়ারের ঘোড়া’ তাঁর জীবদ্দশায় ছাপা হয়েছিল, তিনি তাঁর ফেসবুক আইডিতে শেয়ার করেছিলেন, ক্যাপশনে ছিল– ‘বাঁকা চোখে।’ তবু বলি তিনি কবি হিসাবে অনন্য!
কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের আড্ডায় মাঝে মাঝে গিয়েছি, খুব বেশি না। তখন আমি দৈনিক বাংলায় চাকরি করতাম, ফজল ভাইয়ের অফিস ছিল দৈনিক বাংলার ঠিক উল্টোদিকে, হারুন ডায়েরি, মানুষ হিসাবে খুব দিল খোলা ছিলেন। একবার তিনি দৈনিক বাংলায় আমায় ফোন করেন, একটি লেখার প্রশংসা করলেন, তার ওখানে যেতে বললেন, আমি শুরুতে তার কবিতা খুব একটা পছন্দ করতাম না। কিন্তু পরে তার শক্তি অনুভূত হয়েছে, বিশেষ করে প্রেম আবেগ সংরাগ রিরংসা– কবিতায় বেশ প্রকাশ করতে পারতেন। কিন্তু তার আড্ডার কথা বলার ধরন আমার খুব পছন্দ ছিল না, যদিও এটিই তার নিজস্ব ধরণ। কি যেন একটু বিষয় নিয়ে ভালো লাগলো না, আর কখনো যেতাম না, তার মৃত্যুর বছরখানেক আগে জাতীয় প্রেসক্লাবে দেখা হলো। খুব আন্তরিকভাবে হাত জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, ‘আমি তোমার পিতার বয়সী, আমি কি তোমার কাছে কোনো অপরাধ করেছি?’ আমি বললাম, ‘ফজল ভাই এমন কেন বলছেন’, তিনি বললেন, ‘তাহলে একবারের জন্যও আমার ওখানে আসো না কেন?’ আমার খুব কষ্ট হলো, তার কবিতার প্রতি হাহাকার একাকীত্ব আন্তরিকতা সবটাই আমি অনুভব করলাম। কিন্তু তারপরেরও তার কাছে যাওয়া হয়নি, তিনি মারা গেলে তার জানাজায় গিয়েছিলাম। ঢাকার কবিতার পরিবেশ পঞ্চাশ দশকের এই সব বড় কবিদের দ্বারা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল বলে আমার মনে হয়, যার মাসুল আমাদের দিতে হয়েছে, হচ্ছে। যেমন তৎকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতি পট পরিবর্তনে শামসুর রাহমানকে বিশেষভাবে একটি শ্রেণি দখল নিতে চাইতেন, আল মাহমুদকে জামায়াত শিবিরের পছন্দ ছিল, ফজল ভাইকে জাতীয় পার্টি কিংবা শামসুর রাহমান আল মাহমুদে ততো আস্থা ছিল না, অথচ একদিন তারা কাছাকাছি ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে কবিরা যা হারিয়েছে– তা হলো ঐক্য, একত্রে থাকার মানসিকতা।
কবি শহীদ কাদরী, আমি ঢাকাবাসী হওয়ার আগেই তিনি ছিলেন প্রবাসী। ফলে তার সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ১৯৯৪/৯৫ সালের দিকে সম্ভবত জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ নামে একটি প্রকাশনী সংস্থা তার কবিতা সমগ্র বের করে, আর তাঁর সমগ্র মানে তো সবেধন নীলমনি তিনটি কাব্যগ্রন্থ– ‘উত্তরাধিকার’, ‘তোমাকে অভিবাদন’, ‘অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই’। এই সময়ে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক কবি আল মুজাহিদী ভাইয়ের অনুরোধে শহীদ কাদরীর কবিতা নিয়ে লিখেছিলাম। অনেক দিন পরে তাকে নিয়ে লেখা ঢাকায় খুব প্রশংসীত হয়েছিল। নিশ্চয় তিনি তার সময়ে শামসুর রাহমান আল মাহমুদের পরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি। এদের দুজনের মতো নয়, আলাদা তাঁর স্মার্টনেস। পরে, মরার আগে প্রবাস জীবনে আরেকটি কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন, না লিখলেও হতো, এত দীর্ঘ সময় নিজেকে বিরত রাখার পরেও- এ যেনো মরার আগে ইমান হারানো।
আবদুল মান্নান সৈয়দ জন্মান্ধ মাতাল মানচিত্রের কবি, আদ্যপ্রান্ত নিমজ্জিত, লেখক হিসাবে সারাক্ষণ নিজেকে সজাগ ও সক্রিয় রাখা যার প্রবণতা। তিনি ষাট দশকের কিঞ্চিৎ নতুন কবিতার রচয়িতা, গদ্যের তিনি সমান সক্রিয়, নজরুল-জীবনানন্দসহ অনেকের ওপরে তিনি ইনটুডাক্টরি কাজ করেছেন, নিজে কবি হয়েও বাংলা সাহিত্যের অপরাপর কবিদের নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক জাত-পাত ছিল না, তিনিই ব্যতিক্রম– তার সময় পর্যন্ত তথাকথিত বাম-ডান সব পত্রিকায় সমানভাবে লেখালেখি করেছেন– প্রথম আলো থেকে সংগ্রাম, কোনো বাধা হয়ে থাকেনি। আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব ভালো ছিল, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসি, তখন থেকেই তার সঙ্গে বিভিন্ন সাহিত্য আসরে বক্তৃতাবাজি করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করি, তিনি প্রচুর প্রশংসা করতে পারতেন। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক খুব বেশি দিন ভালো যায়নি, তিনি সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না, কোনো একদিন দৈনিক বাংলায় তার গল্প নিয়ে কথা বলতে গিয়ে খারাপ সম্পর্কের সূচনা, এটি অনেকদিন ছিল, কিন্তু শেষের দিকে এসে আবার সম্পর্কটি জোড়া লেগেছিল, আমাকে খুব পাত্তা দিতেন, আমি উপস্থিত থাকলে সর্বদা আমার মতকে উল্লেখ করতেন। মান্নান সৈয়দ বাংলা সাহিত্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ ও পরিশ্রমী লেখক গদ্যে পদ্যে কথা সাহিত্যে তিনি ব্যতিক্রম।
সৈয়দ আলী আহসানের বাসায় দুএকবার গিয়েছি, তিনি আমাকে তার সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমার মাস্টার্স পরীক্ষার পরে, কিন্তু করা হয়নি, কবিতায় পাণ্ডিত্যে বাগ্মীতায় তিনি নিঃসন্দেহে সেরা ছিলেন। চল্লিশ দশকের বাংলা কবিতাকে তিনি এবং আহসান হাবীব, কিছুটা আবুল হোসেন মিলে আধুনিকতা ও যুগোপযোগিতা দান করেছিলেন। কাল পরিক্রমায় তিনিও অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু তার তুল্য লেখক বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি নেই।
৫. আপনি একাধারে একজন কবি–সম্পাদক–সাহিত্যবিশ্লেষক অর্থাৎ বহুমাত্রিক। আপনার অভিজ্ঞতা ও বিচরণ ক্ষেত্র ব্যাপক ও বর্ণিল। বিচিত্র। এই সামগ্রিক সত্তাকে কিভাবে দেখেন? কিভাবে উপভোগ করেন?
মজিদ মাহমুদ: এসব নিয়তি, এ সব আমি উপভোগ করি না, আমি একজন যন্ত্রণাক্লীষ্ট কবি, লেখক, একা এবং নিঃসঙ্গ, কারো চিন্তার সঙ্গে, কোনো মতবাদের সঙ্গে, কোনো সংঘ ও রাজনীতির সঙ্গে পরিণামে মিলতে পারি না, আমার একটি নিজস্ব চিন্তা, নিজস্ব ব্যাখ্যা সব সময় সবকিছুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, আমাকে একা করে দেয়। তাছাড়া আমি আমার সময়ে একজন মিসআন্ডারস্টুড লেখক, কেউ আমার দাবিও ছাড়ে না, নিন্দাও ছাড়ে না, সবাই তাদের নিজেদের মতো করে পুরোটা পেতে চায়, কিংবা আমার সক্রিয় তৎপরতা তাদের বিরক্ত করে। এতে আমার খুব কষ্ট হয়, কিন্তু আমার লেখক জীবন থেমে যায় না, আমি অনবরত লেখা নিয়ে ভাবি, আমার অতীত নিয়ে ভাবি, বর্তমান নিয়ে ভাবি, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি, আমার সময় নিয়ে ভাবি। কি আর এতে এসে যায়, লেখার মাধ্যমেই আমার অস্তিত্বকে অনুভব করি, আর ক্রোধ ও রাগগুলো ঝেড়ে ফেলি, আমার যন্ত্রণাগুলো প্রশমিত করি। আমি আমার প্রতিটি লেখায় নিজেকেই আবিষ্কার করি। ভাবি, এই যে পৃথিবীতে একটা জীবন পেয়েছিলাম, সেই জীবনে প্রকাশের ক্ষমতা, সেই প্রকাশটুকুই তো আমার কাজ। যখন নিজেকে অসহ্য মনে হয়, অপাংক্তেয় মনে হয়, তখন একটা মৃত লাশের ওপর বসে থাকি, আর তখনই আমার মুক্তি ঘটে– সব অর্থবহ হয়ে যায়। ভাবি, কে রাজাধিরাজ আর কে হরিপদ কেরানি! তাতে কিচ্ছু এসে যায় না, প্রকৃতির প্রতিদান ও প্রতিশোধ সবার জন্য দিনশেষে সমান, কিন্তু আমরা দেখতে পাই না। আমি জানি, আমার খ্যাতির চেয়ে প্রাপ্তি অনেক বেশি, সব প্রকৃতি আমায় দুহাতে দান করেছে, প্রতিভা যশ ও অর্থ, যা পেতে আমায় কারো কাছে হাত পাততে হয়নি, তৈল দান করতে হয়নি, আসলে আমি দেখেছি– আমি যা চাই, পাই তার চেয়ে অনেক বেশি। যখন কবিতা আসে না, তখন কথা সাহিত্যে নিজেকে আবিষ্কার করি, প্রবন্ধ গদ্যে নিজের চিন্তা তুলে ধরি, যখন কিছুই আসে না, তখন অনুবাদ করি। এই সব নিয়েই আমার লেখক সংসার, সবার সঙ্গে বসবাস করি বটে শরীরে, কিন্তু আমার লেখক জীবনের বসবাস অন্য কারো সাথে একা– সে অক্লান্ত চির যৌবনা, জীবনের সায়াহ্নে এসেও অনুভব করছি, তার শরীরে একটুও লাগেনি বয়সের ছাপ, সে নিত্য নতুন আইডিয়া নিয়ে, মিলনের স্বপ্ন নিয়ে আমায় কেবল প্রলুব্ধ করতে থাকে।
৬. আদি বাংলা তথা চর্যাপদ থেকে আজ অবধি বাংলা সাহিত্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে– আপনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণ?
মজিদ মাহমুদ: সাহিত্যের তো কোথাও দাঁড়ানোর দায় থাকে না, সে প্রবাহমান জীবনের মতো, মহাকালের ইশারালোকের মতো, মানুষের চিন্তার সমান্তরালে, যুগযন্ত্রণার সমান্তরালে, ভাষার সামর্থ্যরে ওপর ভর করে চলতে থাকে। একটি ভাষাগোষ্ঠী, একটি ভাষা জাতির মানুষ তা-ই– যা তার ভাষার সাহিত্য তাকে যেভাবে নির্মাণ করে। সাহিত্যে ধরা থাকে সেই জাতীর ইতিহাসের মানুষের লড়াই সংগ্রাম ধর্ম সংস্কৃতি খাদ্যাভাস সুখ-দুঃখ ও স্বপ্নযাত্রা। আমরা সাহিত্য ছাড়া আর কোনো মাধ্যমে অতীত পূর্বপুরুষের সঙ্গে এমন সজীব সংযোগ স্থাপন করতে পারি না। কারণ সাহিত্যে থাকে তার কাল, কালের মানুষের প্রেমাবেগ, বাৎসল্য, রীরংসা, শাসক ও শোষিতের সম্পর্ক, ব্যক্তি ও সমাজের নানা মনস্তত্ত্ব। চর্যাপদের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, এক সময়ে এ জনপদে বৌদ্ধ ধর্মের আধিক্য ছিল, বৌদ্ধ-সিদ্ধাচার্যগণের ধর্মাচরণ, গুঢ় রহস্যময়তা, রীতিনীতি– এই সময়ের সাহিত্যে প্রকটিত হয়েছে। আমরা জানতে পারি– সে সময়ের মানুষের জীবিকার উপায়– নৌকা বাওয়া, মদ চোলাই, তুলো ধোনা, দই তৈরি, ব্রাহ্মণ ও শূদ্রদের পরনারী গমন। কিন্তু এই সাহিত্যের কথা তো আমরা জানতাম না, রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়া অব্দি জানতে পারেননি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় নেপাল থেকে প্রাপ্ত পুঁথির আলোকে ১৯১৬ সালে বই প্রকাশ করলে এ সম্বন্ধে আমরা জানতে পারি। সুতরাং সেদিক থেকে বিচার করতে গেলে, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগে সাহিত্য হিসাবে চর্যার সরাসরি কোনো প্রভাব নেই, যা আছে ভাষা নির্মাণে, ভাষার ইতিহাসে এবং প্রচ্ছন্ন চিৎপ্রকর্ষে। তবে সে যাই হোক, বাঙলা সাহিত্যের যাত্রা থেমে নেই, সেই থেকে অব্যাহত এগিয়ে চলেছে, মধ্যযুগের সাহিত্য ধর্মাশ্রয়ী হওয়া সত্ত্বেও অনেক বেশি অসাম্প্রদায়িক ছিল, যেমন মঙ্গলকাব্যের কবি, হিন্দু ধর্মের দেবদবতা নিয়ে লিখতে গিয়েও মনসামঙ্গলের কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ বেহুলার নিশ্চিদ্র বাসর ঘরে অনেক কিছুর সঙ্গে একটি কোরান শরীফও রেখেছিলেন– যাতে লখিন্দর কোনো ছুতোয় বেঁচে যেতে পারেন। তেমননি ইউছুফ জুলেখার কবি শাহ মুহম্মদ ছগির বর্ণনা করেছিলেন, হারানো পুত্র ইউছুফকে ফিরে পাওয়ার জন্য ইয়াকুব নবী প্রয়োজনে অন্য ধর্ম গ্রহণ করতেও রাজি আছেন; কারণ পিতার হৃদয়ের কাছে কোনো কিছু পুত্রের তুল্য নয়। আধুনিক সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ বটে, কিন্তু আধুনিক মন সরল নয়। মাইকেল থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ নজরুল জীবনানন্দ দাশ হয়ে বাংলা সাহিত্যে যে বিপুল সম্ভার সৃষ্টি করেছে তা বিষ্ময়কর। অনেকের দৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্য বর্তমানে ক্ষযীষ্ণুতায় আক্রান্ত, কিন্তু আমার মনে হয় না, পরিবর্তিত সময়ের মধ্যে ঠিকই সাহিত্যের নানা শাখা এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হয়, সাহিত্য তার কালের সৃষ্টি।
৭. সাম্প্রতিক বাংলাদেশে, শিল্প-সাহিত্যচর্চায় কোন-কোন চ্যালেঞ্জ বা সুবিধা-অসুবিধা আছে বলে আপনার মনে হয়? কীভাবে এগুলি মোকাবিলা করেন?
মজিদ মাহমুদ: জীবনের অনেক জটিলতা বেড়েছে, সাহিত্য ভাষার অনুষঙ্গ ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হয়েছে, যেসব বিষয় রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ জসীমউদ্দিন বা আমাদের সময় পর্যন্ত কবিতা লেখার উপজীব্য ছিল– তা প্রায় তিরোহিত হয়ে যাচ্ছে। বিশ শতক পর্যন্ত কবিরা ছিলেন অনেক বেশি ভূমিজ, দেশ ও জাতীয়তাবাদে সীমাবদ্ধ, পাঠক এবং লেখকের মনস্তত্ত্ব প্রায় একই সরল রেখায় উপস্থিত ছিল। আমরা লিখতে শুরু করেছিলাম কলমে, স্পর্শে, চিঠি আদান প্রদান, অজানার অপেক্ষা, সাহিত্য সম্পাদক নির্ভরতা ও ছাপা বইয়ের উপর নির্ভরশীলতা। কিন্তু আমাদের লেখক জীবনের মধ্যপর্বে এসে সে সবের আমূল পরিবর্তন হয়েছে, আগের বিশ্বাস ও ধারণা দিয়ে তেমন করে বর্তমানকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাছাড়া রাজনীতি সমাজনীতি ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের নীতিগত অবস্থান এখন আর নেই। মাত্র কয়েক দশক আগেও বিশ্বে সমলিঙ্গে বিয়ের কথা কল্পনা করা যেতো না, নিন্দা করা যেতো, ম্যাক্সিম গোর্কিসহ অনেকে নিন্দা করেছিলেন, এখন বললে লেখক হিসাবে খারিজ। তাছাড়া সারোগেট মাদার, সিমেন ডোনার, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রাদুর্ভাব– এ সবের সঙ্গে আমার নিজের সাহিত্যের প্রথম পর্বে পরিচয় ছিল না। তাছাড়া উন্নত অবজার্ভেটরি ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী স্বৈরশাসকদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে– যা আগের কোনো রাজনৈতি থিওরি দ্বারা ব্যাখা করা প্রায় দুরূহ। ভাষার নৃতত্ত্বের অনেক পরিবর্তন আসছে, যৌথ পরিবারেরই কেবল অবসান হয়নি, চাচা মামা কিংবা তুতো সম্পর্কগুলোর হয়েছে অনেক পরিবর্তন। করোনাকালে আমাদের বিশ্বাস ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর স্থায়ী পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এ সময়ে ধনীরা অনেক বেশি ধনী হয়েছে– কেবল ভার্চুয়াল ওয়েবলেন্থের ব্যবসার দ্বারা ডাটা উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অতি গরীবরা সব জায়গা থেকে ছিটকে পড়ছে, সামাজিক মিডিয়ার নির্বোধ তৎপরতার ফলে তারা আরো আড়াল হয়ে যাচ্ছে। বলা চলে, আজ যে কোনো ভালা কবিতার আয়ুষ্কাল বড়োজোর কয়েক ঘন্টা, কারণ যে কোনো নতুন আইডিয়া নতুন ধরনের লেখা সামাজিক মিডিয়ায় শেয়ার করা হলে অমনি ওটা বহু হাতে ব্যবহৃত ব্যবহৃত হয়ে হয়ে শুয়োরের মাংস হয়ে যায়। আমার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়তো বেশি ছিল, কারণ আমি এক গোপন বুলিংয়ের শিকার ছিলাম আমার সময়ে– পুরো লেখক জীবনে। কিন্তু আমি সর্বদা এসব ভেবেছি, আর লিখেছি, কিন্তু সব চ্যালেঞ্জ কি আর মোকাবেলা করতে পেরেছি, অনেক কান্না রক্তক্ষরণে হারিয়ে গেছে, আর পাঁচজনের মতো আমি কালের গর্ভে নিমজ্জিত হতে হতে ভেসে উঠি, আবার ডুবে যায়। আমি সর্বদা সমস্যাকে সুবিধায় পরিণত করার চেষ্টা করেছি। আমার জন্য আমার লেখা ছাড়া কিছুই অপরিহার্য ছিল না। আমি শুধু একটাই বুঝেছি, বন্ধুহীনতা, অবজ্ঞা মিডিয়ার বৈরি আচরণ একজন লেখককে পুরো থামিয়ে দিতে পারে না। কারণ লেখকের কিছু বলার থাকে, সে নিজের সাথেও বলতে পারে।
৮. এ যাবৎ সর্বমোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
মজিদ মাহমুদ: এখন পর্যন্ত ৬০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার বই হিসাবে ‘মাহফুজামঙ্গল’ই প্রথম বলা যায়, ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয়, কিন্তু তার আগেও আমার অন্তত গোটা দুই বই প্রকাশিত হয়েছিল– কিশোর কবিতার বই ‘বৌটুবানী ফুলের দেশে’ এবং গল্পের বই ‘মাকড়সা ও রজনীগন্ধা’ ১৯৮৫ ও ১৯৮৬ সালে, তখন আমার বয়স ১৬/১৭ এর কোটায়। বই বের করা আমার জন্য সর্বদায় উত্তেজক, বিশেষ করে প্রথম দিককার বই প্রকাশের আগে তো অনেক রাত ঘুমাতেই পারতাম না, আমরা তো শুরু করেছিলাম লেটার প্রেস থেকে, কাঠের ব্লক খোদাই করে প্রচ্ছদ ছাপা হতো। আমার বহুল পরিচিত ও পঠিত কাব্যগ্রন্থ, যা ইতোমধ্যে বিশটির অধিক সংস্করণ হয়েছে– সেই ‘মাহফুজামঙ্গল’ প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘পাবনা বুলবুল আর্ট প্রেস’ থেকে, আর এর প্রচ্ছদ ছাপা হয়েছিল কুষ্টিয়ার ‘লিয়াকত প্রেস’ থেকে। এই বইটি প্রকাশের আগে কবিবন্ধুদের অনেকে আমাকে বলেছিল, এর জন্য আমাকে দেশ ছাড়তে হবে। বইটি লিখেছিলাম মাত্র মাস খানেক সময়ের মধ্যে, এতটাই আবেগাক্রান্ত ছিলাম, হাটে ঘাটে মাঠে বন্ধুদের পড়ে শোনাচ্ছিলাম। এটি ভেবে আশ্চর্য হই, প্রায় তিন যুগ ছত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো বইটির প্রতি পাঠকের সমান আগ্রহ রয়েছে, নবীন পাঠকগণ প্রায়ই ভুল করেন বইটি মনে হয়– তাদের কালে লিখিত হয়েছে। বইটি পরবর্তী বাংলা কবিতার ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে, এই কবিতার ধারার মধ্যে অনেকে যেতে প্রলুব্ধ হয়েছেন। আপনি দেখতে পারেন– ফরহাদ মাজহারের ‘এবাদতনামা’ এই কবিতার বাইরে নয়। এমনকি নামকরণের ক্ষেত্রেও কবি কথাসাহিত্যিক এই বইয়ের নাম ও বিখ্যাত কবিতাবলীর প্রতি প্রলুব্ধ হয়েছেন, এটি অবশ্য হতেই পারে, হওয়াই উচিত, পূর্ববর্তী ভালো সাহিত্য পরবর্তীকালের ভালো সাহিত্যকে পথনির্দেশনা দেয়। নিশ্চয় আপনি আমার কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে ‘বল উপাখ্যান’, ‘আপেল কাহিনি’, ‘ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম’সহ বেশ কিছু বইকে বিষয় ও শৈলীর কারণে এগিয়ে রাখতে পারেন। এছাড়া প্রবন্ধে– ‘সাহিত্যচিন্তা ও বিকল্পভাবনা’, ‘সাহিত্যে সমাজ ও রাজনৈতিক দর্শন’ ‘ক্ষণচিন্তা’ ‘নজরুল তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র’ পূর্ববর্তী কোনো চিন্তা ও সাহিত্যকর্মের সম্প্রসারণ নয়। সম্প্রতি আমার একটি উপন্যাস ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ আমেররিকার এক প্রেস্টিজিয়াস পাবলিশার্সের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, এ বছরেই এটি বিশ্ব বইবাজারে আসার কথা। এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশি বাঙালি সাহিত্য স্রষ্টা ও পাঠকের জন্য বড় খবর। তাছাড়া নজরুল জীবনভিত্তিক উপন্যাস, ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ আশা করা যায় আপনার যে কোনো পূর্বপাঠকে চ্যালেঞ্জ করবে।
৯. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
মজিদ মাহমুদ: সাহিত্যের মতো একটি সমবায়ী বিষয় তো সরাসরি কারো উত্তরাধিকার হয় না। আপনি অনেক কিছু পঠনের মধ্য দিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু আমাদের মনে সে-সবই হয়তো উদ্দীপনা তৈরি করে– যা নিজস্ব প্রবণতার সঙ্গে মিলে যায়। আমি খুব শৈশব থেকে পাঠক ও লেখক হয়ে উঠেছিলাম, ফলে আমাদের সময়ের ৫০, ৬০ বা তার পরবর্তী দশকের কবিতা আমার সাহিত্যের উত্তরাধিকারে তেমন কাজে লাগেনি, একেবারে লাগেনি তা হয়তো বলা যাবে না। আমি যখন আশির দশকে ‘মাহফুজামঙ্গল’ লিখছি– তখনো শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ পড়া হয়ে ওঠেনি, তখন আমি মফস্বলে থাকি। কিন্তু বাড়িতে কিছু বই-পুস্তক থাকায় মাইকেল রবীন্দ্র নজরুল জসীমউদ্দীন, কিছুটা জীবনানন্দ দাশ ও ক্ল্যাসিক ঔপন্যাসিকগণ আমাকে ভাবাতে সহায়তা করেছে, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, বিষাদসিন্ধু, আরব্য উপন্যাস– আমার প্রাথমিক বিদ্যালয় জীবনেই কবি করে তুলেছে। গ্রাম হলেও এই বইগুলো আমাদের বাড়িতে ছিল, আরেকটি বইয়ের কথা বলতে হয়– ম্যাক্সিমগোর্কির ‘আমার ছেলেবেলা’র লেক্সেই আমার সাথে সাথেই ছিল। সেই সঙ্গে বাড়িতে রুমি হাফিজ খৈয়াম– এ ধরনের সুফি মুসলিম কবিদের কথা শুনে নিজের মধ্যে কবি হওয়ার বাসনা জেগেছিল। তবে অনেক পরে এসে আমি আবিষ্কার করেছি– তিনটি বইয়ের প্রভাব আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি– ‘সোনার তরী’ ‘আরব্য উপন্যাস’ ও ম্যাক্সিগোর্কির ‘আমার ছেলেবেলা।’
১০. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
মজিদ মাহমুদ: বই আকারে প্রকাশিত সর্বশেষ নজরুল জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ এ বছর বইমেলায় কথা প্রকাশ নিয়ে এসেছে। এটি কেবল একটি জীবন-ভিত্তিক উপন্যাস নয়, প্রামাণ্য জীবনী গ্রন্থও বটে। পরিচিত তথ্যের বাইরেও চরিত্রসমূহের সজীব উপস্থিতির মাধ্যমে এমন সব প্রমাণাদি এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে– যা উপেক্ষা করা অসম্ভব। বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে পাঠকের যে কোনো আগ্রহ, পূর্ব-অভিজ্ঞতা ও পঠন–- এই গ্রন্থের বয়ান ও শৈলির দ্বারা নিরসন হওয়ার দাবি রাখে।
বিশ শতকের মহাবিদ্রোহী, ধূমকেতুর মতো আকস্মিক আগমন, তাঁর বাণীর আঘাতে কেঁপে উঠলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, কবিতায় গানে– অসহায় মানুষের মুখে দিলেন ভাষা, জাত-ধর্ম নির্বিশেষে চাইলেন বৈষম্যহীন মুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কি এমন ঘটলো– অদৃশ্যের ইঙ্গিতে মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে হয়ে গেলেন নির্বাক, জীবনের বাকি চৌত্রিশ বছর কইলেন না কথা। তাঁর শারীরিক স্বাস্থ্য ছিল অটুট, ছিল না অসংলগ্নতা, কৌতূহলী শিশুর মতো সব দেখছেন, অনুভব করছেন– পালন করছেন নীরবতা। বন্ধুরা দেখতে আসছেন, ভক্তরা আসছেন, অসুস্থ স্ত্রীর পাশে অনুগত বসে থাকছেন, কখনো চোখেমুখে দুষ্টমির ঝিলিক। কেউ বলছেন– যোগভ্রষ্ট, কেউ বলছেন মৌন-সাধক– বৃহত্তর কিছুর সন্ধানে করছেন মানস-ভ্রমণ। অবসান হলো যার চির-প্রয়াণে। স্বজন-বর্জিত প্রিয়তমা শুয়ে আছেন– চুরুলিয়ার শ্বশুরালয়ে, তিন পুত্র আগেই প্রয়াত, এখনো শুনতে পান– বুলবুলের কণ্ঠস্বর, কৃষ্ণ-মুহম্মদ বেঁচে ছিলেন মাত্র কয়েক মাস, গিটার-বাদক অনিরুদ্ধ মারা গেলেন তাঁর মৃত্যুর বছর দুই আগে– পিতাপুত্রের বসবাস তখন ভিন্ন ভূগোলে। একমাত্র জীবিত পুত্র থাকেন ভগ্ন-বাংলার প্রাদেশিক রাজধানীর ক্রিস্টোফার রোডে। তিনিও পারলেন না দিতে– পিতার কবরে একমুঠো মাটি। বিলম্বিত বিমানের যাত্রা শেষে তিনি পৌঁছালেন– মসজিদের পাশে পিতার কবরে, সুনসান অন্ধকার, সদ্য-সমাহিত কবরের মাটি স্পর্শ করতেই অসহায় পিতার বিদেহী আত্মা কেঁদে উঠলো, চৌত্রিশ বছরের নীরবতা ভেঙে পুত্রের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন, একে একে বলতে লাগলেন– কি ঘটেছিল তাঁর জীবনপর্বে…
বইটি ইতোমধ্যে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, প্রকাশকের বিক্রিপাট্টাও হচ্ছে শুনেছি।
১১. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?
মজিদ মাহমুদ: আমি আসলে কোনো দশকের কবি নই, আশির দশকে লিখতে শুরু করি, ১৯৮৯ সালে মাহফুজামঙ্গল বের হয়, তখনো আমি মফস্বলে, কিন্তু ঢাকায় এসে দেখলাম, আশির দশক ভাগাভাগি করে নিয়ে গেছে নগরের কবিরা– আমরা অনেকটাই তখন অপাংক্তেয়, আমাদের নাম পিছনের সারি হয়ে গেছে, আর অলস সমালোচকগণ সে-সব দেখে নকল নবিশি করে যাচ্ছে। এতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি, আমার প্রবল সক্রিয়তা আমাকে সর্বদা ভাসিয়ে রেখেছে। তবে আশির দশকের কবি লেখক বলাই সমীচীন, আর অন্যরা তা বলছেও, আমিও তা মনে করি। কিন্তু আমার প্রশ্ন একজন কবি সাহিত্যিকের জন্য দশক লাগবে কেন, তাকে তো তার প্রথম বইয়ের প্রকাশের সাল দিয়েই চিহ্নিত করা যায়। একজন লেখক দশকের শুরুতে বই করলো আর একজন শেষে, প্রথমজন অনেক দিন উল্লিখিত হয়ে থাকবে, শেষজন অধিকাংশ সময়ে বাইরে থাকবে। এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়, দশকের সবচেয়ে শক্তিশালী কবিটি হয়তো দশকের বাইরে থেকে যাচ্ছে, বিশেষ করে সংকলনগুলোতে অনুপস্থিত। আবার দশকের কিছু ইঁচড়েপাকা কবি থাকে যারা শুরুতেই কিছু একটা সংকলন করে বা অহেতুক হৈচৈ করতে চায়, নিজের লেখার প্রস্তুতিটা বাদ দিয়ে। এ সব দোষ আমাদের মধ্যেও ছিল, তরুণদের মধ্যে থাকা অস্বাভাবিক নয়। এসব সংঘবদ্ধতার ফলে, স্বগোত্রীয়দের সঙ্গে গাঁটবেঁধে থাকার কারণে প্রতিভা থাকার ফলে অনেকেরই আর কবি হওয়া হয় না।
১২. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।
মজিদ মাহমুদ: আমরা কেবল আমাদের সময়েই বাস করতে পারি, আগে বা পরের সময় আমাদের নয়, আগের বা পরের সময় আমাদের জন্য হতে পারে ইউটোপিয়া বা ডিসটোপিয়া, আমরা কেবল স্বপ্ন ও সম্ভবনায় সেখানে থাকতে পারি। আগের বা পরের সময় বলে যে গল্প আমরা জানি বা জানানো হয়– তা মূলতই সাহিত্য কবিতা গল্প উপন্যাস– যা ইতিহাস আকারে আমাদের কাছে হাজির থাকে, যা সত্য মিথ্যা হওয়ার দায় আমাদের বহন না করলেও চলে; কিন্তু তার পরেও আমরা মানুষেরা অতীতকালে বসবাস করতে ভালোবাসি। আমার সময়টি ভালো বা মন্দ সেটি নিয়ে আমি খুব ভাবিত নই, কারণ বেঁচে থাকার লড়াই, টিকে থাকার লড়াইয়ের মধ্যে জীবনের যে টানটান উত্তেজনা থাকে, সহজ জীবনের মধ্যে তা থাকে না, একটি মাছি বা মশা মাত্র ১৫ দিনের জীবন চক্রে যেভাবে নিজেকে টিকে রাখে, বুদ্ধিমান প্রাণীর রক্ত চুষে বেঁচে থাকে– তার সবটিই জীবন। তবে প্রকৃতপক্ষে আমার সময়টি ছিল– খুবই উত্তেজনাপূর্ণ, একটি জাতির জীবনমরণ সন্ধিক্ষণে আমার জন্ম, আমরা যুদ্ধ দেখেছি, মন্বন্তর দেখেছি, শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন, গণতন্ত্র, যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা ধরে থাকা, সামরিক স্বৈরতন্ত্র দেখেছি, জাতির পিতার সপরিবারে হত্যাকাণ্ড দেখেছি। একই সঙ্গে লেখক সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের বিবেক বিক্রয়, রাষ্ট্র ও সংঘের মুখপাত্র হয়ে ওঠা, পরস্পরের বিরুদ্ধে কাাদা ছোড়াছুড়ি, মিথ্যা চরিত্র হরণ– সামগ্রিকভাবে তারা কেন্দ্রহীন দিশাহারা, তারা একই সঙ্গে ধর্ম ও জিরাফে, নীতি অনীতি– ততোটাই সত্য যতটা– তার বিক্রয় মূল্য থাকছে। তার মানে এই নয়, আমাদের সময়ের সবাই এমন, মোটেও নয়, কিন্তু সেটি এতই ছোট অংশ, প্রান্তিক, চিটার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। তবু এ সময় পর্বে আমরা অনেক পরিবর্তন দেখেছি, বিশেষ করে মানুষের ভোগ্যপণ্যের ব্যাপক উন্নয়ন, বৈষয়িক উন্নতি, কাঠামোগত উন্নতি, প্রযুক্তির উন্নতি– সবই এই অর্ধশতাব্দির মধ্যে সাধিত হয়েছে। আমাদের সময়টি হলো যুগ-সন্ধিক্ষণের, আমরা কৃষিযুগ ও ন্যানোযুগ উভয়ের মাঝখানে। সে অর্থে আমাদের সময়টিই শ্রেষ্ঠ– এ সময়ে জন্ম গ্রহণ না করলে আমাদের জীবনের ‘সঙ্ঘারাম’ এতটা রঙিন হতো না। আমাদের সময়টিই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং নিকৃষ্ঠ, উজ্জ্বল আলোকিত এবং নিকষকালো, আমরা দেখেছি ক্ষুধা মন্বন্তর ও প্রাচুর্য, মানুষের সম্পর্কের গিঁট ও বিচ্ছিন্নতা। লেখক সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা ছিল পুরনো দালানের খসে পড়া ইটের মতো, বুদ্ধি ও চেতনায় জং ধরা, দলকানা, ধর্ম ও সংঘকানা। আশা করি, নিশ্চয় এ সময়টি আরো ভালো সময়ের মধ্যে প্রবিষ্ট হবে।
১৩. আপনি কবিতায় মিথ, ধর্ম ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করা বিষয়ে কি ভাবেন? বিশেষত ইসলামিক বিষয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি ব্যবহার করা বিষয়ে।
মজিদ মাহমুদ: আমার জগত মিথের জগত। মিথের খড়কুটো দিয়ে আমার কবিতার শরীর নির্মিত। মিথকে আমি পার্থক্য করি না, ইসলামি মিথ সেমেটিক মিথ প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মিথ– আমার কবিতায় প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ আকারে প্রয়োজন মতো এসেছে। মিথের ভাষা হলো মানব জাতির পরীক্ষিত ভাষা, এ ভাষা অনেকদিন ধরে টিকে আছে, এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে পরিভ্রমণ করেছে, মানব জাতির ইতিহাস সংগ্রাম ধারণ করেছে, সুতরাং মিথ কবিতার জন্য উপযোগী ভাষাশৈলি। মিথ কেবল একটি শব্দ বা বস্তু প্রতীক নয়, মিথ পরিপ্রেক্ষিতের ভেতর দিয়ে যায়। আবার মিথ কখনো মৌলিক বা অপরিবর্তিত বা অবিকৃত কিছু নয়, মিথ পরিবর্তন হতে হতে নূতন কালে নূতন কবির কাছে নূতন অর্থ নিয়ে ধরা দেয়। তার একাকীত্ব সংগ্রাম ও স্বপ্নযাত্রা মিথের চরিত্রের মধ্যে আবিষ্কার করে। ইসলামি মিথ ব্যবহারে তো কোনো বাধা নেই, কিন্তু খাঁটি ইসলাম ধর্ম আকারে মিথকে স্বীকৃতি দেয় না। আবার আরবীয় মিথকে আমরা ইসলামি মিথ বললেও তার অনেকটা প্রাক-ইসলামি যুগ থেকে আহরিত। অতএব মিথের পার্থক্য না করাই ভালো, তাছাড়া যাকে আমরা ইসলামি মিথ বলি– তারও একটি অন্যরকম অতীত আছে। আমি সব ধরনের মিথ ব্যবহার করি, ইসলামি মিথ ছাড়া যেমন আমার কবিতা অচল, তেমনি ভারতীয় মিথ ছাড়াও। তবে আমার পূর্ববর্তীদের তুলনায় আমার কবিতায় মিথ ব্যবহার কিঞ্চিৎ আলাদা, আমি অধিকাংশ সময় মিথকে তার পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে ধরে রাখতে চাইনি। তাই মিথের অর্থ না জেনেও আমার কবিতা পাঠে বাধা থাকে না।
১৪. আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা বলতে আপনি কি বোঝেন? বাংলাদেশের কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
মজিদ মাহমুদ: এ সব নিয়ে আমার কিছু লেখালেখি আছে, উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য বলে আমার একটি প্রবন্ধগ্রন্থ আছে। এর একটা বাস্তবতা আছে, আধুনিকতাকে যদি আমরা একটা সময়পর্ব হিসাবে ধরি, তাহলে তার শেষ আছে, আবার যদি একটি থিওরি হিসাবে ধরি তাহলে তারো সীাবদ্ধতা আছে। কিন্তু এসবের সূক্ষ্ম পার্থক্য সম্ভব নয়, পূর্বকার অনেক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বর্তমান দাঁড়িয়ে থাকে, আবার বর্তমানের অনেক বৈশিষ্ট্য ভবিষ্যতের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিলীন হয়। একদিন ব্রিটিশ ঔপনিবেশ এ দেশ শাসন করতো, সারা পৃথিবী ছিল উপনিবেশ, এখন আগের নিয়মে উপনিবেশ নেই এটা সত্য, কিন্তু ঔপনিবেশিক বৈশিষ্ট্য নেই তা বলা যাবে না। শুরু হয়েছে নতুন করে ইউরোপ আমেরিকার ‘ডাটা-উপনিবেশ’, নিউ মর্ডানিজম, নিউকলোনালিজম, নিজের দেশের টাকা অন্য দেশে চলে যাচ্ছে ট্যাক্সহ্যাভেনের দোহাই দিয়ে, নিরাপদ আবাসের নামে, এর কোনো কিছুকেই সরল মনে ব্যাখ্যা করার উপায় নেই। তবু এসবের পার্থক্য ও উৎপত্তির ফলে বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে ভাববার অবসর তৈরি হয়।
১৫. আপনার লেখালেখিতে দেশি-বিদেশি কবি/ সাহিত্যিকদের কারো কোন প্রভাব কি আছে?
মজিদ মাহমুদ: প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকার আসলে কোনো সুযোগ নেই, কারণ আমার বিদেশি সাহিত্য পড়া শুরু হয়েছে, বেশ বয়সকালে, কবি হয়ে ওঠার বেশ পরে। তবু বলেছি প্রথমেই, ম্যাক্সিম গোর্কি, আরব্য উপন্যাস– এসবও তো বিদেশি– সেদিক থেকে বিদেশি প্রভাব তো আছে, রুশ অনুবাদ সাহিত্য, পরবর্তীকালে এলিয়ট ইয়েটস জিবরান হোসে সারামাগো আমারে কিছুটা প্রভাবিত করে থাকতে পারে। আর দেশের ক্ষেত্র আগেই উল্লেখ করেছি, তবে আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র আমার ওপরে বেশি ভর করেছে– আমার সাহিত্যিক মানস গঠনে তাঁরা ভূমিকা রেখেছেন। অনেকে জানতে চান, নজরুলের কথা, না, নজরুল আমার কাছে বেশ পরে এসেছে, দার্শনিক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, কবি হিসাবে তিনি আমার ওপর আছর করতে পারেননি। আর আমার কবিতায় জীবনানন্দের অস্তিত্ব নেই বলাই চলে। তবে চলতি বছরে আমার একটি কবিতার বই বেরিয়েছে– ‘আনন্দিনী রায়নন্দিনী’ বইটিতে সচেতনভাবে কিছুটা জীবনানন্দ ঢুকিয়েছি।
১৬. কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
মজিদ মাহমুদ: ঢাকায় থাকি। পাবনাতেও থাকি। পাবনা আমার জন্মস্থানে গ্রামীণ শিক্ষা স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কিছু কাজ করছি। চরনিকেতন বলে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় ব্যস্ত আছি। আগে শিক্ষকতা সাংবাদিকতা করেছি। স্ত্রী ফৌজিয়া আকতার বর্তমানে একটি সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। মেয়ে সানোয়ারা প্রপা বাংলাদেশ মেডিকেল থেকে পাস করলো। ছেলে ইমামুল মুরসালিন কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষবর্ষে বিজনেস স্টাডিজ পড়ছে।
১৭. আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
মজিদ মাহমুদ: আমি ‘পর্ব’ নামে একটি লিটলম্যাগ সম্পাদনা করেছি কয়েক বছর, তবে এখন কয়েক বছর বেরুচ্ছে না। কিছু অপরিণত সংকলন আমার হাতে প্রকাশিত হয়েছিল, এসব ধর্তব্যের নয়, কখনো নিজের ইচ্ছে ও যোগ্যতার বাইরে অন্যের ইচ্ছে এবং নিজের অপূর্ণ খায়েস মেটানোর জন্য সাহিত্য পত্রিকা ও সংকলন উল্লেখ্য কিছু নয়। তবে ‘বৃক্ষ ভালোবাসার কবিতা’ নামে একটি সংকলন দীর্ঘদিন খেটেখুটে করেছিলাম, এখন বাজারে পাওয়া যায় না, এছাড়া আমার বন্ধু সহপাঠী জামরুল হাসান বেগ, যিনি ঢাবি’র বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেছিলেন, ১৯৯৮ সালে তার অকাল প্রয়াণে তাকে নিয়ে একটি স্মারক গ্রন্থ করেছিলাম, ‘জামরুল হাসান বেগ স্মারকগ্রন্থ’। ‘আশির দশকরের কবি ও কবিতা’ নামে একটি সংকলন করেছিলাম, খুবই অপরিণত ও অপরিপক্ক সংকলন। কারণ, আশির দশক শেষ না হতেই অন্যেদের প্ররোচনায় কাজটি করেছিলাম, সংকলনটি আবারো নতুন করে করার কথা ভাবি, কিন্তু সময় করতে পারি না, আবার প্রয়োজনীয় মনে করি না।
১৮. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
মজিদ মাহমুদ: সংজ্ঞা তো বলতে পারবো না, এসব তো আর্বাচীন কালের সৃষ্টি, লিটলম্যাগ কেবলই একটা মিডিয়া, তার সম্পাদকগণ যা দাবি করে তার চরিত্রের সঙ্গে প্রায়ই তার মিল থাকে না। আমাদের এখানে লিটলম্যাগ যেমন ভাগাভাগি করেছে, চুলাচুলি করেছে, সম্পাদকগণের আত্মপ্রচারে মগ্ন হয়েছে– তা আর কোনো মিডিয়ায় কমই হয়েছে। করছে লিটলম্যাগ– প্রথাবিরোধী, অথচ প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলছে, আবার সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করছে, রাবিশ। লিটলম্যাগ করছেন হাজার পৃষ্ঠার, শত শত বিজ্ঞাপন ছাপছেন, বুড়োগুড়ো সবারই লেখা ছাপছেন– আবার বলছেন লিটলম্যাগ। লিটলম্যাগ এবং বড় কাগজের সাহিত্যগিরি একই সঙ্গে করছেন, আবার সে নামেই প্রকাশনীসংস্থা খুলে বসেছেন, অন্যের টাকায় বই করছেন, আবার বলছেন প্রথা বিরোধী– এসব কেবলই বোগাস। এসব ছোট ছোট নীতিবাদিতার ফসল। আর যা আছে তা হলো ব্যক্তির প্রবণতা, লেখকের দায়, সেসব লেখক সব স্থান থেকেই করতে পারে। দৈনিক পত্রিকার মালিক সম্পাদক সমিতির মতো লিটলম্যাগেরও মালিক সমিতি গঠন হয়েছে, তারাই নির্ধারণ করবে কে লিটলম্যাগ করতে পারবে, আর কে পারবে না! চর দখল, জমি দখলের লড়াই দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। লিটলম্যাগ আঁকড়ে থাকা কবি লেখকরা কেন যেন বড় হতে চায় না, শিশু শিশু ভাব, ষাট বছর বয়সেও তারা প্রতিষ্ঠানের বুড়োদের হাতে তাদের সম্পাদিত পত্রিকা তুলে দিয়ে প্রীত বোধ করে, শিশু শিশু ভাব করে, লিটলম্যাগ বিরোধী লোকজন নিয়ে এসে প্রকাশনা উৎসব করে, এসব কিসের লক্ষণ!
১৯. অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
মজিদ মাহমুদ: কবি সাহিত্যিকগণ নিজের রচনা প্রচারের জন্য অনেক ধরনের মাধ্যম ব্যবহার করেন, বই প্রকাশও একটি মাধ্যম। এক সময় তো লিটলম্যাগ ছিল না, ওয়েবম্যাগ তো এক যুগও ভালোভাবে পার করেনি। কিন্তু মানুষ কবিতা সাহিত্য রচনা করে চলেছে হাজার হাজার বছর ধরে, সে-সব রচনার অনেকটা আমরা এখনো পড়ে থাকি, হয়তো আরো অনেকদিন তা পঠিত হবে। তখন লিটলম্যাগ বা ওয়েবম্যাগের দায়িত্ব পালন করতো ওরাল ট্র্যাডিশন। কবি কিংবা ভক্তরা শ্রোতাদের সামনে তা পড়ে শোনাতো, আমি একই সঙ্গে ওরাল ট্রাডিশনের প্রোডাক্ট, পুঁথি শুনে কবিতা শুনে গল্প শুনে আর শিশুমানস গড়ে উঠেছিল। লিটলম্যাগ চর্চার ক্ষেত্রে তত্ত্ব ও বাস্তবতা এক হয়ে থাকেনি। লিটলম্যাগকে যতই মাহাত্ম্য দান করা হোক না কেন, অধিকাংশ এ দেশে যারা লিটলম্যাগ করেছে– তারাই আবার বড় পত্রিকার লেজুড়বৃত্তি করেছে, এখনো তাদেরই দৌরাত্ম্য। এখন অনলাইন ম্যাগাজিন, ওয়েবম্যাগাজিন বা ওয়েবজিনের যুগ চলছে, এর বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না। তবে এখানে সম্পাদকের বড়ই অভাব, অসম্পাদিত অপ্রয়োজনীয় লেখা ভরে যাচ্ছে সামাজিক মিডিয়া, কিন্তু এ নিয়ন্ত্রণ করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া নীতিবাদিতা ও আধিপত্যবাদিতার প্রকাশ।
২০. আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে? আপনার কল্পনায়।
মজিদ মাহমুদ: আমার বিশ্বাস আমরা যে ধরনের সাহিত্য করছি, আগামী দিনে সে ধরনের সাহিত্য থাকবে না, এসব অসূয়াপরায়ণ কবি সাহিত্যিকেরও অবসান ঘটবে। মানুষের আবিষ্কৃত যে-সব প্রযুক্তির ওপর ভর করে অর্থ ও অবসর বৃদ্ধি করে, তার ভিত্তিতে মাত্র কয়েকবার মানব-সভ্যতার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। যেমন শিকার যুগ থেকে কৃষিযুগে উন্নীত হওয়া, তেমনি কৃষিযুগ থেকে ডিজিটাল যুগে পদার্পন। মানবশ্রম গবাদি পশুর শ্রম থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে প্রবেশ করেছে, কালিকলম শূন্য লেখার জগতে প্রবেশ করেছে, ছাপাখানার যুগের অবসান হচ্ছে, শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের পরিবর্তন হচ্ছে, স্পর্শবিহীন সম্পর্কের যুগ তৈরি হচ্ছে, কাছের মানুষের চেয়ে অদেখা মানুষের প্রতিক্রিয়ার ওপর বেশি জোর দেয়া হচ্ছে, ভাষার জগতের পরিবর্তন হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী একটি লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা হচ্ছে– ফলে এসবের একটি প্রভাব তো রয়েছেই। আসলে সাহিত্য আমাদের দেখা না দেখা, চাওয়া না চাওয়ার ওপর নির্ভর করে না, তার কাল ও কালের মানুষের চাহিদার ওপরে কিছুটা নির্ভর করে, শক্তিশালী সাহিত্য স্রষ্টা, কল্পনাপ্রবণ দক্ষ কবি, পর্যাপ্ত অবসর, দেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক কিছুর ওপর সাহিত্য সৃষ্টি নির্ভর করে। অবসর যাপনের জন্য মেয়েরা যে সাহিত্য পাঠ করতেন, যে উপন্যাস পাঠ করতেন তার দায়িত্ব তুলে নিচ্ছে মোবাইল ও ভার্চুয়াল কোম্পানি। তবু আশা করা যায়, মানুষের চেতনালোক, মানুষের ব্যথা-বেদনা, প্রেম-বাৎসল্য, জন্ম ও মরণশীলতার চেহারা যেহেতু এক সেহেতু আজকের সাহিত্যের সঙ্গে আগামীর সাহিত্যের সম্পর্কের ছেদ পুরোপরি ঘটবে না। চর্যাপদ পড়ে যেমন আমরা কিছু বুঝতে পারি না, মধ্যযুগের ভাষা ও বিষয় যেমন আমাদের টানে না, তেমননি মাইকেল রবীন্দ্রনাথ নজরুলসহ আমাদের কালের সাহিত্যও ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব
১১ এপ্রিল, ২০২৪
মজিদ মাহমুদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি পড়লাম। নানা বিষয় । তিনি খোলামেলা কথা বলেছেন। বাংলা সাহিত্য নিয়ে বিস্তারিত কথা বলার মতো বৈদগ্ধ্য ও পাণ্ডিত্য দুটোই রয়েছে তার। তার অনেক মন্তব্য কিংবা অধিকাংশ কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করা যায়। অবশ্য কবি আল মাহমুদের মূল্যায়নের বিষয়ে তিনি বরাবরের মতো এখানেও “ ট্যাক্টফুল ” থেকেছেন। ব্যক্তিবিশেষে সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা ভিন্ন তো হয়ই। মজিদ মাহমুদ আমাদের সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার অভিমতও গুরুত্বপূর্ণ। যারা সাহিত্য চর্চা করেন বিশেষত যারা অপেক্ষাকৃত নবীন, তাদের এ-রধরনের সাক্ষৎকার মনোযোগ দিয়ে পড়া প্রয়োজন। এতে করে তারা নিজেরাই লাভবান হবেন। অবশ্য সেটাও গ্রহণক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাজ্জাদ বিপ্লব এবং সাক্ষাৎকারদাতা মজিদ মাহমুদ– দুজনকেই সাধুবাদ জানাই।