ভাষাগ্রাম
……
আয়নায় কখনো ধরা পড়েছে হারানো অতীত। চলনপথে হঠাৎ কোনো বাল্যবন্ধুকে খুঁজে পাওয়া গেলে, শুনেছি সেও পায়নি কিছুই। আয়নার সামনে দাঁড়ালে শুধুই বর্তমান।
এই বর্তমানকে নিয়েই ঘোর লেগে যায়। পয়ারকে ভেঙে নিয়ে মধুকবির চতুর্দশপদী বারবার জলসংকটের মুখোমুখি হয়েছে। শুকিয়ে আসা কাদামাটির চিড়-ফাটে আলো কিছুতেই ঢুকতে পারেনা। অন্ধকারে বসে বসে চতুর্দশপদী দিব্য পা দোলায়।
আয়নার সামনে দাঁড়ালে দু-চারটে হারিয়ে যাওয়া কথাবার্তা মূর্ত হয়, অনেকটা বহুশ্রুত পয়ারের ধ্বনি। গ্রাম বাংলার জলপথে যেভাবে ডিঙি নৌকা দোল খায়, ঠিক সেইভাবে ভাষাগ্রামের কর্কটরেখায় জমে থাকে ক্ষমতার অবৈধ উল্লাস। অনেকেই বলবেন এসবের কোনো মানে নেই। গরীব গরীব থাকবেই, অসহায়ত্ব নিয়ে খেলবে সেবককুল। গরীবের কাদামাখা আলপথে দৌড়োবে উন্নয়নের ভেকধারী কুত্তা, পারবে না, আছাড় খাবে। তা খাক। এসব হতেই পারে। সামান্য ঘটনা। বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণবৃদ্ধি নিয়ে কোনো কথা হবে না।
এটাই ভাষাগ্রামের বর্তমান, আয়না অতীতকে নয়, বর্তমানকেই দেখায়।
……
প্রায়
……
বাবুই সে নয়। যদিও ঠোঁট ডানা সবই রয়েছে। নির্মাণকৌশল তেমন জানেনা বলেই ঘুলঘুলি সম্বল। বাকি সব ধর্ম এক। সঙ্গম, ডিম, নিজস্ব উষ্ণতায় ফাঁটিয়ে ফেলা ডিমের খোলশ। এই নিয়মে বাবুই ও চড়ুই প্রায় একভাবে চলে।
পুরস্কৃত, বাণিজ্যিক ও সভামুখ্য লেখকের বাচন এক, ভাষা এক নয়। তারা ঈর্ষা করে বাবুইকে, তবুও বাবুইয়ের ভাষা রপ্ত করেনা, বাবুইয়ের নির্মাণশৈলী শেখে না।
ভাষা এভাবেই বয়ে এসেছে চর্যাপদ থেকে বর্তমানে। শুধুমাত্র ‘প্রায়’ শব্দটিই এখনো অধরা রয়ে গেছে।
…….
অতিক্রম
…….
মাধ্যাকর্ষণকে মান্যতা দিয়ে দাঁড়ানো ভূমির ওপরে। অন্যথায় ভাসবার নিয়ম মেনে ভেসে যেতে হতো।
জলের ওপরে উপুড় হয়ে ভাসে পুরুষের নিথর শরীর। আর নারী! আকাশের দিকে মুখ করে চিৎ হয়ে। এ নিয়ম শাশ্বত, কোনোরকম হেরফের হয়নি এখনো।
এতকিছুকে মান্যতা দিয়ে অনায়াসে মুঠোয় নিতে প্রাণের আরাম তিন রঙের দেশ ডানা মেলে বারবার উড়ে নাই দু রঙের দেশে। রঙের তফাৎ হলেও ভাষা এক, প্রকৃতি এক, ভেদাভেদ শুধু আচারে-বিচারে। রঙের ফারাকটুকুতেই জেগে থাকে কাঁটাতার। কাঁটাতারের চলনভূমিতে জেগে থাকা সাম্প্রদায়িক তোরণগুলো অনায়াসে অতিক্রম করে ভালোবাসা। ভাষাগ্রামের কাঁটাতার এখন হৃদয়ে। ভালবাসা কাঁটাতারের আঘাতে জর্জরিত…
…….
ঘুণপোকা
…….
কাঁচাকাঠের আসবাব, দরজা জানালা কুরে কুরে খায় ঘুণপোকা। শরীরে শরীর লেগে থাকা কাঁচা সম্পর্কও খায় সন্দেহ। অথবা সন্দেহর মুখপোকা। এটা নিয়মের আকাশকুসুম কথা, কম বেশি সকলেই জানি।
যে কথা জানার নয় শুধু অনুধাবনের, সেইকথা এইবার শুরু হোক।
কাঠের রসে জন্ম নেওয়া ঘুণপোকা কাঠকেই খায়। জীর্ণ করে। মানুষের বাচ্চাগুলো গাঁটকাটতে ধর্মকথা শোনায়। ধর্মকথা ঘুণপোকার মতো সমাজকে জীর্ণ করে, মানুষে মানুষে গোপনে হিংসা ছাড়ায়। অনায়াসে ভাষাগ্রামের ভেড়িতে ঢুকে পড়ে নোনাজল…
…….
এপিটাফ
…….
কোনো এপিটাফ নিঃসঙ্গতার পাঁচালি পড়েনি কোনোদিন। নির্মাণকালেই পাঁচ বছরের জন্য তাকে পড়ানো হয়েছে একাবাসের ইতিহাস। সে ইতিহাসের একটাই পর্ব। আদিযুগ, মধ্যযুগ, বর্তমান যুগ নেই। একটাই যুগকথা, সেটা প্রস্তরযুগ।
বারবার আলোছায়ার আন্দোলনে সে স্থির। কোনো ক্লান্তি নেই, অবদান নেই। লুঠ হয়ে যাওয়া হকের পাওনার কথা সংবাদপত্রের পাতায় লাফাচ্ছে। সেই খবর নিয়ে কেচ্ছা করছে বিভিন্ন দল। ভাষাগ্রাম শুধু বিধান বুকে নিয়ে টানটান দাঁড়িয়ে আছে একা।
নিঃসঙ্গতার পাঁচালিমুক্ত এক এপিটাফ ঢেকে দিচ্ছে ভাষাগ্রামে নারীশক্তি…