১.জীবন কি? আপনার বর্তমান জীবন, অবস্থান– যা হতে চেয়েছিলেন বা যা হয়েছেন–এসব নিয়ে কোন আক্ষেপ, অনুশোচনা বা গর্ব হয়?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানসম্মত মতে আজ থেকে ১৩•৫ বিলিয়ন বছর অর্থাৎ ১৩৫০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং-এর ফলে শক্তি , পদার্থ , সময় এবং স্থান বা স্পেস এর আবির্ভাব হয় । আর মানুষের মতো প্রাণীদের আবির্ভাব হয় মাত্র ২•৫ মিলিয়ন বা ২৫ লক্ষ বছর আগে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হোমো স্যাপিয়েন্স-এর অর্থাৎ আমাদের অর্থাৎ বর্তমান এই মানব প্রজাতির বয়স আরও অনেক কম । পৃথিবীতে প্রায় দেড় লক্ষ বছর আগে থেকে থাকা সেপিয়েন্সদের ইতিহাসে আধুনিক এই হোমো সেপিয়েন্সদের বয়স ধরা হয় মোটামুটি ৭০০০০ বছর। যারা আফ্রিকা থেকে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে । এবং মাত্র ১০০০০ বছর তারা একমাত্র মানব প্রজাতি হিসাবে পৃথিবীতে রাজ করছে । অন্যান্য মানব প্রজাতি ততদিনে বিলুপ্ত হয়েছে । এই হলো এই-মানুষ হিসাবে আমাদের জীবনের ইতিহাস । অর্থাৎ আমার জীবনের কথা ভাবতে গেলে ইউনিভার্সের জীবন , এনার্জির জীবন ,পদার্থের জীবন , সময়ের জীবন এবং স্থানের জীবন অতিক্রম করে সেপিয়েন্সের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে ভাবতে হয় ।এবং ভেবে তার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যায় না । সামান্য ৫০-১০০ বছরের জীবনকেও আমরা শনাক্ত করতে পারি না ঠিকমতো ।
এখন জীবন বলতে life বললে জীবকোষে প্রোটোপ্লাজমের ক্রিয়াকলাপকে জীবন বলা হয় । আরও একটু বাড়িয়ে বললে সামগ্রিক শারীরিক অস্তিত্বের বহিঃপ্রকাশকেও ধরা যায় ।
কিন্তু আমাদের এই জীবন সংক্রান্ত প্রশ্নটি জড়পদার্থের বা শক্তির জীবন (যেমন সূর্যের আনুমানিক সম্পূর্ণ জীবনকাল বিবেচনা করা হয় এক হাজার কোটি বছর ।এরমধ্যে সে নাকি প্রায় ৫০০ কোটি বছর বয়স অতিক্রম করে ফেলেছে।) বা পৃথিবীতে প্রাণের জীবনকালের প্রশ্নে নয় । এ আমাদের ব্যক্তিমানুষের কাঙ্খিত এবং প্রাপ্ত জীবনকালের প্রশ্নে নির্দিষ্ট । কিন্তু তবুও ব্যক্তিমানুষের জীবন যেমন তার পূর্বপুরুষ এবং বর্তমানদের বাদ দিয়ে নয় , তার প্রকৃতি পরিবেশকে বাদ দিয়ে নয় , তেমনই খুব ক্ষীণভাবে হলেও ওই ১৩৫০ কোটি বছরের জীবন বা ২৫ লক্ষ বছরের জীবন বা ৭০ হাজার বছরের জীবনকেও সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে ভাবা উচিত নয় । কারণ এই জীবনবোধই আগামীদিনে পৃথিবীতে সেপিয়েন্সদের টিকে থাকা না থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত । আর এইসব জীবনবোধও চিন্তাশীল মানুষকে ভাবায় । ভাবনা থেকে , অভিজ্ঞতা থেকে , কল্পনা থেকে আসে মানুষের শিল্পবোধ । আমার কবিতার বই ‘হে শূন্য হে নিষাদ’-এ আছে সেই পদার্থ , শক্তি ও সময়-ময় অস্তিত্বের সঙ্গে আমার মানব সত্তার রসায়ন । আবার অন্য একটি বই ‘জীবন যেরকম ছিল’ তে আছে ব্যক্তিমানুষের জীবনকালের সঙ্গে তার আনুষঙ্গিক সমাজ ও পরিবেশের কথা। অন্য আর একটি বই ‘একটি বাড়ির বায়োপিক’-এ বাড়ির জীবন কখনও নিছক একটি বাড়ি,কখনও তা একজন ব্যক্তির জীবন ,কখনও সমাজ ,কখনও বা সম্পূর্ণ একটি দেশ।
আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক দিক থেকে দেখলে জীবন অন্য রকমের । কখনও জীবন এক অনিশ্চিত ভ্রমণ , কখনও অস্তিত্ব-আদর্শ-ঔচিত্যবোধের সমাহার । কারো জন্য ভোগ , কারো জন্য বা ত্যাগ ।
অথচ কবিতা প্রেমিক আমাদের জীবন হলো কবি জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত ।আর কবি জীবন তো পাশাপাশি হাজারো মানুষের যাপনের সঙ্গে তার নিজস্ব ঘাতপ্রতিঘাত , মিলনবিরহ। আমার মতো পুঁথি বিবর্জিত মানুষেও জীবন নিয়ে হাজারো হাজারো বাক্য লিখেও তার সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা দিতে পারব না ।
অর্থনৈতিক ও ঐতিহ্যের দিক থেকে আমরা খুবই প্রান্তিক পরিবার ও স্থানের মানুষ ।কাজেই আমাদের জীবন নিয়ে আমাদের অভিবাবকদের , ইস্কুলের শিক্ষকদের এবং পাড়াপ্রতিবেশীদের কোনো ভাবনা বা পরিকল্পনা ছিল না । এমনকি সেসময়ের দেশের সরকারেরও তেমন কোনো সুস্থ ও বিজ্ঞানসম্মত ভাবনাচিন্তা ছিল না । কাজেই জীবন কী , তাকে নিয়ে ভাবতে হয় কিনা , কীভাবে ভাবতে হয় – এসব কোনো ধারণা আমাদের মধ্যে ছিল না । গড়াতে গড়াতে জীবন একদিকে এগিয়ে বা পিছিয়ে গেছে । অনেকটা লটারির মতো। তবে সে লটারি ছিল উনিশ পয়সার টিকিটের লটারির মতো , তাতে লক্ষ টাকা পুরস্কার লাগার কোনো প্রশ্নই ছিল না কারোর জন্যই ।
গড়াতে গড়াতে আমিও সাধারণভাবে ইস্কুল ও সামান্য কলেজজীবন অতিক্রম করে সরকারি অফিসের কনিষ্ঠ কেরানির পদে আসীন হবার সৌভাগ্য অর্জন করি । তারপর ঘটনাবিহীনভাবে প্রায় ৩৫ বছরের কর্মজীবনের মধ্যে অধিকাংশটুকু কলম ও শেষ কয়েকবছর মাউস ও কিবোর্ড নিয়ে কাটিয়ে দিই । কাজেই কিছুই হতে চাওয়া হয়নি , কিছুই হয়ে ওঠাও হয়নি । কোনো আক্ষেপ অনুশোচনাও নেই । তবে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে ,যদি আমি একটা ভালো চেয়ার অর্জন করতে পারতাম তবে হয়তো আমার কবিতাগুলোর প্রতি একটু বেশি সুবিচার আদায় করে দিতে পারতাম পাঠকের কাছ থেকে । আবার যখন মূল্যবান চেয়ারে আসীন’শুধু কেরানি’-দের , ডাটাবেস ওয়ালা মস্তিষ্কদের দেখি , সৃষ্টিশীলতার ও রসবোধের তীব্র অভাব দেখি তখন আমার এই না-পারা জীবনটার জন্য একটু গর্বও হয় বৈকি ।
২. আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে? কীভাবে কেটেছে? কোনো অব্যক্ত কথা বা স্মৃতি কি মনে পড়ে ? তাড়িত করে?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : আমাদের পরিবারের সকল ভাইবোনেরই জীবন কখনও গ্রামে (পশ্চিমবঙ্গের পূর্ববর্ধমানের পর্বতপুর গ্রামে ) , কখনও এক অনুন্নত ও এক ঐতিহ্যহীন শিল্পশহরে ( পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমবর্ধমানের দুর্গাপুরে ) কেটেছে । আমার জন্ম কিন্তু হুগলির উত্তরপাড়ায় । সেখানেও মামার বাড়িতে কেটেছে জীবনের অনেক সময় । অভাবে , অপুষ্টিতে , অপর্যাপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় ও রোগব্যাধির সাহচর্যে কেটেছে জীবন । ছেলেবেলার সকল কথাই মনে পড়ে । শৈশব প্রত্যেকেরই তার নিজের কাছে গৌরবের । সবচেয়ে মনে পড়ে আমাদের পরিবারের তীব্র অভাব , বাবামার লড়াই আর আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের অ-সহানুভূতিশীল ব্যবহারের কথা । সেই দারিদ্রই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষক ছিল । জীবনের শিক্ষা যেটুকু পেয়েছি তা ওই শৈশব-কৈশোরের দারিদ্রপীড়িত জীবন থেকেই। জীবনের বাকি অংশে সময়ের মৃত্যু ছাড়া আর তেমন কোনো স্মরণীয় গৌরব নেই সে অর্থে ।
শৈশবকালে গ্রামজীবনে বর্ষায় কানায় কানায় ভরা পুকুরগুলোর কথা মনে পড়ে । শ্রাবণের কোনো এক ভোর রাতে বাড়ির পিছনদিকের কদমা পুকুরের জল নাছদরজায় এসে কড়া নাড়ত । মনে পড়ে ভাদ্রমাসে পুকুরের জলে ঝাঁক ঝাঁক ভাদুরে পুঁটির শরীরী ভাষায় শোনা “হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে”। মনে পড়ে হঠাৎ করে ঘনিয়ে আসা মেঘের মতো সেইসব পুকুরের জলেই হঠাৎ হঠাৎ বাচ্চা শোলমাছের ঝাঁক । মনে পড়ে সেই শৈশবের কয়েকজন বন্ধুর ধীরে ধীরে মেয়ে হয়ে ওঠা আর তাদের চোখের তারা ও টেপফ্রকের ঘূর্ণনের কথা ।
বেশ কয়েকজনের অকাল মৃত্যুর কথাও মনে পড়ে তাদের অস্পষ্টতা আর রহস্য সহ ।
৩. সাহিত্যে এলেন কেন? কীভাবে এলেন? অর্থাৎ শুরুটা কীভাবে? কোথায়?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : জন্ম থেকেই এপিলেপ্সির পেশেন্ট আমি । এ রোগের তখন চিকিৎসা ছিল না , গ্রামঘরে এ রোগের নামও কেউ জানত না। সংসারে আর্থিক অনটনের কারণে নিয়মিত ও পুষ্টিকর আহার জুটত না । দিনের একবেলা আহার জুটত না প্রায় দিনই । কাজেই শরীর স্বাস্থ্য কোনোদিনই ভালো ছিল না । প্রধানত অসুস্থতা জনিত কারণেই খেলার মাঠে বন্ধুরা খেলায় নিত না আমাকে । মাঠের পাশে বসিয়ে রাখত । আমিও সাহসের অভাবে , পাছে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি (যা যখনতখন যেখানেসেখানে হত ) খেলতে চেয়ে জোরও করতাম না। কাজেই একটা উদাসীনতা কাজ করত মনের মধ্যে । এদিকে পশ্চিমবঙ্গের সেসব গ্রামে তখনও পড়াশুনা নিয়ে এখনকার মতো মাত্রাতিরিক্ত সচেতনতা তো দূরের কথা,প্রয়োজনীয় সচেতনতাটুকুও ছিল না অধিকাংশ অভিভাবকের মধ্যেই । তারা প্রায় সকলেই ছিল অশিক্ষিত , অনেকেই নিরক্ষরও । ছেলেরা সামান্য বড়ো হলেই মাঠের কাজে অংশ নিত বাবা কাকার সঙ্গে ।মেয়েদের হয় বিয়ে হয়ে যেত নয় ঘরের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হত। ব্যতিক্রমী কয়েকটি মধ্যবিত্তের ঘরে পড়াশুনা আর পাঁচটা স্বাভাবিক বিষয়ের মতো ছিল। সে নিয়ে তারাও কেউই অতিরিক্ত চিন্তা করত না । চার পাঁচটি সন্তানের মধ্যে যে যেমন করে পারত বড়ো হত ।কাজেই ইস্কুলে সহপাঠী হিসাবে যাদের পেয়ে ছিলাম তারা কেউই পড়াশুনায় বিশেষ ভালো ছিল না । ফলত মাধ্যমমানের ছেলে হয়েও আমি তাদের মধ্যে ছিলাম সেরা । পড়াশুনায় আমি ভালো এই ভ্রান্তধারণা জনিত কারণে এবং খেলাধূলা ও অন্যান্য স্বাভাবিক ক্রিয়াকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজেকে অন্যরকম ভাবতে শুরু করি সেই বালক বয়সেই। ক্লাসের বাংলা পাঠ্যে যেসব কবিদের কবিতা থাকত সেগুলো বারবার পড়তাম । কবিতার পাশে পাশে কবিদের ছবিগুলো দেখতাম । সিলেবাসে বাইরেও অনেক কবিতা পড়ার সুযোগ হয় গ্রামের ছোট্ট লাইব্রেরি থেকে । পড়তে পড়তে আর কবিদের ছবি দেখতে দেখতে আর কবিদের জীবনীগ্রন্থ (দু একজনের ) পড়তে পড়তে একটা নেশা জাগতে থাকে মনের মধ্যে। তাদের নকল করতে শুরু করি । তাঁদের চোখ , তাঁদের দেখা আর আমার অক্ষম ছন্দজ্ঞান আর দুর্বল ভাষায় লিখতে থাকি । খাতা ভরে উঠতে থাকে সেসব নকলনবিশীতে । আস্তে আস্তে ইস্কুলে , পাড়ায় সবাই জানতে পেরে যায় আমি কবিতা লিখতে পারি । সর্বনাশের সেই শুরু ।
এভাবেই এই কাজের জগতে একজন স্থায়ী কর্মী হয়ে উঠি আমি । তবে এটাকে সাহিত্যের জগতে আসা বা কবিতার জগতে আসা বলে কিনা আজও জানি না আমি । আজও আমি নিজেকে কবি বলে মনে করি না । কবিতার বৃহত্তর সংসারও আমাকে কবি বলে জানে না বা মানে না সঙ্গত কারণেই ।
৪. বাংলা ভাষার তথা বাংলাদেশের প্রধান কবিবৃন্দ যেমন : ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ– তাদের সাহিত্যকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন? পশ্চিমবঙ্গের প্রধান কবিবৃন্দ– কার-কার সঙ্গে আপনার সখ্যতা বা বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিলো বা আছে ? তাদের সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা বা তাদের সাহিত্য নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
দিশারী মুখোপাধ্যায় : এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে কবি শামসুর রহমানের ‘বাংলাভাষা উচ্চারিত হলে’ কবিতাটির কিছুটা অংশ মন্ত্রপাঠের মতো আগে পড়ে নিতে চাই।
” বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে ঝরে
রোদ ,
বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন ।
বাংলা ভাষা
উচ্চারিত হলে অন্ধ বাউলের
একতারা বাজে
উদার গৈরিক মাঠে , খোলা পথে , উত্তাল নদীর
বাঁকে বাঁকে , নদীও নর্তকী হয় ।”
এবার বলি — আমি বাংলাদেশের কবি , পশ্চিমবঙ্গের কবি – এভাবে কবিতা পড়ি না । পড়ি বাংলা কবিতা । কবিকে সেভাবে ব্যক্তিগতভাবে অনেক সময়ই চেনা হয়ে ওঠে না। কাজেই কবিতা পড়ার সময় তাঁর নাগরিকত্বের প্রশ্নটি মাথায় কাজ করে না । তাছাড়াও আমি যেহেতু সমালোচক নই , প্রবন্ধকারও নই , সেকারণে কবির দেশ কাল পাত্র অন্যান্য বিস্তৃত পরিচয় আমার বিশেষ প্রয়োজন হয় না । আমি কেবল একজন কবির কবিতা পড়ি তাঁর শৈলীকে শেখার জন্য আর যতটা সম্ভব তাঁর অনুভবকে ছোঁবার জন্য । শৈলী এবং অনুভবের প্রশ্নে সকাল বাঙালি কবিই তথা বাংলাভাষার কবিই আমার কৌতূহল উদ্রেক করেন । ছেলেবেলা থেকে আজ পর্যন্ত আমি যাঁদের কবিতা বারবার পড়ি তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম করা যেতেই পারে ।কিন্তু এত অসংখ্য সংখ্যক কবির কাছে আমি আমার কবিতা বোধের জন্য ঋণী তা নাম উল্লেখ করে এবং সময়ের পর্যায় ও গুরুত্ব উল্লেখ করে বলা প্রায় অসম্ভব ।হয়তো অনুচিতও । তবুও আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য সকল অগ্রজ কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি । কৃত্তিবাস ওঝা ,কাশীরাম দাস , মাইকেল মধুসূদন , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , কাজী নজরুল ইসলাম , অক্ষয় কুমার বড়াল, নরেশ গুহ , জসীমউদ্দীন , বুদ্ধদেব বসু , বিষ্ণু দে , অরুণ মিত্র,জীবনানন্দ দাশ ,সুভাষ মুখোপাধ্যায় , গোলাম কুদ্দুস , ফররুখ আহমদ, মণীন্দ্র গুপ্ত , শামসুর রহমান , আল মাহমুদ , নির্মলেন্দু গুণ , বিনয় মজুমদার ,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , মহাদেব সাহা ,শক্তি চট্টোপাধ্যায় ,শহীদ কাদরী, অরুণ সেন , জয় গোস্বামী আরও অনেকেরই নাম করা উচিত । এর সঙ্গে আমি অবশ্যই বলব লালন ফকির, কবীর, হাসন রাজা , আব্বাসউদ্দীন , রতন কাহারের নাম। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে কী তৎকালীন খ্যাত অখ্যাত কবি , কী এসময়ের খ্যাত অখ্যাত কবি , কারোর সঙ্গেই পরিচিত হবার সুযোগ পাইনি বা চাইনি । তাঁদের লেখা পড়েই আমি তাঁদের কবি হিসাবে চিনি । অবশ্যই তাঁদের অনুকরণ করি না । তাঁরা কীভাবে নিজের ভাষার ও বোধের অন্বেষণ করেছেন সেটুকুই বোঝার চেষ্টা করি।
ফলে কারোর সঙ্গেই কখনোই আমার ঘনিষ্ঠতা বা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি । আমি যেমন চাইনি তেমনই হয়তো তাঁরাও চাননি বা চান না । তাই তাঁদের সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার তেমন নেই । যে দুএকজনের সঙ্গে সামান্য পরিচিত হবার সুযোগ হয়েছিল ঘটনাক্রমে সেসব অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো ছিল না । তাই তাঁদের সম্পর্কে আমার মনে যে ভাবমূর্তি আছে সেটাকে আমি ভাঙ্গতে চাই না । সাহিত্যের সাংগঠনিক কাজে বিভিন্ন সময় যুক্ত থাকার কারণে পূর্ণেন্দু পত্রী , কবিতা সিংহ , শুদ্ধসত্ত্ব বসু , সুভাষ মুখোপাধ্যায় , নারায়ণ স্যানাল , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় , উৎপল কুমার বসু – এরকম বহুজনের ঘনিষ্ঠতা অর্জনের সুযোগ পেয়েও আমি তা কাজে লাগাইনি কখনও ।
তাঁরা তাঁদের স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে উজ্জ্বল । তাঁদের প্রত্যেকের কাছে আমি পরোক্ষে উপকৃত । কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে তুলনামূলক মূল্যায়ন করার ইচ্ছে নেই আমার ।
৫. আপনি একাধারে একজন কবি ও সাহিত্যবিশ্লেষক অর্থাৎ বহুমাত্রিক। আপনার অভিজ্ঞতা ও বিচরণ ক্ষেত্র ব্যাপক ও বর্ণিল। বিচিত্র। এই সামগ্রিক সত্তাকে কিভাবে দেখেন? কিভাবে উপভোগ করেন?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : এই প্রশ্নের উত্তরে দেবার আগে কবি আল মাহমুদের নিজের কবিতা সম্পর্কে বলা কথার কিছুটা শুনে নিই । ১৯৮০ সালে ‘হরফ’ থেকে প্রকাশিত ‘আল মাহমুদের কবিতা’ এই বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন – “কবিতা সম্বন্ধে এমনিতেই আমি যাকে বলে অনিবার্য কথাবার্তা ঠিকমতো বলতে পারি না। আর যদি আসে নিজের কবিতা বিষয়ে কিছু বলার ব্যাপারে তাহলে তো ভয়ের আর সীমাই থাকে না।” এতবড়ো একজন কবি যদি নিজেকে কবি বলতে এতটা কুণ্ঠাবোধ করেন তবে আমার মতো সামান্য মানুষের কেমন অবস্থা হতে পারে তা অনুমেয় । তাই বলছি আমার সম্পর্কে আপনার এই ধারণা মোটেই সঠিক নয় । আমি মোটেই একজন সফল কবি নই , সাহিত্যবিশ্লেষক নই ।বহুমাত্রিক ব্যক্তিও নই আমি । হ্যাঁ , একথা ঠিক, বর্তমানে সাহিত্য জগতে নিজের সম্পর্কে এরকম দাবি করার একটা চল চালু রয়েছে । আল মাহমুদের ধারণা আর কেউ পোষণ করেন না । দু চারটি গল্প লিখে বা কোনোরকম উল্লেখযোগ্যতা ছাড়াই একটি মামুলি উপন্যাস লিখেই অনেকে নিজেকে কথাসাহিত্যিক হিসাবে ঘোষণা করছে। দেওয়া নেওয়া পদ্ধতিতে চলা তথাকথিত সাহিত্যসমাজের একটা বড়ো অংশ পরস্পরের হয়ে এরকম ঘোষণা করে দেওয়ার দায়িত্বও পালন করছে । কিন্তু বাংলা সাহিত্যের সংসার এতটাই বড়ো আর এতটাই সমৃদ্ধ যে এখানে সামান্য কিছু করে ওঠাও যথেষ্ট কষ্টকর এবং সাধনাসাপেক্ষ ।
আমি নিজেকে খুবই অকিঞ্চিৎকর মনে করি বাংলা সাহিত্যের সংসারে । সাহিত্যের অন্যান্য ধারায় উল্লেখ করার মতো আমার তেমন অবদান মোটেই নেই । কবিতা লেখার একটা চেষ্টা বলুন বা সাধনা বলুন বা ক্ষমতা বলুন সামান্য পরিমাণে হয়তো আমি পেয়েছি । তবুও মাঝে মাঝে সংশয় জাগে কবিতা বলে যা আমি লিখি তা আদৌ হয়তো কবিতা নয় । যদি তা সত্যই কবিতা হতো কবিতা প্রেমিকদের কাছে তবে তার চাহিদা বা তার জন্য তাদের ভালোবাসা সৃষ্টি হতো। আমি জানি যে আমি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম এবং আমি তা লিখছি । কেমন লিখছি , ভবিষ্যতে সে লেখার কোনো মূল্য প্রাপ্তি ঘটবে কিনা তা নিয়ে মোটেই ভাবিত নই । বরং সেরকম কিছু করে উঠতে পারিনি এখনও এমনই বিশ্বাস করি ।
‘সামগ্রিক সত্তা’ বলে একটি শব্দবন্ধ আপনি ব্যবহার করেছেন। সামাজিক প্রাণী হিসাবে অবশ্যই আমাদের একটি সামগ্রিক সত্তা থাকার কথা । শুধুমাত্র কবি খ্যাতি বা সাহিত্যিক হিসাবে পরিচিত হবার জন্য রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের অন্যায় ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকা , এমনকি নীরব থেকে তাকে সমর্থন করাও অবশ্যই নিন্দনীয় । সাহিত্যের বহু ধারায় আমার অনায়াস যাতায়াত করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যদি এমন আচরণ করি তবে তা আমার সামগ্রিক সত্তার পরিপন্থী বলেই মনে করি । প্রকৃতি পরিবেশ , বৃহত্তর পৃথিবীর রাজনীতি এবং যুদ্ধোন্মত্ততার বিরুদ্ধে ব্যক্তি মানুষ হিসাবে আমার কণ্ঠস্বরই আমার সামগ্রিকতার পরিচায়ক । অবশ্য আমি এও বিশ্বাস করি এই সামগ্রিক দায়বদ্ধতা আমার লেখার উপকরণ হতেই হবে এমনটা নাও হতে পারে ।
আমার সংসার , আমাদের উত্তরসুরিদের জন্য আমার কিছু দায়বদ্ধতা থাকার কথা । সফলতা ব্যর্থতা ভিন্ন কথা ।আমি বলতে চাইছি মানসিকতা এবং প্রবণতার কথা ।শিল্প সাহিত্য কর্মের অজুহাতে অনেকেই এই সামগ্রিকতাকে অস্বীকার করে শিল্পসাহিত্যে কৃতকার্যতার এক তথাকথিত সামগ্রিকতা অর্জনে মেতে উঠতে চান পলায়নপর এক মানসিকতার জন্য।
অল্প পরিসরে গদ্য লেখার অভ্যাস আছে । একসময় একাধিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছি। বাংলা ভাষার প্রচার প্রসারের স্বার্থে এবং সরকারের পরোক্ষ মদতে ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কাজও করেছি, সীমিত পরিসরে । আঞ্চলিক সাহিত্য সংগঠনগুলোর সঙ্গেও যুক্ত আছি বিভিন্নরকমভাবে । নতুন যারা লিখতে আসে তাদের সঙ্গেও সবসময়ই মানসিকভাবে যুক্ত থাকার চেষ্টা করেছি।ছোটো গাছ বৃক্ষে পরিণত হয়ে যাবার পর আর তেমন যোগাযোগ থাকে না । এজন্য কোন পক্ষ দায়ী তা আর বিস্তৃত করতে চাই না ।
৬. আদি বাংলা তথা চর্যাপদ থেকে আজ অবধি বাংলা সাহিত্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে–আপনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণে ?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : হাজার বছর ধরে আমরা আমাদের এই ভাষা-সাহিত্যকে নিয়ে হেঁটে চলেছি । চর্যাপদের সিদ্ধাচর্যদের থেকে শুরু করে আজকের এই মুহূর্তের নবীনতম সাহিত্যকর্মীটি পর্যন্ত এই পথ চলাতেই আমাদের আনন্দ। বহু মানুষের ভালোবাসা ,ত্যাগ,স্বপ্ন দিয়ে তৈরি এই সাহিত্যসড়ক । সময়ে সময়ে ভাষা তার দেহ-মন পরিবর্তন করেছে বিবর্তনের হাত ধরে , তেমনই আমাদের পূর্বপুরুষদের সাহিত্যবোধও বাঁক নিয়েছে বহুবার স্বাভাবিকভাবেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাহসী ও অন্বেষণকারীদের গবেষণা কর্মও। অরণ্যচারী জীবন , গ্রামজীবন , নগরজীবন ধরা আছে এই সাহিত্যকর্মে ।ধর্ম , দর্শন , মিথ এর উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে । বিজ্ঞান ও দর্শন , রাজনীতি ও অর্থনীতি , বিপ্লব ও সংস্কারও এর মেধা ও মননে আশ্রয় নিয়েছে । তবে সাহিত্যের আত্মা হিসাবে সবচেয়ে মূল্যবান ও অনিবার্য হিসাবে উঠে এসেছে মানুষের জীবন প্রেম-রিরংসা , ত্যাগ ও হরণ, সহযোগিতা ও বিদ্বেষ ইত্যাদি সহ ।
৭. সাম্প্রতিক শিল্প-সাহিত্যচর্চায় কোন-কোন চ্যালেঞ্জ বা সুবিধা-অসুবিধা আছে বলে আপনার মনে হয়? কীভাবে এগুলি মোকাবিলা করেন?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : সৃষ্টির একেবারে আদিম সময় থেকে , শিল্প সাহিত্যকে তখনও মানুষ শিল্প সাহিত্য হিসাবে চিহ্নিত করে ওঠেনি , যৌথভাবে বা এককভাবে চর্চা করেছে ।কখনও নিছক কাজের প্রয়োজনে , কখনও হয়তো নিছক মনের খেয়ালে , কখনও কিছু বলতে চেয়ে কিছু বুঝাতে চেয়ে যা তার জীবনযাপন থেকেই উদ্ভূত অথচ দৈনন্দিন জীবনের আর পাঁচটা উপকরণের মতো নয় । একটিই সাহিত্যকর্ম যুগে যুগে বহু মানুষের হাত ধরে এগিয়েছে সময়ে সময়ে সংযোজিত ও বিয়োজিত হতে হতে , ব্যক্তি লেখক বা স্রষ্টা সেখানে বড়ো কথা ছিল না ।প্রাচীনকালের যাকিছু সৃষ্টি , দেশকাল নীরপেক্ষ রূপে এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরিত হতে শুরু করে । সময় ও সভ্যতার বিকাশের হাত ধরে মানুষের জীবনের প্রকাশ ও যাপন পদ্ধতির পথের সংখ্যা বেড়েছে নানানদিকে । আপন আপন পছন্দ মতো মানুষ নিজ নিজ কাজ ও যাপন আলাদা করে নিয়েছে । বহুমানুষের একই কাজ থেকে বহুমানুষের দলে দলে বিভিন্ন চর্চার প্রকাশ পেয়েছে । তবে তখনও তারা গোষ্ঠীভুক্তই ছিল । যখন থেকে মানুষ তার এই প্রবণতাকে জীবনের নিছক কাজের জগৎ থেকে আলাদা করে দেখতে শিখল , যখন থেকে এই শিল্প সাহিত্য তার অর্থকরী ও গড় জীবন থেকে অভিমানে ছিটকে পড়তে শুরু করল , যখন থেকে ব্যক্তিমানুষের চিন্তাভাবনা , স্বপ্ন ও কল্পনা , আশা ও আশাভঙ্গ এর মধ্যে উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করল তখন থেকেই একটু একটু করে এই প্রকাশ-মাধ্যমটি ক্রমশ স্রষ্টার নিজস্ব একক জগৎ হয়ে উঠতে শুরু করল ।
যে প্রযুক্তির যুগে আমরা অবস্থান করছি , যে কর্মব্যস্ততা আমাদের একমাত্র পরিচয় হয়ে উঠছে, পৃথিবী ছাড়িয়ে পৃথিবীর বাইরের যে পদার্থময় দুনিয়া আমাদের যাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে উঠছে , বাস্তবতা এবং প্রতিটি বিষয় যেভাবে মহূর্তেই বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে ফেলে যাচাই করে নেবার উপায় উদ্ভাবন হচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্ন ও কল্পনার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে তাতে হয়তো সাহিত্যের প্রয়োজনীতা আর থাকবে না সে অর্থে, সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে । মূল্যবোধগুলো পাল্টে যাওয়ার জন্য বা প্রয়োজনীতা শেষ হয়ে যাবার জন্য এতকালের শিল্পী সাহিত্যিকের যে অন্তর-রসায়ন ছিল তাও পাল্টে যাচ্ছে ।
মানুষের আগামীজীবন তো AI নির্ভর হয়ে উঠবে মনে হচ্ছে । মানুষের ভালোবাসা , দেশপ্রেম , অপত্যস্নেহ , যৌনতা ও সেই যৌনতার প্রকাশ কেমন হবে তা সবই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে । কল্পনা করার , স্বপ্ন দেখার আগেই যদি রূঢ় বাস্তবতা নগ্নভাবে হাতের কাছে উপকরণ হিসাবে হাজির হয়ে যায় তবে সেসবকে পাওয়া ও চাওয়ার জন্য মানুষকে হয়তো আর তার মননের সাহায্য নিতে হবে না ।
তবে যুগে যুগে দেখা গেছে মানুষের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ মানুষ নিজেই । কাজেই মানুষ যদি তার সৃষ্টিসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় তবে সে সব প্রতিবন্ধকতাকেই জয় করতে পারবে। হয়তো আগামীদিনে শিল্পসাহিত্যের অঙ্গনে ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে । তারপরেও গোষ্ঠীগতভাবে সে আবার হয়তো এই ক্ষেত্রটিকে উদ্ধার করবে । অন্তত তেমন আশা আমাদের করতেই হবে ।
৮. আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় বাংলার ১৪০১ সালে , ইংরেজির ১৯৯৪। দু ফর্মার এই বইটির নাম ছিল ‘স্পষ্ট বলব না’। প্রথম বই প্রকাশের বাহ্য অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি হবার তেমন কোনো কারণ ছিল না সঙ্গত কারণেই । সাহিত্যে আমার কোনো পারিবারিক ঐতিহ্য নেই । শিক্ষা জগৎ বা সাহিত্য জগতের সঙ্গে আমার কর্মক্ষেত্রের তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না বা নেই আজও। সাহিত্য জগতের কোনো কৃতি ব্যক্তির সঙ্গে আমার কোনো নৈকট্য বা বন্ধুত্ব ছিল না।ফলে আমার সে বই ছাপা হল কবি ও প্রচ্ছদ শিল্পী বিষ্ণু সামন্তের উৎসাহে ও সহযোগিতায় নীরবে, এবং নীরবেই সে রয়ে গেল বৃহৎ সাহিত্য জগতের আড়ালে ।
সৃষ্টিকে স্রষ্টার সন্তান সম দৃষ্টিতে দেখা হয়। সেদিক দিয়ে আমার মনোজগতে একটা আলোড়ন নিশ্চয়ই পড়েছিল, বড়ো কবিদের মতো আমারও একটি কবিতার বই হল , এই ভাবনায়। এতদিন পর জীবনের শেষের দিকে এসে সেসব আর বিশেষভাবে মনে পড়ে না। মনে পড়ত যদি বন্ধুবান্ধব মহলে , কবিদের সমাজে সে কিছুমাত্র নিজের উপস্থিতি জানান দিতে পারত । কাজেই এখন স্মৃতি বলতে আমার সেই বইটির একটি উল্লেখযোগ্য কবিতার বই হিসাবে বিবেচিত হওয়ার ক্ষেত্রেও অক্ষমতার কথাই মনে করতে পারি শুধু ।
৯. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : প্রথম প্রশ্নের উত্তরে এই প্রশ্নের উত্তরের অনেকটাই রয়ে গেছে । অর্থাৎ আদিম যুগ থেকে আজ পর্যন্ত আমার নিকটবর্তী পূর্বপুরুষ যারা ছিলেন মানুষ হিসাবে আমি যেহেতু তাদের উত্তরাধিকার বহন করছি , যদি আমি সত্যই কবি বিশেষণটির ধারক হবার যোগ্য হই তবে কবি হিসাবেও আমি তাদের প্রত্যেকেরই উত্তরাধিকার বহন করছি । কারণ যে মানুষের বিস্ময়বোধ আছে , যে মানুষের প্রশ্ন আছে , যে মানুষের অন্বেষণ আছে , প্রেম আছে তারা প্রত্যেকেই কবি সত্তার অধিকারী ।
আর নিছক কবি সাহিত্যিকদের উত্তরাধিকারের কথা যদি জানতে চান তাহলেও বলব আমার অগ্রজ সকল বাঙালিই কবিরই উত্তরাধিকার বহন করছি আমি । বলা যায় অন্য দেশের অন্য ভাষার কবি , যাঁর কবিতা আমি প্রত্যক্ষভাবে পড়িনি , পরোক্ষে কোথাও কোনো সূত্র থেকে তাঁর অবদানও নিশ্চিতভাবেই রয়েছে আমার এই আমি হয়ে ওঠার পিছনে ।
যদি পারিবারিকভাবে খুঁজি এই প্রভাব , তবে সেভাবে কিছু খুঁজে পাব না হয়তো । আমার পিতামহের বাবা সেকালে বাংলায় অভিধান লিখেছিলেন বলে গ্রামের প্রবীণ লোকেদের মুখে শুনেছিলাম আমার বালকবেলায়। তার কোনো প্রমাণ বা নিদর্শন অবশ্যই পাওয়া যায়নি । যদি সে কথা সত্য হয় তবে শব্দসন্ধানী একটি মানুষের মধ্যে কবিসত্তা ছিল ধরে নিলে হয়তো ভুল হবে না । আমার পিতামহও খানিকটা ভবঘুরে ছিলেন , পাগলাটে ছিলেন । তিনিও নিজের খেয়ালে সবসময়ই কিছু লিখতেন , মনে পড়ে অস্পষ্টভাবে । কি লিখতেন কেউ জানত না । খোঁজও করেনি । সেসব যে খুঁজে দেখার কোনো বিষয় হতেও পারত তেমন বোধবুদ্ধি সম্পন্ন বা সামান্য শিক্ষিতজনের বেশ অভাব ছিল তখন । কেজানে তিনিও কবিতা জাতীয় কিছু লিখতেন কিনা। তবে আমার মামা একজন অখ্যাত কবি ও শিল্পী ছিলেন । গোপনেই তিনি তাঁর এই সত্তাকে লালন করতেন । সেখান থেকে কিছু উৎসাহ পেয়েছি অবশ্যই।
এরপরেও যদি ভেবে দেখি কৈশোরে বা যৌবনে আমি কার কবিতা বেশি পড়েছি , কে আমাকে বেশি টানতেন তবে জীবনানন্দ , শক্তি চট্টোপাধ্যায় , ভাস্কর চক্রবর্তীর কথা স্বীকার করতেই হয় ।
১০. এ যাবৎ সর্বমোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : এখনও পর্যন্ত আমার মোট আঠারোটি বই প্রকাশিত হয়েছে । সবকটিই কবিতার বই । এর মধ্যে কলকাতার ‘প্রাচ্যপাশ্চাত্য’ প্রকাশনের উদ্যোগে ২০২৩ কলকাতা বইমেলায় আমার প্রথম ১৩ টি বই নিয়ে কবিতাসংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে । এ প্রসঙ্গে ‘কবিতা আশ্রম’ পত্রিকা ও কবি বিভাস রায়চৌধুরীর কথা স্মরণে আসেই । কেন ? তার বিস্তৃতিতে যাচ্ছি না । নিজের কাজের প্রতি স্রষ্টা হিসাবে সবকটিই আমার কাছে এক এক কারণে প্রিয়। তাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার জীবনের একটা সময় , একএকটা অনুভূতি , কিছু কিছু মানুষ ও ঘটনাও।বইগুলো হাতে নিলেই সেসব স্মৃতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে । কিন্তু যদি পাঠকের দৃষ্টিতে দেখি , আলোচকের চোখে দেখি তবে স্বীকার করতেই হবে একটিও তেমন উল্লেখযোগ্য কাজ হয়ে ওঠেনি । এর কারণ দুটি । যদি কোনো একটি কাজ উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠত তবে বিদ্বজ্জন সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করত সেটি । দ্বিতীয় কারণ হল তেমন কিছু আজও সৃষ্টি করতে পারিনি বলেই এখনও তেমন কিছু একটা করার স্বপ্ন রয়েছে মনে ।
১১. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
দিশারী মুখোপাধ্যায় : ঘটনাক্রমে ২০২৪ কলকাতা বইমেলায় আমার চারটি কবিতার বই প্রকাশিত হয় । প্রথমটি হল ‘দিবারাত্রির কাব্য ‘ প্রকাশন থেকে ‘নির্বিষ চন্দ্রবোড়া ও প্রিয় নির্বাসন’। সেই সময়ের লেখা কিছু কবিতার সংকলন । দ্বিতীয়টি ছিল ‘সাঁঝবাতি প্রকাশন’ থেকে ‘একটি বাড়ির বায়োপিক’ । বাড়ি কেন্দ্রিক চিন্তাচেতনার একটি সিরিজ কবিতা । তৃতীয়টি ছিল ‘বই টার্মিনাস’ থেকে ‘জীবন যেরকম ছিল’ , একটি সিরিজ কবিতার বই । মৃত্যু থেকে জীবনের প্রথম সৃষ্টিমুহূর্ত পর্যন্ত ফিরে দেখা নিজেকে , যা সাধারণভাবে প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেও একইরকমভাবে ঘটে । আর একটি বই ছিল সৌরজগৎ , মিল্কিওয়ে , গ্যালাক্সি ও অনন্ত শূন্যতা নিয়ে যে নভোমন্ডল তার সঙ্গে আমার রসায়ন ইত্যাদি নিয়ে । বইটির নাম ‘হে শূন্য হে নিষাদ’ । প্রকাশক ‘আলো পৃথিবী’ । বইগুলো সম্পর্কে এর অতিরিক্ত বলা আমার কাজ নয় । প্রকাশক বা কোনো আলোচক সে বিষয়ে বলার অধিকারী ।
১২. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : আমি নিজেকে কিছুই বলি না। তবে আশির দশকের আমার কবি বন্ধুরা আমাকে আশির দশকের কবি বলেই বলে থাকেন । কেন , সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই । ‘কবিতা ক্যাম্পাসের’ সম্পাদক ও কবি অলোক বিশ্বাস আমাকে আশির কবিদের সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করেছেন ।
১৩. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।
দিশারী মুখোপাধ্যায় : আমার সমকাল তো কোনো সামান্য সময়কাল নয়।আমার জীবনে ছিল অন্ধকার আবৃত গ্রামজীবন , ছিল ঐতিহ্যহীন আধাউন্নত এক শিল্পশহরের জীবন । একই জীবনে তিনটে রাজনৈতিক পালাবদল দেখেছি । হয়তো সামনের দিনে আরও একটি দেখতে পাব । আমার শিক্ষাজীবন ছিল গড়পরতা । চাকরি জীবন ছিল কেরানিজীবন । সেখানেও ছিল দুটো বড়ো অধ্যায় , ম্যানুয়াল কাজের দিন আর কম্পিটার নিয়ন্ত্রিত কাজের দিন । পত্রপত্রিকার দিক থেকে ভাবলেও অনেকগুলো পর্যায় অতিক্রম হতে দেখেছি । লেটারপ্রেসে পত্রিকা ছেপেছি, কম্পিউটারে পত্রিকা ছেপেছি , এখন অনলাইন পত্রিকাও দেখছি । সম্পাদকরা তখন লেখককে সম্মান করতেন , ব্যক্তিগতভাবে লেখা চাইতেন । এখন অধিকাংশ সম্পাদক ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে লেখা আমন্ত্রণ করেন । যারা ছাপা পত্রিকা করেন তারা অনেকেই লেখককে পত্রিকার লেখককপি দেন না।লেখকদেরও তেমন সম্মান দাবি করতে দেখি না । আগে কবিতার অনুষ্ঠান, কবিতাউৎসব হতো না এত বিপুল সংখ্যায় ও আকারে । এত স্মারক , সম্মান ,পুরস্কার ছিল না । কিন্তু পাঠক ছিল , সম্মান ছিল কবির। সিনিয়র কবিদের সম্মান ছিল , মুড়ি মুড়কি একদর ছিল না ।এখন কবিতা প্রকাশের জন্য ফেসবুক রয়েছে , বই প্রকাশ সহজ হয়েছে । কিন্তু এইমুহূর্তে এক কথায় প্রতিনিধি স্থানীয় কোনো কবির নাম করা যাবে না ।সকলেই বন্ধুবৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এখন এপার বাংলা , ওপার বাংলা ও অপর বাংলার কবিদের মধ্যে যোগাযোগ সহজ হয়েছে । পৃথিবীর বিভিন্নপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সকল বাংলাভাষার কবিদের মধ্যে যোগাযোগ সহজ হয়েছে।এই যেমন আটলান্টা থেকে আপনার সঙ্গে আমার মতো একজন অতিদীন মানুষের যোগাযোগ হয়েছে । প্রযুক্তির বাড়াবাড়ি দেখছি ।মানুষের নিজের পৃথিবীকে দূষণে ভারাক্রান্ত করে তুলে অন্য পৃথিবীর সন্ধান দেখছি । যৌথসংসারে থেকেছি , এখন পারমাণবিক সংসারে টিকে আছি । সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে অবক্ষয় দেখছি। পুঁজির নগ্নতা দেখছি।
১৪. আপনি কি কখনো বাংলাদেশে এসেছেন? আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাচ্ছি।
দিশারী মুখোপাধ্যায় : “এইপৃথিবীতে এক স্থান আছে –সবচেয়ে সুন্দর করুণ :
সেখানে সবুজডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল ;
সেখানে গাছের নাম :কাঁঠাল,অশ্বত্থ,বট,জারুল,হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রংএর মতো জাগিছে অরুণ ;
সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাসাগরের বুকে ,- সেখানে বরুণ
কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল;
সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল,
সেইখানে লক্ষ্মীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট , তরুণ;”
জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’র এই কবিতাটি বা এমন আরও সব কবিতায় ধরা আছে বাংলার অপরূপ রূপ ।
এমন যে বাংলা সে তো এই পৃথিবীর একমাত্র স্বর্গ।সেখানে যাবার ইচ্ছে কার না হয় ? আর আমি তো বাংলাদেশেই আছি। তবে রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সীমাদ্বারা চিহ্নিত যে বাংলাদেশের কথা বলছেন সেখানে আমার যাওয়া হয়নি । শুধু সেখানে কেন , এই পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জায়গাতেই আমার যাওয়া হয়নি । তাই বাংলাদেশ নিয়ে আমার প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই । আমার চারপাশের ছোটোবড়ো সব বন্ধুই একাধিকবার গেছেন সেই পুণ্যভূমিতে ।তাদের অভিজ্ঞতাই আমার অভিজ্ঞতা । শুনেছি আমাদের অনেক আগের কোনো পূর্বপুরুষ ফরিদপুরের লোক ছিলেন । অথচ কয়েকপুরুষ ধরে আমরা নেহাৎই এই বাংলার মানুষ । জীবনানন্দের বাংলাকে সম্পূর্ণটুকু না হলেও অনেকটাই দেখেছি এই বাংলাতেও। তবে এখন সেই প্রথম জীবনের দেখা বাংলাকে যেমন এই বাংলাতে আর কোথাও দেখতে পাই না , হয়তো জীবনান্দের সেই ধানসিঁড়ির বাংলাকে আর তেমন পাওয়া যাবে না সেখানেও। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই ।
১৫. বাংলাদেশের সাহিত্য পড়েন? আপনার প্রিয় বা পছন্দের বাংলাদেশী সাহিত্যিক কে-কে বা কারা? কেন?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : পড়ি তো । কবিতায় কাদের কবিতা পড়ি তা আগেই বলেছি । গদ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস , সেলিনা হোসেন এঁদের লেখা কমবেশি পড়ি । যাঁর যে লেখাটি পড়ি এবং ভালোলাগে সেই লেখাটির জন্য তাঁকে প্রিয় লেখক মনে হয় ।
১৬. বাংলাদেশ এবং ভারতীয় বাংলা সাহিত্যের মিল ও তফাৎ কোথায় ? কী কী ?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : যেহেতু আমি গবেষক বা প্রাবন্ধিক নই , আমার পড়াশুনাও যথেষ্ট পরিমাণের নয় তাই এরকম তুলনামূলক আলোচনা আমি করতে পারব না । মিল একটাই , তা হলো একই ভাষায় লেখা , যা আমি পড়তে এবং বুঝতে পারি । তফাৎ হলো কাহিনির ভৌগোলিক অবস্থান , চরিত্রগুলোর আঞ্চলিকতা ও স্থানীয় লৌকিক ভাষা ও মিথের ব্যবহার ।
১৭. এই দুই দেশের সাহিত্যিক মেলবন্ধন উন্নয়নে কোন-কোন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : এরকম কোনো ভাবনা আমার এখনও নেই । তবে আদানপ্রদান , মেলবন্ধনের কাজ তো বহুদিন ধরেই চলছে । উভয় বাংলার পত্রিকায় উভয় বাংলার লেখকরা লেখেন । উভয় বাংলার বই উভয় বাংলায় পাওয়া যায় । বইমেলা ও সরকারি অনুষ্ঠানগুলোতেও উভয় বাংলার লেখকরা ও প্রকাশকরা অংশ নিয়ে থাকেন। হয়তো ব্যাপক নয় ততটা । যেহেতু এই দুটো অংশ এখন দুটো আলাদা রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে তাই এক্ষেত্রে উভয় দেশের সরকারি স্তরেই ভাবনাচিন্তা করার দরকার হয়তো ।
১৮. আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা বলতে আপনি কি বোঝেন? কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
দিশারী মুখোপাধ্যায় : তাত্ত্বিকভাবে এই শব্দদুটোর উপর বিস্তৃত গবেষণা আছে , দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত আছে পণ্ডিতদের । সমাজ , অর্থনীতি , রাজনীতি সকলদিকেই এর প্রাসঙ্গিকতা আছে । তেমন কবিতা তথা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এর উপর মতামত আছে ।
তবে আমার মতে যে কবি বা যে কবিতা তার সময়ের থেকে এগিয়ে থাকে এবং আগাম আগামীদিনের কবিতার রূপ রসকে পথনির্দেশ করতে পারে সেটাই আধুনিক কবিতা , আর তা যিনি লিখতে পারেন তিনিই আধুনিক কবি। মধুসূদন , রবীন্দ্রনাথ , জীবনানন্দ প্রত্যেকেই ছিলেন নিজ নিজ সময়ে আধুনিক । কিন্তু পোস্ট মর্ডানিজম বা উত্তর আধুনিকতা নাম দিয়ে কোনো সময় বা সৃষ্টিকে যদি চিহ্নিত করে দেওয়া হয় তবে আধুনিকতার প্রাসঙ্গিকতা আর থাকে না । আধুনিকতা শব্দটি একটি চলমান বিশেষণ । সে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার রূপ পরিবর্তন করে করে আসবে । অথচ একটি কালখণ্ডকে এবং সেই সময়ের সৃষ্টিকে যদি আমি উত্তর আধুনিক বলে চিহ্নিত করে দিই তবে তার পরবর্তী সময়ের পরিবর্তিত রূপ ও বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করার জন্য আরও একটি নামের প্রয়োজন হবে।এবং এরকম চলতেই থাকবে । উত্তর আধুনিক তত্ত্ব এবং সেই সময়ের সাহিত্যের যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো ধরা পড়েছে তাকে আমি মানি , কিন্তু সেই পরিবর্তনকেও আমি সেই সময়ের আধুনিকতা বলতে চাই ।
১৯. আপনার লেখালেখিতে দেশি-বিদেশি কবি/ সাহিত্যিকদের কারো কোনো প্রভাব কি আছে?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : এই প্রশ্নের উত্তর আমি প্রসঙ্গক্রমে আগেই দিয়েছি । প্রত্যক্ষভাবে কিংবা পরোক্ষভাবে সকল কবি সহিত্যেকেরই প্রভাব আমাদের উপর থাকে । তাকে স্বীকার করে তাকেই অতিক্রম করে যাওয়াই আমাদের সাধনা ।
২০. কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
দিশারী মুখোপাধ্যায় : শারীরিকভাবে আমি বর্তমানে পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরে আপাত স্থায়ী ঠিকানায় নিজের বাড়িতে রয়েছি।এই নিজের বাড়ির কথা বলতে গেলেই
“পরের জায়গা পরের জমিন, ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই ” গানটির কথা মনে পড়ে যায় ।
২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি ডাকবিভাগ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে এখন ডোপামিন ও অক্সিটোসিনের অভাবে নিষ্ক্রিয়ভাবে কালহরণ করছি।
সংসার বলতে আমার স্ত্রী আর একমাত্র পুত্র । স্ত্রী এবছরই রাজ্য সরকারের চাকরি থেকে স্বাভাবিক অবসর নেবে। ছেলে জিওলজির উপর এমএসসি পিএইচডি করে টোকিও থেকে পোস্ট ডক্টরেট করে আপাতত কানপুর আই আই টি তে ফেলো হিসাবে রয়েছে । যদিও পড়াশুনার এতটা উপরের স্তর অবধি আমি কিছুই বুঝি না। মা এখনও জীবিত আছে । অন্যান্য ভাই বোন ও তাদের পরিবারও রয়েছে কাছাকাছিই।
২১. আপনি কখনো কি কোনো পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
দিশারী মুখোপাধ্যায় : একসময় আমি সম্পাদক প্রদীপ দাসের সঙ্গে ‘ঝিল্লি’ সাহিত্য পত্রিকায় সহসম্পাদক হিসাবে ছিলাম । সহ হলেও সব কাজই আমাকেই করতে হত ।
আমার নিজের সম্পাদনায় ছিল কবিতার পত্রিকা ‘শব্দগন্ধ’ । পরবর্তীকালে আর একটি কবিতার পত্রিকা সম্পাদনা করি , ‘কবিসভা’ । একেবারে শুরুর দিকে একটি ফোল্ডার করতাম সাহিত্য ও টুকিটাকি নিয়ে ।তার নাম ছিল ‘গামবুট’ । সঙ্গে ছিলেন আমার বন্ধু ডাক্তার রঞ্জন ঘোষাল ।
২২. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
দিশারী মুখোপাধ্যায় :এ নিয়ে বহু সংজ্ঞা , বহু ব্যাখ্যা, মতামত আছে । সে বিস্তারিত আর কিছু বলছি না। তবে এটুকু লক্ষ করি লিটিল ম্যাগাজিনের চরিত্র ইদানিং পাল্টে গেছে । এখন টাকার বিনিময়ে , বন্ধুত্বের বিনিময়ে এবং আমার লেখা যে ছাপাবে সেই প্রচ্ছন্ন শর্তের বিনিময়ে লেখা ছাপা হচ্ছে । কিছু কিছু পত্রিকা থাকে দশক ভাবিত । অর্থাৎ শুধুমাত্র নব্বইএর লেখকরাই লেখা পাঠাবেন , এইরকম। কিছু বড়ো বাজেটের পত্রিকা আছে যারা সরকারি বেসরকারি সহযোগিতার বিনিময়ে পত্রিকা চালান। লিটিল ম্যাগাজিনের আদর্শ বা সামাজিক ও মানবিক আদর্শ কাজ করে না । দক্ষ ও প্রাতিষ্ঠানিক লেখকদের লেখা ছাপা হয় । পরীক্ষানিরীক্ষার পাট প্রায় উঠেই গেছে । আর আছে বই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত সংস্থার পত্রিকা। সেখানে প্রায়ই দেখা যারা তাদের বই টাকার বিনিময়ে সেই সংস্থা থেকে প্রকাশ করে মূলত তাদের লেখাই ছাপা হয় । সঠিক লেখক খুঁজে নেবার তাগিদ এখানকার সম্পাদকদের মধ্যে নেই ।
২৩. অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : ভালো । এর বিস্তৃতি অনেকদূর । তবে অনলাইন পত্রিকাগুলো লেখক ছাড়া আর কেউ হয়তো দেখেন না। নেট সমস্যা এবং অনেক প্রবীণ পাঠক দৃষ্টিজনিত সমস্যার কারণে পড়তে পারেন না । তবুও বলব পরিবেশ ভাবনা মাথায় রেখে চিন্তা করলে ওয়েব ম্যাগাজিন একটি পজেটিভ কাজ । এবং এর ভবিষ্যৎ সুদূরপ্রসারী। তবে এখানেও কিছু সমস্যা আছে।অধিকাংশ অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক সম্পাদনা করেন না । কেবল কপিপেস্টের সুবিধা নেন ।
২৪. “বাংলা রিভিউ” পড়েন? কেমন লাগে? কেমন দেখতে চান–আগামীতে?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : পড়ছি ইদানিং । বেশ লাগে । বাংলা রিভিউ বিভিন্ন রকমের লেখা প্রকাশ করছে। শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত ও বাজারের লেখকদের নিয়ে পড়ে নেই । আমার হাতে যেহেতু এই মোবাইলটা ছাড়া অন্য কোনো বড়ো ডিভাইস নেই তাই ওয়েভ ম্যাগাজিনে বড়ো লেখা পড়তে চোখের অসুবিধা হয়। নিয়মিত পড়ি আমি অন্যান্য অনলাইন পত্রিকাও । তবে তেমন লিখি না আমি ।লিখতে পারি না ।
২৫. কেমন পৃথিবী কামনা করেন?
দিশারী মুখোপাধ্যায় : স্বাভাবিকভাবে সকলেই বলবে মানুষের বাসোপযোগী পৃথিবী চাই । কিন্তু শুধু কামনা করলেই তো হবে না , তারজন্য আমাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে । কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো প্রতিজ্ঞা করতে হবে এ পৃথিবীকে আগামী শিশুর বাসযোগ্য করে যাব । গ্রেটা থুনবার্গ ও তার নেতৃত্বে যে বাচ্চারা রাষ্ট্রপ্রতিনিধিদের কাছে দূষণমুক্ত পৃথিবীর দাবি করছে রাষ্ট্রনেতারা সে কথায় কর্ণপাত না করে একেরপর এক যুদ্ধ লাগিয়ে চলেছে। শুধু এক প্লাস্টিক দূষণেই গ্রাম শহরের জীবন ওষ্ঠাগত । এরপর খুন , ধর্ষণ , চুরি , প্রতারণা , সামাজিক সম্পর্ক নষ্টের মতো কাজ করে চলেছি অহরহ ।
তবুও আমাদের আশাবাদী হতে হবে । একদিন সকল মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে । সেদিন আমরা এই পৃথিবীটাকেই সুন্দর করে রাখার কাজে হাত দেব , নভোমন্ডলে অন্য পৃথিবীর সন্ধানে না গিয়ে ।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব
মে ১০, ২০২৪
দিশারী মুখোপাধ্যায় অসাধারণ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তাঁর সময়কাল, ব্যক্তিজীবনের অবস্থান, সমকালীন সাহিত্য এবং বাংলাদেশের কবি ও সাহিত্যিকগণ তাঁর বক্তব্যে ঠাঁই পেয়েছে। মানুষের কাছে মানুষই বড় চ্যালেঞ্জ একথা সর্বাংশে সত্য। জীবনের নানান অভিজ্ঞতা তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলাম।