আবু তাহের সরফরাজ
মোহন বলল, অক্ষয় কিন্তু বাস্তব অবস্থাটাই বলেছে জেঠা। যেতে চাইছো যাও, কিন্তু মাসখানেক তীর্থ করে ফিরে এসো। এখানে বসতবাড়ি সব রয়েছে। এসব কে দেখাশোনা করবে? আমরা তো আর এখানে এসে থাকতে পারি না। বারো ভূতে লুটেপুটে খাবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পীতম্বর বললেন, সে তোরা কী করবি করিস। আমি এসব বিষয়সম্পত্তি নিয়ে আর ভাবতে চাই না। এসব থেকে আমার মন উঠে গেছে। ঠাকুরের পায়েই এখন আমার আশ্রয়। ভেতর থেকে এখন আর শান্তি পাই না রে। অন্তরে ঠাকুরের ডাক শুনতে পাই।
ঘরের পেছন থেকে ভেসে আসছে পাখির ডাক। কী রকম যেন করুণ শোনালো সেই ডাক। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে খুন্তি-চামচের শব্দ। পাঁচ-ফোড়নের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে হাওয়ায়। মোহন কিংবা অক্ষয় কেউই আর কিছু বলল না। বুকের ভেতর হাহাকার টের পেল অক্ষয়। মনে হলো, তার শেকড় যেন ছিঁড়ে ফেলছে কেউ! খেতে বসেও গলা দিয়ে ভাত নামছিল না তার। বুকের ভেতর থেকে কান্না উঠে আসছিল। শ্যামামণি খাবার বেড়ে দিচ্ছিল। মোহনকে বলল, আরেকটু ভাত দিই দাদা? আপনি তো তেমন কিছুই মুখে তুলছেন না।
মোহন মাথা নাড়ালো দু’দিকে। মুখে বলল, কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না শ্যামা। তুমি বরং অক্ষয়কে দাও। কী রে অক্ষয়, খাচ্ছিস না কেন? দাও তো শ্যামা, ওর ভাতে আরেক চামচ ভাত তুলে দাও।
অক্ষয় মুখ তুলে বলল, না-না, আমাকে আর কিছু দিও না। আমার খিদে নেই।
খেতে খেতে দয়াময়ী বললেন, কেন রে অক্ষয়, এমন করলে চলে রে বাবা? তোর বাপের সংসারে আর মন টিকছে না। বেচারার প্রতি তোরা একটু সহানুভূতি দেখাবি না? অনেকেই তো এই বয়সে এসে কাশীবাসী হচ্ছে। এ আর নতুন কী!
শ্যামামণি বলল, আমার খুব ইচ্ছে ছিল আপনাদেরকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে একসাথে থাকবো। আপনার ছেলের লেখাপড়াটা শেষ হলেই আপনাদের নিয়ে যেতাম। ও চাকরি করতো। বাকি জীবনটা আমরা একসাথে কাটিয়ে দিতে পারতাম।
উঠে গিয়ে হাত ধুতে ধুতে পীতম্বর বললেন, তোমরা সবাই যদি এমনভাবে বলো তাহলে তো আমার সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। তোমরা কি সেটা চাও? আমার মনের শান্তি তোমরা দেখবে না?
মোহন বলল, জেঠা, আপনি যেখানে ভালো থাকবেন সেখানে আমাদের আপত্তির কিছু নেই। আপনি আর জেঠিমা ছাড়া আমার আর অক্ষয়ের আর তো কেউ নেই। আপনাদের ছাড়তে তাই মন সায় দিচ্ছে না। সে যাক, কবে রওনা দিতে চান?
গামছায় হাত মুছতে মুছতে পীতম্বর বললেন, তোর তো কাল অফিস আছে। অক্ষয়েরও স্কুল খোলা। যাবই যখন, দেরি করে আর লাভ কী! কালই রওনা দেয়া যাক। একসঙ্গে কলকাতা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। সেখান থেকে আমরা কাশীর উদ্দেশে যাত্রা করবো।
অক্ষয় জিগেশ করলো, ঘরবাড়ির কী ব্যবস্থা করবে বাবা?
পীতম্বর বললেন, সে আমি ঠিক করে রেখেছি। নরেন মিত্তিরকে চাবি দিয়ে যাব। সপ্তায় একদিন লোক লাগিয়ে ঘরদোর সাফসুতরো করে যাবে। নরেনের ওপর আমার সে বিশ্বাস আছে।
অক্ষয় বলল, তাহলে তো বেশ ভালো হলো। নরেন কাকু খুবই ভালো মানুষ। তার হাতে চাবির গোছা থাকলে নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। ছোটবেলায় অসুখ-বিসুখ হলে কতবার তিনি এসে দেখে গেছেন। তার হাতের পাঁচনকে কী যে ভয় পেতাম। এখনো কি তিনি কবিরাজি করেন বাবা?
সেইভাবে আর নয়। তবে একেবারে ছেড়েও দেয়নি। অল্পকিছু রোগী এখনো দেখে। আজকাল চোখে ভালো মতো দেখতে পায় না।
দয়াময়ী বললেন, হ্যাঁ রে মোহন, তুই তো কিছুই মুখে তুললি না বাছা! এসেই যেরকম বকবক করছিলি, তোর জন্যই তো এত পদ রান্না হলো।
খেয়েছি তো জেঠিমা। তবে আজ যে তুমি রাঁধোনি, সে আমি বুঝে গেছি। আজ রেঁধেছে শ্যামা।
দয়াময়ী বললেন, কেন, শ্যামাকে তো আমি বলেকয়ে দিয়েছি। স্বাদ হয়নি বুঝি?
মোহন জবাব দিল, স্বাদ তো হয়েছে জেঠিমা। কিন্তু তোমার হাতের ছোঁয়া এমনই যে, যা-ই ধরো তা-ই অমৃত হয়ে যায়। এই যে শ্যামা, তুমি আবার কিছু মনে কোরো না যেন। তোমার হাতের রান্নাও চমৎকার।
দয়াময়ী লজ্জা পেল। বলল, না-না দাদা, সে তো আমি জানিই। কোথায় মায়ের রান্না, আর কোথায় আমার!
বাড়ির পেছনে আমগাছটায় সেই পাখিটা থেকে থেকে তখনও ডেকে চলেছে। এঁটো থালা-বাসন গোছাতে লাগলো শ্যামামণি। দয়াময়ী সাহায্য করতে এলে সে বলল, আপনি ঘরে যান মা। ওদের সাথে গল্প করুন। আমি এসব ধুয়েটুয়ে নিচ্ছি। সারা জীবন তো আপনিই করে গেছেন। এখন থেকে তো এসব দায়িত্ব আমারই।
দয়াময়ীর চোখে জল এসে যাচ্ছে। জীবনে এত মায়া কেন? পৃথিবী কি তবে মায়ার তৈরি? মায়াই কি তাহলে ভগবান? এসব তত্ত্বকথার জবাব দয়াময়ী জানেন না। কেবল টের পান, বুকের ভেতর ঘূর্ণি তোলা হাহাকার।
রাতে কারোরই ভালোমতো ঘুম হলো না। খালি এপাশ আর ওপাশ। রাতের নির্জনতা ভেঙে রাতজাগা পাখি আর দূরের জঙ্গল থেকে শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক ভেসে এলো। ভোর হতেই শুরু হলো তোড়তোড়। গোছগাছ, আর বাকসো-প্যাটরা বাঁধা। পাড়া-প্রতিবেশীরা জড়ো হতে লাগলো। এই মানুষগুলোর সাথে কত যে মায়া জড়িয়ে আছে, এই প্রথম টের পেলেন দয়াময়ী। বারবার তার চোখ ভিজে উঠছিল। গাছের মতো মানুষেরও আসলে শেকড় আছে। এই শেকড়ের টান সবসময় টের পাওয়া যায় না। কেবল এই রকম বিদায়ের মুহূর্তেই তীব্রভাবে অনুভবে উঠে আসে। দয়াময়ী অনুভব করলেন সেই শেকড়ের টান। প্রতিবেশী কয়েকজন নারীর সাথে বসে কথা বলছিলেন তিনি। মোহন, অক্ষয় আর শ্যামামণি গোছগাছ করছিল। দয়াময়ী বলে-বলে দিচ্ছিলেন। সব তো আর নেয়ার দরকার নেই। দরকারি কিছু জিনিস তিনি দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। গায়ে ফতুয়া চড়িয়ে পীতম্বর বললেন, আমি একটু ঘুরে আসি। তোমরা সব বেঁধেছেঁদে নাও। ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করতে হবে।
মোহন জিগেশ করল, আমি আসবো জেঠা?
দরকার নেই। তুই এদিকটা দ্যাখ। আমি এক্ষুণি ফিরে আসবো। বেলায় বেলায় রওনা দিতে হবে। হাতে সময় নেই।
সকালের জলখাবার তৈরি করতে শ্যামা ঢুকেছিল রান্নাঘরে। বেরিয়ে এসে ভিড় দেখে সে ডাকলো, মা, এদিকে একটু শুনে যান তো।
দয়াময়ী এলে সে বলল, জলখাবার তো তৈরি। আপনারা একটু মুখে দিয়ে নিন।
দয়াময়ী বললেন, আমার খিদে নেই মা। তুমি অক্ষয় আর মোহনকে খেতে দাও। উনি আবার ঘোড়ার গাড়ি আনতে গেছেন।
শ্যামা বলল, এত লোকজন এখানে। জলখাবার কোথায় দেব মা?
রান্নাঘরেই দাও। আমি ওদেরকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
পথে খাওয়ার জন্য কিছু খাবার টিনের কৌটায় ভরে নিয়েছি মা। কলকাতায় কখন পৌঁছাবো তার তো কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।
ভালো করেছো বউমা। তুমি এখন ওদেরকে জলখাবার দাও, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
শ্যামা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
ঘণ্টা দেড়েক বাদে ঘোড়ার গাড়িতে ফিরলেন পীতম্বর। সাথে নরেন মিত্তির। মোহন আর অক্ষয় মালপত্র তুলতে শুরু করলো। নরেনকে সাথে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলেন পীতম্বর। দয়াময়ী বললেন, আপনাদের জলখাবার দিই। কই রে মা শ্যামা?
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন পীতম্বর। নরেনদার বাড়ি থেকে আমি জলখাবার খেয়ে এসেছি। ও নিয়ে ভেবো না। তুমি বরং ওদিকটা দ্যাখো। গাড়িতে সবকিছু ঠিকঠাক তোলা হলো কিনা। অবশ্য নেয়ার কীই বা আর আছে। যাচ্ছি তীর্থে। সংসারের আবর্জনা সেখানে সাথে নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।
দয়াময়ী আর দাঁড়ালেন না। নরেন মিত্তির ঘাড় নাড়লেন, তা যা বলেছ পীতম্বর। কিন্তু যে দায়িত্ব তুমি আমার কাঁধে দিয়ে যাচ্ছ সে যে বিরাট ভার। কতদিন আর এই ভিটেবাড়ি আমি দেখভাল করতে পারবো, বলো? আমারও তো বয়েস হচ্ছে।
তুমি ছাড়া আর কাকে বিশ্বাস করবো নরেনদা? সেই কবে থেকে তোমাকে চিনি-জানি। আর কার কাছে রেখে যাব এসব! যতদিন পারো, দেখাশোনা কোরো। এরপর কী হয়, পরে দ্যাখা যাবে। বছরে এক-দু’বার অক্ষয় কিংবা মোহন এসে দেখেশুনে যাবে। কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে উঠল পীতম্বরের।
নরেন বললেন, যতদিন বেঁচে আছি যজ্ঞের ধনের মতো তোমার ভিটেবাড়ি আগলে রাখবো পীতম্বর। তুমি ভেবো না। নিশ্চিন্তে যাত্রা করো।
মোহনের হাঁক শোনা গেল, গাড়ি তৈরি। কই জেঠু? দেরি করলে বেলা যে গড়িয়ে যাবে। কই জেঠিমা, এবার রওনা করা যাক।
গাড়িতে উঠলেন সকলে। শ্যামা বসলো দয়াময়ীর পাশে। দয়াময়ী আঁচলের খুঁট দিয়ে বারবার চোখের জল মুছছেন। শ্যামা তার একটা হাত ধরে ফিসফিসিয়ে বলল, কাঁদবেন না মা। বাবা কষ্ট পাবেন। দেখছেন না, ওনার মনের কী অবস্থা।
গাড়ি চলতে শুরু করলো। প্রতিবেশীরা চোখের জল মুছছে। গাছতলায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে করুণ চোখে চেয়ে আছেন নরেন মিত্তির। বুকের ভেতরটা কী রকম যেন মোচড় দিয়ে উঠল পীতম্বরের। জীবন কত ক্ষুদ্র। কে বলবে, ওই বাড়িটাতেই ছিল তার সুখের সংসার। কত দিনের হাসি-কান্না মিশে আছে বাড়ির আনাচে-কানাচে। আজ সবকিছু স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতির ধূসর পট ধীরে ধীরে চোখের আড়াল হয়ে গেল। কারো মুখে কথা নেই। ভাষা ফুটছে না। ঝলমল রোদের দিন। কিন্তু ঘোড়ার গাড়িতে বসে থাকা কয়েকজন মানুষের মুখের ওপর বিষাদের ছায়া এসে পড়েছে। গাড়ির দুলুনিতে দুলছে তারা। চলেছে পুরনো জীবন ছেড়ে নতুন জীবনে।
নীরবতা ভাঙলো মোহন। বলল, জেঠু, ওখানে গিয়ে তো প্রথমদিকে মানিয়ে নিতে আপনাদের কষ্ট হবে। নতুন জায়গা, পরিচিত হতেও কয়েকদিন সময় লাগবে। সাথে টাকা-পয়সা কী রকম আছে?
পীতম্বর বললেন, নিয়েছি কিছু। আগে তো ওখানে যাই। একটা কোনো ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।
পীতম্বরের মুঠোর ভেতর চারশো টাকা গুঁজে দিয়ে মোহন বলল, এই টাকাটা রাখেন জেঠু। আপনাদের কাজে লাগবে। বিদেশ-বিভুঁই জায়গা! জানি, টাকার খুবই দরকার।
মুখে কিছু বললেন না পীতম্বর। কী বলবেন, তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না। আবারও চোখে জল এসে যাচ্ছে। মোহনের একটা হাত ধরে চুপচাপ বসে রইলেন তিনি। চোখ ছলছল।
দয়াময়ী বললেন, বলতে গেলে সংসারটা তো এতদিন তোর উপার্জনেই চলেছে মোহন। অক্ষয়ের লেখাপড়ার খরচও তোর কাঁধে। এখন আবার এতগুলো টাকা… তোর ভবিষ্যৎ ভাববি না?
মোহন বলল, আমি বুঝি এই সংসারের কেউ না? আপনার কথায় বড় আঘাত পেলাম জেঠিমা। এসব আর বলবেন না। বিয়েথা করিনি, করার ইচ্ছেও নেই। আমার তেমন খরচও হয় না। অক্ষয়টা মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠলেই আমার সুখ। এসব টাকাকড়ি আগলে রেখে আমি কী আর করবো! আপনারা ভালো থাকুন, এর বাইরে আমার চাওয়া-পাওয়ারও কিছু নেই জেঠিমা।
মাথা নিচু করে রইলেন দয়াময়ী। চোখ দিয়ে টপটপ জল গড়িয়ে পড়ছে। কে বলবে, মোহন তার পেটের ছেলে নয়! হে ভগবান, মোহনকে তুমি দেখো। ওর কল্যাণ কোরো।
অক্ষয় বলল, মোহনদা, তুমি কিন্তু প্রতিমাসে এসে আমাদের দেখে যাবে।
মোহন ক্লিষ্টমুখে খানিক যেন হাসলো, তা তো আসতেই হবে রে পাগলা। এতদিন জেঠিমাকে জ্বালিয়েছি। এবার জ্বালাবো তোর বউকে। দু’ভাই ইচ্ছেমতো বাজার করবো। এরপর শ্যামা রাঁধবে, আমরা বসে খাবো। কী, ঠিক আছে তো শ্যামা?
শ্যামামণি বলল, অবশ্যই দাদা। সে আর বলতে হবে কেন! মায়ের কাছ থেকে রান্নাটা আমি মোটামুটি শিখে নিয়েছি। যা খেতে ইচ্ছে করবে বলবেন, আমি রেঁধে খাওয়াবো। আপনি এলে কত ভাল্লাগে!
[ চলবে…]